রূপসী বাংরিপোসী
১:
নিকশ কালো মসৃন হাইওয়ে। দুপাশে লাল মাটির কার্পেট বিছানো। সেই কার্পেটের ওপর কেউ যেন মানানসই ভাবে সবুজের আচ্ছাদন তৈরী করে রেখেছে। সামনে নীল পাহাড় উইন্ড স্ক্রিনের বাইরে থেকে জানান দিচ্ছে বাংরিপোসী দুহাত ভরে আমায় গ্রহন করতে প্রস্তুত।
![Approaching Bangriposi](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-approach.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Approaching Bangriposi
এই রাস্তা যেন সোজা দৌড়ে গিয়ে ঠাকুরানী পাহাড় শ্রেণীর কোলে গিয়ে আছড়ে পড়বে । গুগল নেভিগেটর এ ” You have reached your destination ” শুনেই সজাগ হয়ে গাড়ির স্পীড কমালাম। ডান হাতে চোখে পড়লো Khairi Resort। বেশ বড় গেট আর চোখে পড়ার মতো। আমার গন্তব্য খয়েরি নয়, হোটেল বাংরিপোসি। একটু এগোতেই দেখলাম ডান হাতেই ছোট্ট একচিলতে বোর্ড এ লেখা Hotel Bangriposi. খয়েরির তুলনায় বড়ই যেন সাদামাটা লাগলো। একটু মনক্ষুন্ন হয়েই গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়লাম খোলা কাঠের গেট দিয়ে। ভেতরে জায়গা অনেকটা। এঁকেবেঁকে এগোতেই দেখি মাটির কুঁড়েঘরের সামনে একটি বেঞ্চ পেতে এক বৃদ্ধ বসে।
![Budhiya at Bangriposi Hotel](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-budhiya.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Budhiya in front of his hut at Bangriposi Hotel premises
গাড়ি থেকে নামতেই বললেন ওনার ঘরের পেছনদিকে আমার কটেজ। এক অল্পবয়সী মহিলাকে বললেন আমার ঘরটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। গাড়িটা কয়েক চাকা বাড়াতেই যে দৃশ্য দেখলাম, তা দেখে মনে মনে এই রিসোর্টের মালিক শিন্টু বাবুকে মনে মনে ধন্যবাদ জানলাম আর নিজের হোটেল নির্বাচনের বুদ্ধিকেও বাহবা দিলাম। সুন্দর ছোট্ট একটি দরমার বেড়া দেওয়া কটেজ। ছোট্ট একটি বারান্দা। লাল মেঝে তার। দুটো সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বারান্দা। বাঁশের তিনটি পিলার ধরে রেখেছে বারান্দার ওপর ছাউনি টাকে। চালের থেকে দুটো লণ্ঠন ঝুলছে। বারান্দার সিঁড়ি অব্দি সুন্দর করে দুপাশে ইঁটের সারী দিয়ে রাস্তা করা। তার দুপাশে পাথর ছড়িয়ে সাজানো। কটেজ এর এসবেস্টর্সের ছাদের ঠিক ওপরেই শিমুল গাছ। ঝরে যাওয়া কিছু শুকনো শিমুল চারিদিকে ছড়ানো। গাড়িটি কটেজ এর গায়ে লাগিয়ে পার্ক করে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আবার দু চোখ ভরে দেখলাম। ঠিক যেমনটা ছোটবেলায় রং পেন্সিল দিয়ে কুঁড়েঘর আঁকতাম…এ যেন ঠিক সেই ড্রইংয়ের খাতাগুলো থেকে উঠে আসা আমার ছোট্ট আস্তানা। আমার মনের আস্তানা। আমার মনের ঠিকানা।
![Bangriposi Cottage](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-cottage.jpg?resize=508%2C768&ssl=1)
My cottage at Bangriposi Hotel
নিজের মনের অলিগলি দিয়ে যখন ঘুরে বেড়াচ্ছি…” বাবু, ঘর খান খুলি দিছি। একবার দেখি নেন।” সেই অল্পবয়সী মহিলার কথায় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ঘরের ভেতরে এলাম। এসে আরেক চমক। যাবতীয় ব্যবস্থা আছে। অথচ ইন্টেরিওর টা একদম বাইরের ওই ড্রয়িং খাতার hut এর সাথে মানানসই। দেওয়ালে শেলফে রাখা দু তিনটি বাংলা বই। সুসজ্জিত ইঁটের রং করা দেওয়াল একদিকে। তাতে সুন্দর কিছু ফটো ফ্রেম। সমস্ত ঘর টা যেন কোনো এক শিল্পীর নিপুন তুলির টানে আঁকা।
