কুলিকের কলতানে
১:
২০১৬ সালের নভেম্বর মাস। সামাজিক মাধ্যমে পরিযায়ী পাখিদের নিয়ে বিভিন্ন লেখা ও ছবি মাথা চারা দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। সেসব দেখে মনের ভেতর টা হুহু করা শুরু হয়েছে আমারও। তবে সেই সময় আমার কাছে হাতিয়ার বলতে শুধুই ১৮-১০৫ কিট লেন্স। ১০৫ দিয়ে পাখির ছবি বন্দী করা মানে- প্রথমত পাখিটি বড় মাপের হওয়া চাই আর দ্বিতীয়ত পাখিটিকে কাছাকাছি পাওয়া চাই। বিশদ ঘাঁটাঘাঁটি করে এলিমিনাশন রাউন্ডে সব জায়গা বাদ পরে, হাতে পরে থাকলো কুলিক পাখিরালয় বা রায়গঞ্জ অভয়ারণ্য Kulik Bird Sanctuary।
সেই মাসেরই শেষের দিকের একটি শনি রবি নিয়ে পরিকল্পনা করে ফেললাম। রাধিকাপুর এক্সপ্রেসের টিকিটটা কাটার সাথে সাথেই মন টা উৎফুল্ল হলো আরো একটি কারণে – এই প্রথম আমি ছোঁয়া পেতে চলেছি আমার একেবারে অদেখা একটি জেলার, উত্তর দিনাজপুর। স্বাধীনতার পূর্বে দিনাজপুর ছিল একটিই জেলা। পূর্ব পাকিস্তানের জন্মের পর একাংশ চলে যায় বাংলাদেশে, যা আজ সে দেশে দিনাজপুর নামেই বতর্মান। আমাদের ভাগে যা এলো, তা আবার পরে বিভক্ত হলো দুটি জেলায় – উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর।
২:
শুক্রবার সন্ধ্যায় ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক ৭.৩০ টা নাগাদ কোলকাতা স্টেশন থেকে রাধিকাপুর এক্সপ্রেস ছাড়লো বটে, তবে পরদিন প্রায় ঘন্টা দেড়েক লেট করে রায়গঞ্জ ঢোকালো সকাল ৭.১০ নাগাদ। তাতে অবশ্য মন্দের ভালো। WBTDCL র রায়গঞ্জ ট্যুরিস্ট লজের চেকইন তো সেই ১১ টায়। স্টেশন থেকে বেড়িয়েই একটি চায়ের দোকানে উত্তর দিনাজপুরি চা খেয়ে মনটা সতেজ হলো। মনের সতেজতার সাথে সাথে শরীরটাকেও কিঞ্চিৎ উজ্জীবিত করার প্রয়োজন অনুভব করলাম, পেটে শেষ খাবার ঢুকেছে সেই গতকাল সন্ধ্যাবেলায়। পাশেই একটি দোকানে পেয়ে গেলাম পেটাই পরোটা আর গরম চানা আলুর তরকারি। স্টেশন থেকে কুলিক পাখিরালয় প্রায় ৩ কিমি NH 34 ধরে। পাখিরালয়ের ঠিক উল্টোদিকেই WBTDCL এর লজ। একটি অটো নিয়ে পৌঁছে গেলাম লজে। লজের ম্যানেজার দেবনাথ বাবু বেশ মিশুকে এবং সহানুভূতিশীল। সময়ের অনেক আগে পৌঁছে গেলেও, ওনার বদান্যতায় দোতলার একটি ঝকঝকে তকতকে এবিং কুলিকের দিকে বারান্দা মুখী একটি ঘর পেয়ে গেলাম। চায়ের পেয়ালা হাতে বারান্দায় বসেই মনটা ভরে গেল আনন্দে।
মাত্র কয়েক হাত দূরত্বে সামনের উঁচু গাছটার মাথায় একটি শামুকখোলের বাসা ( Asian Open Bill Stork) আর সেই বাসা আলো করে বসে আছেন তিনি তার দুটো ডানা চওড়া করে মেলে ধরে। সাদা আর কালোর এক অদ্ভুত সুন্দর মেল বন্ধন তার পালকে। লম্বা ঠোঁটের মাঝখানটা একটু ফাঁক মতন। পালকের সাদা রং অবশ্য এখন কিছুটা ধূসর, কারণ প্রজননের পরে তারা এই রং ধারণ করে। বর্ষার শেষের দিকে এই রংই থাকে একেবারে ধবধবে সাদা। যাকে দেখার জন্য এতদূর ছুটে আসা, তার দেখা যে এত অনায়াসেই ঘরে বসেই পেয়ে যাবো তা আমার সত্যি ধারনাতেই ছিল না।
