১:
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের সকালের হাল্কা শীতে 70-80 km বেগে নিজে হাতে গাড়ি টা চালাতে বেশ লাগছিলো। ঘটকপুকুর ছাড়ানোর পরেই রাস্তার দুপাশে সবুজের সীমাহীন গালিচা গাড়ির বিপরীতে ছুটে চলেছে বিদ্যুৎ গতিতে। অনেকদিন ধরেই এই বাসন্তী হাইওয়ে তে গাড়ি ছোটানোর লোভ টা ছিল। অবশেষে সুযোগ পেলাম ২০১৬ র ১০ই ডিসেম্বর। ৯৭ কিমি ড্রাইভ করে পৌঁছবো ঝড়খালী। প্রায় ৩ ঘন্টার রাস্তা তাই সকাল ৭.৩০ টায় বেরিয়ে পড়েছিলাম। বোদরার কাছাকাছি একটা জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে চা খেলাম। দূরে কিছু ইটভাটা চোখে পড়ছিল। চায়ের দোকানে এক প্রবীণ বললেন প্রচুর ইটভাটা পাবো এই রাস্তায়। তাই ঠিক করলাম ইটভাটার ভেতরে ফেরার দিনই ঢুকবো। আবার পথ চলা শুরু। আশপাশের ছবিগুলো পাল্টাতে শুরু করেছে। মাইলের পর মাইল বিস্তৃত মাছের ভেরি একেকটা। তার ফাঁকে ফাঁকে বেশ কিছু ইটভাটা। ভেরি এর আগেও দেখেছি অনেক। তবে এখানকার মতো একদম হাইওয়ের গায়ে লাগোয়া দিগন্ত বিস্তৃত ভেরি একের পর এক খুব কম দেখেছি। সোনাখালী ফেরিঘাটের আগে বাসন্তী হাইওয়ের প্রায় ৪ কিমি রাস্তা নতুন করে বানানো হচ্ছে তখন, তাই বেশ খারাপ রাস্তা এইটুকুনি। অনেকটাই স্লো ডাউন করে দিলো আমায়। যাইহোক পৌঁছে গেলাম হোগল সেতু, হোগল নদীর ওপরে । এখন থেকে সুন্দরবনের বিভিন্ন জায়গার লঞ্চ যায়। সোনাখালী থেকে এখনো আমায় ২৫ কিমি যেতে হবে। আর কোথাও না দাঁড়িয়ে এগোতে থাকলাম। বাসন্তী ঝড়খালী রোড ধরার পর গ্রামের মধ্যে দিয়ে রাস্তা টা খুব সুন্দর।
ঝড়খালী পৌঁছনোর শেষ ৫-৬ কিমি রাস্তা বেশ রোমহর্ষক। খুব সরু রাস্তা আর অজস্র হেয়ার পিন বাঁক। অবশেষে ১০.৩০ টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম মা লক্ষ্মী লজে। মালিক নিজেই উপস্থিত ছিলেন। অমায়িক ব্যবহার। ঘরগুলো আয়তনে ছোট হলেও খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এবং আতিথেয়তায় ভরিয়ে দিলেন মালিক।
২:
খেতে খেতে মোহন দার মুখে বেশ কিছু গল্প শুনলাম। তার মধ্যে কিছু তথ্য পরে বেশ কাজে লেগেছিল। দিন পনেরো আগেই নাকি হেরোভাঙ্গা নদীর খুব কাছের একটা খাঁড়ি তে বাঘ দেখা গেছে। এখানে বলে রাখি, ঝড়খালী কে বলা যেতে পারে সুন্দরবনের একটি এন্ট্রি পয়েন্ট। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এর দেখা মেলে ঝড়খালী ঢুকেই। সুন্দরবনের বিভিন্ন জায়গায় যাবার জন্য লঞ্চ ভাড়া পাওয়া যায় এই হেরোভাঙ্গা নদীর পার থেকে। বড় লঞ্চ নিয়ে আপনি অনায়াসেই চলে যেতে পারেন নেতিধোপানি ঘাট, বনি ক্যাম্প, কলস ক্যাম্প, সুধন্নখালি এবং সজনেখালী। ডিসেম্বর হলেও, রোদের তাপ যথেষ্ট প্রখর এই এলাকায়। তাই একটু বেলা গড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম হেরোভাঙ্গার উদ্দেশ্যে।