![Interior of Bangriposi cottage room](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-room-interior.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Interior of my room at Bangriposi Hotel
মহিলা নিজের পরিচয় দিয়ে বললো, উনি বুধিয়ার পুত্রবধূ। বুধিয়া এখানকার কেয়ারটেকার এবং স্বপরিবারে ওনারা ওই সামনের ঘরটায় থাকেন। আমার খাবার যাবতীয় ব্যবস্থা এই মহিলাই করে দেবেন। দুপুরে কি খাবো তার অর্ডার নিয়ে মহিলা চলে গেলেন নিজের কাছে।
২:
ঘড়িতে তখন ১.১৫। ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখ, তাই ঠান্ডা একেবারে নেই বললেই চলে। কোলকাতা থেকে কোলাঘাট হয়ে মুম্বাই রোড ধরে ২৩৫ কিমি একা হাতেই গাড়ি চালিয়ে লোধাশূলীর জঙ্গল পেরিয়ে ঝাড়খন্ড বর্ডার পেরিয়ে ওড়িশা ঢুকে বাহারাগোড়া পৌঁছে থমকে যাই। রাস্তা তো নয়, যেন গাড়ির জন্য কমান্ডো ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা। এখন থেকে বাংরিপোসী ৭ কিমি। রাস্তায় পিচ ১০%, আর গর্ত ৯০%। ১০ এর বেশি স্পীড তোলা মানেই গাড়ির দফারফা। পথে এক অদ্ভুত মন্দির পড়লো। সামনেটা রাক্ষসের মুখ।
![Strange Kali Temple At Bangriposi](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-strange-kali-temple.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Strange Kali temple at Bangriposi
ভেতরে কালী মায়ের দর্শন করে ক্লাচ আর ব্র্যাকের যুগলবন্দি তে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে এসে পৌঁছেছি এই শান্ত নীড়ে। নিজের মনের এই ঠিকানা খুঁজে পেয়ে এতটা ড্রাইভ করে আসার ক্লান্তি যেন এক নিমেষে ভুলে গেলাম। যথাসময় স্নান খাওয়া সেরে বিকেলটায় আশপাশ টা একটু হাঁটাহাঁটি করে ফিরে এলাম। বুধিয়ার ঘরের সামনে আরেকটি লম্বা ধরণের কটেজ। ৫ জনের অল্পবয়সী ট্যুরিস্ট গ্রুপ দেখলাম দুটি ঘর নিয়ে আছে। এই ঘরগুলিও বেশ সুন্দর করে সাজানো ভেতরটা। দেওয়াল ভর্তি আলপনা। কোথাও তার মাঝে পুরোনো দিনের নিছক একটা হাতপাখা দেওয়ালে সাজিয়ে রাখা, কোথাও সিমলিপালের কিছু ছবি।
![Interior of other room at Bangriposi Hotel](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangrioposi-other-room-interior.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Interior of other room at Bangriposi Hotel
ফিরে এলাম আমার শান্ত নীড়ে। সন্ধ্যের অন্ধকারে বারান্দার লন্ঠন গুলো কে যেন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। নিকশ কালো আকাশ ওপরে শত সহস্র নক্ষত্র খচিত। তার মাঝে আমার সেই শান্ত নীড় মিঠে আলোয় এক অপরূপ রূপ ধারণ করেছে তখন। ট্রাইপড টা বাইরে নিয়ে এসে স্লো শাটার স্পীডে রাতের কিছু মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দী করলাম । বুধিয়ার সাথে কথা বলে, পরের দিনের একটা প্ল্যানিং মাথায় ছকে নিলাম।
![Bangriposi Hotel cottage at night](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-cottage-at-night.jpg?resize=1200%2C795&ssl=1)
My cottage at night
৩:
জলখাবার টা একটু ভারী করে করেই ২৫ তারিখ সকাল ১১ টা নাগাদ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। উত্তেজনা চরমে কারণ এই প্রথম পাহাড়ে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা পাবো। স্লেট এর মতো কালো আর মসৃন এই রাস্তা, যাকে বলে driver’s paradise. সামনে উকিঁ মারছে নীল পাহাড়। যত এগোচ্ছি দুধারের দৃশ্য দ্রুত বদলাচ্ছে।