৩:
দেবনাথ বাবুর সাথে শলা পরামর্শ করে ঠিক করে নিলাম আজ সারাদিন অভয়ারণ্যেই পায়ে হেঁটে ঘুরবো এবং আগামীকাল উনি গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবেন আশপাশের কিছু জায়গা ঘুরে বেড়ানোর জন্য। বেলা ১ টার কাছাকাছি লাঞ্চ সেরে বেড়িয়ে পড়লাম কুলিক অভিযানে। রাস্তা টপকে ওপারে অভয়ারণ্যের প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকে ডান দিকে এগোলাম। এই অভয়ারণ্যর আকৃতি ইংরেজি অক্ষরের U এর ন্যায়। ১.৩০ বর্গ কিমি বিস্তৃত। অভয়ারণ্যের দক্ষিণ এবং পূর্ব দিক ঘিরে আছে কুলিক নদী। এছাড়াও অরণ্যের মধ্যের কিছুটা অংশ দিয়ে বয়ে চলেছে কুলিক নদী। বর্ষায় কুলিকের জল এই অরণ্যের অনেক জায়গায় প্রবেশ করে আর তার সাথে জন্ম নেয় শামুক সহ বিভিন্ন প্রকৃতির জীব এবং কীটপতঙ্গ। এই খাদ্য বাসস্থানের লোভেই শামুকখোলের আগমন হয় বর্ষায় এবং কিছুদিন এখানেই সংসার পেতে বাস করে তারা।
৪:
ডান দিকে কিছুটা এগোতেই পেয়ে গেলাম একটি ওয়াচ টাওয়ার। ওপরে উঠে চারপাশে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেলাম এই পাখিদের প্রাচুর্যে। নিচ থেকে আঁচ পাচ্ছিলাম বটে তাদের ডানা ঝটপটানোর দাপটে আর কর্কশ আওয়াজে, তবে এ দৃশ্য কল্পনাও করতে পারিনি। প্রতিটি গাছের মাথা ভরে গেছে শামুকখোলে। একান্নবর্তী পরিবার বিছিয়ে দখল করে নিয়েছেন তারা সারা অরণ্যকে।
দূরের আকাশে চোখ মেলে তাকালে উন্মুক্ত গগনের নীল আঁচলে ঝাঁকে ঝাঁকে তাদের আনাগোনা। এই অরণ্য, এই শহর…আজ যেন শুধুই এই পরিযায়ী পাখিদের। নিচে নেমে গভীরে এগোতেই দেখা হয়ে গেল কুলিক নদীর সাথে, এই ভর দুপুরেও অন্ধকারাচ্ছন্ন এক নীলচে অভায় সে যেন কিঞ্চিৎ নীলাভ।
এই পাশটায় রোদের আলো উঁচু গাছের পাতা ভেদ করে আসতে ততটা সক্ষম নয়। ঝরা পাতা বিছানো আর আলো ছায়া ময় পথ ধরে এগোতে এগোতে এক জায়গায় তীব্র এক গন্ধে থমকে গেলো। আশপাশে চোখ বুলিয়ে কোনো জন্তুর দেখা পেলাম না। হঠাৎ ওপরে চোখ যেতে খেয়াল করলাম দু তিনটি গাছ জুড়ে ঝুলে আছে অজস্র বাদুড়। বুঝলাম গন্ধের হেতু।
কুলিক নদীর কিছু শিরা উপশিরা যা সরু খালের আকার নিয়ে ছড়িয়ে আছে এই অরণ্যে। সেই খালের উত্তর আছে সেতুও। চোখে পড়লো ক্ষুদ্র একটি জলাশয়ও যার জলে ঠোঁট ডুবিয়ে দুটি শামুকখোল তাদের শিকারের খোঁজে ব্যস্ত। চারপাশের অনাবিল সবুজে মজে মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাটিয়ে দিলাম বেশ কয়েকটি ঘন্টা পায়ে পায়ে হেঁটে।