৩:
গাড়ি নিয়ে নদীর পার যাওয়া যায় না, প্রায় ২ কিমি আগে একটা বাঁকের পাশে মাঠে গাড়ি পার্ক করে দিতে হয়। তাই গাড়ি লজে মোহন দার জিম্মায় রেখেই গেছিলাম। মোটর ভ্যান ( ভ্যানো বলা হয় এগুলোকে) গুলো একদম নদী পার অব্দি পৌঁছে যায়। উঠে পড়লাম এরকমই একটাতে। নেমে মোহন দার কথামত পারের দিকের একদম প্রথম চায়ের দোকানে গিয়ে অলোক মিস্ত্রির ( 9564130865 / 9564722798 ) খোঁজ করতেই পেয়ে গেলাম। ওনাদের নিজস্ব নৌকো এবং লঞ্চ আছে। ট্যুর অপারেটিং মূল ব্যবসা। অলোক বাবুর সাথে কথা বলে বুঝলাম ওনারা তো আর শেয়ার সিস্টেম এ চালান না। নিলে পুরো নৌকো বা লঞ্চ ই ভাড়া করতে হবে। নৌকাতে জনা দশেক লোক নেওয়া হয় আর লঞ্চ এ ২৫ থেকে ৩০। আমার একার জন্য নৌকো পাওয়াই তো মুস্কিল। মোহন দার রেফারেন্স আর অনেক অনুরোধ করাতে শেষমেষ উনি রাজি হলেন একটা ছোট নাম দিতে। কথা হলো ঘন্টা খানেক ঘুরবো আর ৫০০ টি টাকা দেবো। তবে নৌকোটি সফরে গেছে, আধা ঘন্টা লাগবে ঘাটে আসতে। হেরোভাঙ্গা নদীর পারে আসার মুখেই বাঁ হাতে পরে Tiger Rescue Center. আধ ঘন্টার সময় কাটানোর জন্য ঢুকে পড়লাম এই সেন্টার এ। ঘাট থেকে Rescue Center এর গেট অব্দি দুধারে পরপর রঙবেরঙের দোকান। তার কোনোটায় পুতুল, কোনোটায় ঘর সাজানোর সরঞ্জাম। তবে একটা জিনিসের অনেক দোকান খেয়াল করলাম। মধু। প্লাষ্টিক বা কাঁচের অবয়বে করে বিক্রি করা হচ্ছে। একেকটার আবার একেকরকম রং। মনে পরে গেল অলোক বাবুর কথা। মধু যে ফুল থেকে আসে তা বিভিন্ন season এর। আর একেক season এর ফুলের মধুর একেক রকম স্বাদ। Tiger Rescue Center এর গেট দিয়ে ঢুকেই দেখলাম অনেকটা জায়গা জুড়ে ফেন্সিং। আহত বাঘ বা শুশ্রুষা প্রার্থী বাঘেদের এখানে এনে রাখা হয়। শুশ্রূষার পর আবার তাদের সুন্দরবনের গভীরে ছেড়ে দেওয়া হয়। ফেন্সিং থাকলেও এটা কিন্তু চিড়িয়াখানার মতো নয়। বাঘেদের রাখার যথেষ্ঠ সুব্যবস্থা। এমনকি পেছনের দিকে অনেকটা মূল জঙ্গল অব্দি ছড়ানো, যদিও সেখানেও একটা ফেন্সিং আছে। ফেন্সিং এর ভেতর বেশ বড় একটি ঘর আছে। সেই ঘরে ঢোকার জন্য ১০-১২ টা বেশ চওড়া সিঁড়ি। কিছুক্ষণ ফেন্সিং এ দাঁড়াতেই দেখি ধীর স্থির পদক্ষেপে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। এবং একটি একটি করে ধাপ বেয়ে সিঁড়ি দিয়ে তাঁর নিচে নেমে আসা। প্রথম ঝলকেই বোঝা যায় Royal Bengal Tiger