![Hilly road for Bangriposi Sightseeing](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-hilly-road.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Next day morning for Bangriposi Sightseeing
সবুজ, হলুদ আর বেগুনি গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে পলাশ আর শিমুল সিঁদুরে আভা তৈরী করে জানান দিচ্ছে ফাগুনের স্পর্শ এখনো রয়ে গেছে। এই রাস্তায় গাড়ি খুবই কম। মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত কিছু লরি আর বাইক এবং সাইকেল।
অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই চড়াই শুরু হলো। নাই বা হোক দার্জিলিং বা সিকিমের কোনো পাহাড়। পাহাড় কিন্তু পাহাড়ই। সমতলের চওড়া রাস্তাটা এখন সরু পাহাড়ি রাস্তা। একের পর এক hair pin bend. এমনি এক বাঁকের পরেই পেলাম দুয়ারসুনি মন্দির। ফেরার সময় দেখবো বলে এখন আর গাড়ি থামলাম না। আবহাওয়া থেকেও বোঝা যাচ্ছে altitude গেইন করছি। ঠান্ডা হাওয়া গায়ে এসে লাগছে। আমার তো এখন ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। আর পায় কে আমায়। একে তো এমন নৈস্বরগিক সৌন্দর্য চারিদিকে, তারওপর নিজে হাতে ড্রাইভ করে এই প্রথম পর্বতারোহণ। রোমাঞ্চের তুঙ্গে তখন আমার প্রাণ। ৩০০০ ফুট এর কাছাকাছি উচ্চতা এই ঠাকুরানী পাহাড় শ্রেণীর। বহু বানরের পরিবারের বসবাস এই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে।
![Bangriposi Sightseeing Uphill Road](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-uphill-road.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Self drive through beautiful uphill road for Bangriposi Sighseeing
![Road through plateau for Bangriposi Sightseeing](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-road-through-plateau.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Road through the plateau
বেশ কিছুটা আরও চড়াই ওঠার পর আবার সমতল রাস্তা পেলাম। এদিকটা মনে হচ্ছে মালভূমি। ছোট ছোট আদিবাসী গ্রাম চোখের সামনে একেক করে ভেসে উঠছে। এরকমই একটি গ্রামের চায়ের দোকানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বাঁকাবাল ড্যামের পথ টা জেনে নিয়ে, স্টিয়ারিং সেদিকে ঘোরালাম। নেভিগেটর এর ম্যাডাম যেন একটু মনক্ষুন্ন হলেন কারণ তিনি আগেই সেই রাস্তা বার বার করে আমায় বলে দিয়েছিলেন। বাংরিপোসী থেকে বাঁকাবালের দূরত্ব প্রায় ১৪কিমি। বড় রাস্তা থেকে নেমে শুরু আদিবাসী গ্রামের ভেতর দিয়ে সরু রাস্তা। চড়াই উৎরাই ভেঙে গিয়ে পৌঁছলাম বাঁকাবাল ড্যাম।
![Top of Bankabal Dam at Bangriposi Sightseeing](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-bankabal-dam-top.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Took my car to the top of Bankabal Dam
গাড়ি নিয়েই একেবারে ড্যামের উপরের সরু রাস্তায় উঠে পড়লাম। সুবিশাল হ্রদ। হ্রদের ওপারে জলছবিতে তুলির হালকা টানে আঁকা নীল পাহাড়ের শ্রেণী। জলের মাঝখানে কোথাও কোথাও চর পরে সৃষ্টি হয়েছে আটলাসের একেকটি দেশের মানচিত্র।