পুরো অভয়ারণ্যটিকে একটি চক্কর লাগিয়ে চলে এলাম প্রবেশদ্বারের কাছে। সামনেই প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র যার ভেতরে ঢুকে পেয়ে গেলাম এই বনানীর বেশ কিছু তথ্য। প্রায় ১৬৪ বিভিন্ন প্রজাতির বাস এই পাখিরালয়ে এবং সারা বছরে প্রায় ৮০,০০০-৯০,০০০ পরিযায়ী পাখিরা এসে বাসা বাঁধে এই অরণ্যে। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের সোনা ঝরা রোদের আলোতে ফিরে এলাম লজে। দিনের শেষ আলোকবিন্দুটি থাকা অবধি ছাদে বসে দেখতে লাগলাম আমাদের অতিথি পরিযায়ী পাখিদের একেক করে বাসায় ফেরা, তাদের আনমনে উড়ে বেড়ানো, তাদের শৃংখলাবদ্ধতা, তাদের খুনসুটি এবং সর্বোপরি তাদের ভালোবাসা।
৬:
পরদিন সকালে ১১ টা নাগাদ কথামত গাড়ি হাজির। সারাদিন ঘুরে আমায় রায়গঞ্জ স্টেশনে ছেড়ে দেবে, ১৪০০ টাকায় রফা হলো। প্রথমে গেলাম ১৯ কিমি দূরে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে বিন্দোল গ্রামে। পথে পেলাম ভৈরবী মন্দির। কথিত আছে অত্যন্ত জাগ্রত এই কালী মন্দির।
দর্শন সেরে দুপাশের সবজি ক্ষেতের বুক চিরে রাস্তাটি দিয়ে অগ্রসর হলাম জিরো পয়েন্টের দিকে। জন বসতি এদিকে বিশেষ চোখে পড়ছে না। কিছুটা এগোতেই বাধা পেলাম সীমা সুরক্ষা বলের এক অফিসারেরে থেকে। ড্রাইভারকে অফিসার চেনেন। তাই অনেক বুঝিয়ে তাঁর থেকে জিরো পয়েন্ট অবধি এগোনোর অনুমতি পেলাম। ভৈরবী মন্দির থেকে এই অবধি পুরো রাস্তায় গ্রামবাসী বলতে চোখে পড়লো শুধুমাত্র বাঁধাকপি ক্ষেতের মাঝে এক চাষিকে এবং জিরো পয়েন্ট এর কাছে এক মহিলাকে মাথায় ঝাক নিয়ে যেতে।
পৃথিবী যেন এখানে একটু অতিরিক্ত মাত্রাতেই নীরব, কিসের যেন এক অজানা ভীতি সকলের মনের গভীরে। সামনে আমার, কাঁটা তারের উঁচু বেড়া। এপারে ভারত, ওপারে বাংলাদেশ। এ এক অদ্ভুত অনুভুতি। খানিক আগেই যে চাষি ভাইকে দেখে এলাম সবজি ক্ষেতে, ঠিক তাঁরই মতো পোশাকে অন্য এক চাষি দৃশ্যমান কিছুটা দুরেই অন্য এক ক্ষেতে । স্পষ্ট দেখছি তাঁর মুখেও সেই একই সরল হাসি। তফাৎ শুধু একটাই, তিনি কাঁটা তারের ওপারে। কর্ম, ভাষা, বাঁচার লড়াই, সুখ দুঃখ… দুটি মানুষেরই একইরকম হয়তো, তবু তাঁরা আজ কত শত শত লাল ফিতেতে বন্ধ সরকারী ফাইলের আদেশে কত সহস্র যোজন দূরে! জিরো পয়েন্ট ছাড়িয়ে কয়েক মিটারের মধ্যেই দেখা পেলাম আত্রেয়ী নদীর। আত্রেয়ী নদীর কাছে আরেকটি চেকপোস্ট। সীমা সুরক্ষা বলের এক জওয়ান ততক্ষণে তাগাদা দিতে শুরু করেছে। আর বেশিক্ষণ থাকাটা শ্রেয় নয়। এইবার রওনা দিলাম বাহিন রাজবাড়ির পথে।
৭:
বাহিন রাজবাড়ি কুলিক থেকে ১৭ কিমি দূরে আর থেকে ৩৬ কিমি। উত্তর দিনাজপুরের গ্রাম্য জীবনের মিষ্টতার ছোঁয়া পেলাম এই রাস্তার দুপাশে। কোথাও বা মাইলের পর মাইল ধানক্ষেত, কোথাও বা ছোট ছোট মাটির বাড়ি আবার কোথাও বা দিগন্ত ব্যাপী বিভিন্ন সবজির চাষ। ড্রাইভার সাহেবকে জিজ্ঞেস করে জানলাম উত্তর দিনাজপুরের এই অঞ্চলে এক প্রকার সুগন্ধি চাল, বেগুন বিচি উৎপাদন হয়। নদীর তীরে জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরীর জমিদার বাড়িই হল এই বাহিন রাজবাড়ি, যা আজ প্রায় এক ধ্বংসস্তূপ।