![Bankabal Dam Sightseeing](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-bankabal-canal.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Canal on the other side of the Bankabal dam
![Bankabal Dam lake on Bangriposi Sightseeing](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-bankabal-dam-lake.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
The lake at Bankabal Dam
নেভিগেটর এর কথামত এই ড্যামের রাস্তার অপর প্রান্ত দিয়ে বেরোতে গিয়ে দেখি গাছের ডাল ফেলে রাস্তা আটকানো। সহৃদয় এক ওড়িয়া ব্রাহ্মন আমার করুন অবস্থা দেখে এগিয়ে এসে বোঝালেন যে এই রাস্তা কিছুদিন হলো ড্যাম থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, নইলে এই রাস্তা দিয়ে খুব সহজেই পৌঁছে যেতাম সুলাইপাত ড্যাম। গাড়ি টা ঘোরাতে বেশ বেগ পেতে হলো ওই সরু রাস্তায়। বার পাঁচেক আগুপিছু করে অবশেষে গাড়ি ঘুড়িয়ে চললাম সুলাইপাত ড্যাম এর উদ্দেশ্যে। বাংরিপোসী থেকে সুলাইপাতের দূরত্ব ৪৭কিমি।
৪:
যে পথে বাঁকাবাল এসেছিলাম, সেই পথেই ফিরে এসে আবার বড় রাস্তা ধরলাম। যতই এগোচ্ছি ততই যেন মনে হচ্ছে চারিদিকে রঙের মেলা বসেছে। দুই পাশে লাল মাটির প্রান্তর। সেই লাল মাটির সাথে পাল্লা দিয়ে ফাগুনের রক্তিম আভা ছড়িয়ে রেখেছে ইতস্তত ছড়ানো লাল পলাশের বন। থেকে থেকেই গাড়ি দাঁড় করছি আর নেমে দুচোখ ভরে বাংরিপোসীর রঙের নেশায় বুঁদ হয়ে যাচ্ছি।
![Palash Tree on way to Bangriposi Sightseeing](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-palash-tree.jpg?resize=508%2C768&ssl=1)
A single palash tree
![Palash forest on way to Bangriposi Sightseeing](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-palash-forest.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Palash forest on way to Bangriposi Sightseeing
![Bangriposi Road Through Palash Forest](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-road-through-palash-forest.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Beautiful road through forest full of Palash Trees
নেভিগেটর এর আদেশে এইবার আবার বড় রাস্তা ছেড়ে ভেতরের এক সরু রাস্তা নিলাম। প্রকৃতি যেন তার সমস্ত নির্যাস উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে। কোথাও বা ঘন সবুজ আর নীলচে গাছের সারি, কোথাও বা শুধুই পলাশ। কোথাও বা জঙ্গল, কোথাও ফাঁকা ধূধূ প্রান্তর। আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে ঢুকে পড়লাম এক আদিবাসী গ্রামে। এক জায়গায় দেখি গ্রামের মহিলারা পথে বসে হাঁড়ি নিয়ে হাড়িয়া বিক্রি করছে। স্থানীয় মানুষজনের প্রিয় পানীয় এই হাড়িয়া।
![A tribal hut on Bangriposi Sightseeing](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-tribal-hut.jpg?resize=1200%2C795&ssl=1)
A tribal hut in a tribal village
![Bangriposi Haria](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-haria.jpg?resize=1200%2C795&ssl=1)
Women selling Haria
অবশেষে এসে পৌঁছলাম সুলাইপাত ড্যাম। এটি আকারে বাঁকাবালের থেকে বড়। ওপরের রাস্তাটিও বেশ চওড়া। খারকাই নদীর ওপর এই বাঁধ। ঘন নীল জল চারিদিকে। সরোবর টিকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে সুদূরের নীল পাহাড়। পাহাড় আর জলের মাজখানে তুলির টানে কেউ যেন এঁকে রেখেছে সবুজ, লাল, হলুদ আর বেগুনির filler। চোখ ফেরানো দায় এই রূপ থেকে। ড্যামের একেবারে অন্য প্রান্ত অব্দি হেঁটে গিয়ে দেখি সেদিকে নিচে নেমে একটি পার্কে চলে যাওয়া যায়। খাড়াই পাহাড় উঠে গেছে এই প্রান্ত থেকে আর তার পাদদেশেই এই পার্কটি।
![Sulaipat dam at Bangriposi Sightseeing](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-sulaipat-dam.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Sulaipat Dam
৫:
আজ শনিবার। শিন্টু বাবুর থেকে আগে জেনে নিয়েছিলাম যে বিশই ( Bisoi ) বলে একটি জায়গা আছে বাংরিপোসী থেকে ১৭কিমি দূরে। Bisoi তে হাট বসে এবং অনেক জিনিসের মধ্যে এই হাটে মুরগী লড়াই ও একটি আকর্ষণ। সুলাইপাত থেকে বেরিয়ে Bisoi র পথে এগোলাম। একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলাম। কোনো রাস্তার সাথে কোনোটার মিল নেই। এই পথের সৌন্দর্য যেন আলাদা। দুপাশে ঘন সবুজ আর পলাশের ছায়া রাস্তাটিকে মায়াবী করে তুলেছে। এ যেন এক স্বপ্নের জগৎ। পথে পড়লো আরেকটি আদিবাসী গ্রাম। ঘন্টা খানেক লাগলো Bisoi পৌঁছতে। এতো এলাহী ব্যাপার। এমন হাট খুব কম দেখেছি। কাঁচের চুড়ি, জামাকাপড়, সবজি, মাছ, মাংস, ঘর সাজানোর জিনিস, হাড়িয়া, মুরগী….কি নেই তাতে!! ক্রেতা এবং বিক্রেতা বেশিরভাগই আদিবাসী।
![Bisoi Haat on Bangriposi Sightseeing](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-bisoi-haat.jpg?resize=1200%2C795&ssl=1)
Bisoi Haat
বেশ লাগছিলো ভিড়ে মিশে Bisoi র রঙের খেলা দুচোখে দেখতে। অনেক খুঁজেও অবশ্য মুরগীর লড়াই পেলাম না। হাট দেখে বেরোতে প্রায় ৩.২৫ বাজলো। এবার আমার। নীড়ে ফেরার পালা। আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম দুযারসনি মন্দির পাহাড়ী বাঁক ঘুরতে ঘুরতে। মন্দিরটি পাহাড়ের বেশ উঁচু জায়গায়। দর্শন সেরে ফিরে এলাম হোটেল বাংরিপোসী।
![Bangriposi Bisoi Haat Bangles](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-bisoi-haat-bangles.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Colorful bangles at Bisoi Haat
![Duarsini Temple at Bangriposi Sightseeing](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-duarsini-temple.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Duarsini Temple
৬:
বুধিয়ার পুত্রবধূকে সকালে বেরোনোর সময়ই দুপুরের খাবার তৈরী রাখতে বলে এসেছিলাম। বিকেল টা বুড়িবালাম নদীর ধারে কাটাবো বলে চটপট স্নান খাওয়া সেরে তৈরী হয়ে নিলাম। বেশ খানিকটা ড্রাইভ করে প্রথমে গেলাম কানচিন্দা গ্রামে। নদীর ধার বরাবর রাস্তা। পড়ন্ত বেলার আলোয় দূরের পাহাড়গুলো আরও মায়াবী লাগছে। একটি বড় মাঠের সামনে এসে গাড়ি থামালাম। মাঠের এক প্রান্তে বড় বড় গাছের ছাউনিতে ঘেরা লম্বাটে একটি একতলা কাঁচা ঘর। ঘরের সামনে এক বৃদ্ধ এক দল ছোট ছোট বাচ্ছাদের নিয়ে খেলা করছে। এই বৃদ্ধ সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় এই উন্মুক্ত পাঠশালা গড়ে তুলেছেন বহু বছর আগে। প্রকৃতির মাঝে খোলা আকাশের নিচে আদিবাসী শিশুদের একটু একটু করে বড় করে তোলাই এখন তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। ফিরে চললাম