বাড়িটির চারপাশ ঘিরে সবুজের প্রাচুর্য্য আর এক গ্রাম্য পরিবেশ অবধারিত ভাবেই মনটাকে নিয়ে চলে যায় কয়েক শত বর্ষ আগের প্রাচীন প্রেক্ষাপটে। নাগর নদীর ওপারেই বিহার রাজ্য। স্তব্ধ হয়ে গেলাম রাজবাড়ির সম্মুখভাগে পৌঁছে। একদা সাবেকিয়ানার ঠাটবাটে মোড়া রাজবাড়ির কঙ্কালসার কাঠামোটি আজও বর্তমান। আষ্টেপৃষ্ঠে গ্রাস করেছে বাড়িটিকে জংলী আগাছা , ডাল পালা আর লতা পাতা। দোতলার বেশ কয়েকটি ঘরের মেঝে বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। অবশিষ্ট সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতেই একটি স্যাঁতস্যাঁতে ভাব টের পেলাম। দিনের আলোতেও ভেতর টা যেন অন্ধকারময়। ছাদের করি বর্গা গুলো যেন উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে হাজার না বলা কথা ব্যক্ত করতে।
বাড়ির একেবারে সামনে দিয়েই নাগর নদী বয়ে চলেছে, বাঁধানো ঘাট নেমে গেছে সোজা নদীতে।কথিত আছে জমিদারেরা এই নদী পথই ব্যবহার করতেন ব্যবসা বাণিজ্যের বিভিন্ন পণ্য পরিবহনের জন্য। নদীর ঘাট থেকে রাজবাড়ির রাজকীয়তা টের পাওয়া যায় আজও।
৮:
পরবর্তী গন্তব্য দুর্গাপুর রাজবাড়ি, প্রায় ২৫ কিমি রাস্তা। এই বংশের পূর্বপুরুষ ঘনশ্যাম কুণ্ডু বাংলাদেশের যশোর থেকে এসে আকবরের রাজসভায় চাকরি নেন। পরবর্তীকালে বাংলা, বিহার, ওড়িশার বিরাট অংশে জমিদারি স্থাপন করেন। রাজবাড়ির পাশেই দূর্গা দালান। বিগত প্রায় ৪০০ বছর ধরে দূর্গা পূজো হয়ে আসছে এই বাড়িতে।
দূর্গা দালান দর্শন সেরে গাড়ি নিয়ে এগোলাম বুরহানা ফকির মসজিদের দিকে। ১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষের ঠিক পরপর বাংলার এই অঞ্চলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং তৎকালীন জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে। দেবী চৌধীরানী, ভবানী পাঠক, বুরহানা ফকির এবং আরো অনেকের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ শুরু হয়। এই বুরহানা ফকিরের নামেই এই মসজিদ। লম্বা একচালা এই মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে অজস্র থামের ওপর। ওপরে একটিমাত্র সোনালী রঙের গম্বুজ।
বেলা গড়িয়ে প্রায় ৪.৩০। উত্তর দিনাজপুরকে এবারকার মতো বিদায় জানানোর সময় উপস্থিত। গাড়ি বাড়ালাম রায়গঞ্জ স্টেশনের পথে। ফিরতি রাধিকাপুর এক্সপ্রেস সন্ধ্যা ৬.২১ এ ছেড়ে রওনা দিলো কোলকাতার পথে।
©Arijit Kar
Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.