বুড়িবালামের পাড়ের দিকে। কানচিন্দা হয়ে ফিরতে গিয়ে সময়টা অনেকটাই লেগে গেল। সূর্য তখন অস্তাচলে। নদীর পারে পৌঁছনোর কিছুটা আগেই আমার চোখ থমকে গেল একটা জায়গায়। গাড়ি চালাতে চালাতে আমার চোখ বারবার যাচ্ছিল রিয়ার ভিউ মিরর এ। সূর্যের হাবভাব আমি এই মিরর এই লক্ষ্য রাখছিলাম। এই জায়গায় হঠাৎ দেখি তিনি গা ঢাকা দিচ্ছেন দূরে পাহাড়গুলোর আড়ালে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে ক্যামেরা নিয়ে সাক্ষী হলাম সেই নৈসর্গিক মুহূর্তের। গোধূলির রং মেখে বিশ্ব চরাচর তখন বিদায় জানাচ্ছে সূর্যকে পাহাড়ের আড়ালে।
![Sunset At Bangriposi](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-sunset.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
I was tracking the setting sun
এই মুহূর্তটিকে লেন্স বন্দী করে চলে এলাম বুড়িবালাম নদীর পাড়ে। নীল পাহাড়ের মাথায় গোলাপী আভায় তুলির শেষ টান গুলো দিয়ে দিনটা শেষ করলো বাংরিপোসী শিল্পী।
![Sunset over Buribalam River on Bangriposi Sightseeing](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/buribalam-river-at-sunset-time.jpg?resize=1200%2C795&ssl=1)
Buribalam River at sunset time
ফেরার পথে বাংরিপোসী বাজারের কাছেই একটি রাধা কৃষ্ণের মন্দির চোখে পড়লো। তার পাশের চায়ের দোকানে বিষয়ে সন্ধ্যার চা টা সারলাম। হোটেলে ফিরে রাত টা অনেক্ষন কাটালাম বাংরিপোসীর আকাশ দেখে। ব্রহ্মান্ড যেন দুই হাতে সারা বিশ্বের সমস্ত তারা গুলোকে খাবলা মেরে তুলে এনে ছড়িয়ে দিয়েছে বাংরিপোসীর এই নিকশ কালো আকাশ ক্যানভাসে।
৭:
২৬শে ফেব্রুয়ারী। আজ আমার ফেরার দিন। আমার মনের ঠিকানা পাওয়া এই শান্ত নীড় কে বিদায় জানানোর দিন। মনটা একটু ভারাক্রান্ত। তবে নিজেই নিজের মনকে সান্তনা দিলাম যে সফর এখনো শেষ নয়। কোলকাতার পথ ধরার আগে যাবো ডোকরা শিল্প গ্রাম, কুলিয়ানা গ্রামে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে ১১.৩০ টা নাগাদ বুধিয়ার আদি অনন্ত আদিবাসী আতিথেয়তা আর ভালোবাসাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কুলিয়ানার উদ্দেশ্যে। শুনেছিলাম এখানকার স্টেশন টা খুব সুন্দর। বেরিয়ে প্রথমেই গেলাম বাংরিপোসী স্টেশন। সত্যি স্টেশন থেকেই জায়গাটির সৌন্দর্যের একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। লাইন বরাবর পেছনে তাকালেই সমান্তরাল জুড়ে ঠাকুরানী পাহাড় শ্রেণী। নিচু প্লাটফর্ম। স্টেশনের দুধারে সবুজে মোড়া। কোনো এক শিল্পীর জলছবি যেন এই বাংরিপোসী স্টেশন।
![Bangriposi Station](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-station.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Bangriposi Station
![Bangriposi Station With Hills](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-station-with-hills.jpg?resize=1200%2C795&ssl=1)
Beautiful Bangriposi station with hills at backdrop
বাংরিপোসী স্টেশন থেকে কুলিয়ানা ১৮ কিমি রাস্তা। আধ ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম। সরু মেঠো রাস্তা। দারিদ্রের ছবি স্পষ্ট চারিদিকে। গ্রামের সবকটা ঘরেই ডোকরার কাজ হয়। বেশিরভাগ ঘরেই পুরো পরিবার এই ডোকরার কাজে মেতে আছে। খুব কঠিন পরিশ্রম আর সময় সাপেক্ষ কাজ। Wax Melting পদ্ধতিতে এই ডোকরার মূর্তি গুলো বানানো হয়। Copper গলিয়ে এই মূর্তি গুলো বানানো হয়। দুঃখের বিষয় হলো একেবারে জলের দরে ওনাদের এই শিল্প বেচে দিতে হয় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। অথচ এই ডোকরার মূর্তি দেশে ও বিদেশে বিক্রি হয় এর প্রায় ৭-৮ গুন দামে। অথচ যারা শিল্পী, তারা আজও বাস করছে দারিদ্রের অন্ধকারে।
![Kuliana Village at Bangriposi Sightseeing](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-kuliana-village.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Kuliana Village
![Bangriposi Kuliana Dokra Process](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-kuliana-dokra-process.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Dokra processing Clay Container
![Bangriposi Sightseeing Kuliana Dokra Process](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-kuliana-dokra-wip.jpg?resize=1024%2C678&ssl=1)
Dokra dolls in raw form
![Dokra works at Kuliana village on Bangriposi Sightseeing](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/05/bangriposi-kuiana-dokra-works.jpg?resize=1024%2C736&ssl=1)
Final products of dokra
৮:
এইবার সত্যি ফেরার পালা। ছেড়ে যেতে কেন জানি না, মন চাইছে না। এই নির্ভেজাল প্রকৃতি। এই পাহাড়ের আঁচলের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। এই সবুজ। এই রঙের খেলা চারিদিকে। এই দূষণ মুক্ত পরিবেশ। এই অক্সিজেন। এই সহজ সরল আদিবাসী মানুষগুলো। বাংরিপোসী যে শুধুমাত্র একটা নাম নয়, এটি আস্ত একটি জীবন দর্শন। নিজের সাথে নিজের গভীরে গিয়ে আলাপ হওয়ার, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জায়গা এই বাংরিপোসী। অনেকটা রাস্তা একা ড্রাইভ করে ফেরা। আর সময় দিতে পারলাম না। একসিলারেটরে চাপ দিলাম। বেচে নিলাম একটি অন্য রাস্তা। বারিপদা, গোপীবল্লবপুর, লোধাশূলী হয়ে মুম্বাই রোডে উঠলাম। বিদায় বাংরিপোসী।
©Arijit Kar
![](https://i0.wp.com/www.ghuranchandi.com/wp-content/uploads/2021/06/profile.jpg?resize=100%2C100&ssl=1)
Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.
খুব সুন্দরভাবে জায়গাটার বৈশিষ্ট ও সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন। আপনার লেখাটা আমাকে বাংরীপশি যেতে উৎসাহ যোগালো। আপনি কলকাতা থেকে নিজে গাড়িতে গিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে রাস্তার পথনির্দেশক একটা লেখা দিন আমার মেইল এsoumistha.541@rediffmail.com
অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি কি গাড়িতে যেতে চাইছেন ?
খুব ভালো লাগলো..
ধন্যবাদ
নমস্কার
আমি গুজরাটে থাকি, আমার শ্বশুর বাড়ি মুশিদাবাদে, আপনার travel blog এর সব লেখা গুলি পড়েছি, খুব ভালো লাগলো, আমি প্রতিবছর কালী পুজোর সময় পশ্চিমবঙ্গে আসি, এই বার আমার বাংরিপোসী যাওয়ার ইচ্ছে আছে, তাই আপনার কাছে অনুরোধ, আপনি যদি ওখানে যাওয়া, ঘোরা, থাকা/খাওয়া নিয়ে একটা সম্ভ্যাব্য পরিকল্পনা আমাকে জানান তবে খুব ভালো হয়, (ফ্যামিলি নিয়ে যাবো, সঙ্গে প্রাইভেট গাড়ি নেই)। আর আপনাকে গুজরাটে আসার আমন্ত্রণ রইলো।
||ধন্যবাদ||
Good writing. Your simple and informative writing is liked.
Thank you