নামটির সার্থকতা। কি রাজকীয় সেই চলন। দেখে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই যে বাঘটি অসুস্থ। আর একটা কথা। চিড়িয়াখানায় বন্দী বাঘের সাথে এটির কিন্তু কোনো মিল নেই। সমস্ত শরীর থেকে যেন তেজ ঠিকরে বেরোচ্ছে। Rescue Center এ রাখা হলেও, তার রাজকীয়তা এক ফোটাও কমেনি। যেমন তার সৌন্দর্য, তেমন তার গর্জন। ব্যাঘ্র দর্শন করে ফিরে এলাম সেই আলোক বাবুর চায়ের দোকানে। তখনও আমার নৌকো আসেনি তাই আরও কিছু গল্প শুনতে লাগলাম অলোক বাবুর থেকে। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে বাঘের গর্জন ও কানে এলো….জঙ্গলের নয়, রেসকিউ সেন্টারের।
৪:
কিছুক্ষনের মধ্যেই একটি অল্প বয়স্ক ছেলে এল। অলোক বাবুর ইঙ্গিতে বুঝলাম এই ছেলেটিই আমার নৌকোর মাঝি। আলোক বাবু ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন ছেলেটিকে কোন কোন খাঁড়ি দিয়ে যেতে হবে যাতে ওয়াইল্ড লাইফ দেখার সম্ভাবনা থাকে। উনি অবশ্য আগে আমাকে কয়েকটা জিনিস বলেছিলেন আর তাতে বুঝেছিলাম আমার ওই সময় ওয়াইল্ড লাইফ দেখার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। জোয়ার ভাঁটার একটা বড় ভূমিকা আছে। সাধারণত জোয়ার শেষ হবার ঠিক পরে যখন নদীর জল আস্তে আস্তে নামতে থাকে সেই সময় কুমির দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশ প্রখর। জোয়ারের জল সরে যেতে কুমির রা খাঁড়ির পাশের ম্যানগ্রোভ গুলো তে গা শুকায়। আমি যে সময় নৌকায় উঠছি, তখন ভাঁটা পরে গেছে অনেক্ষন। তাই কুমির দেখার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যাইহোক, ছেলেটির সর্ষে পা বাড়ালাম ঘাটের দিকে। ঘাটের ঠিক মুখটায় জেটি। জেটির দুপাশে কিছু নৌকো সারি দিয়ে বাধা।
জেটির মুখ থেকে ডান দিকে তাকিয়েই দেখালাম বাঁশ আর দড়মা দিয়ে করা ছোট্ট এক মন্দির। কাছে গিয়ে উকিঁ দিতে দেখলাম এটা বনবিবির মন্দির। গোটা সুন্দরবনে বনবিবি কে সবাই খুব মানে। মধু সংগ্রহ করতে যাওয়া…মাছ ধরতে যাওয়া…অথবা নিছক টুরিস্ট নিয়ে নদী পথে ভ্ৰমণ, যাওয়ার আগে বনবিবির আশীর্বাদ সবাই নেবেই একবার। মনে মনে শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে এলাম জেটিতে। ছেলেটি দেখলাম নৌকায় দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষা করছে। খুব ছোট নয় আমার নৌকোটি। একরাশ উত্তেজনা দানা পাকাচ্ছে মনের ভেতর। এক অজানার খোঁজে ভেসে বেড়ানোর সময় এসে গেছে। উঠে পড়লাম নৌকায়। এখানে একটা কথা বলে রাখি আমার ব্যাপারে। জঙ্গল মানে আমার কাছে শুধুই ওয়াইল্ড লাইফ দেখতে পাওয়া নয়। যেকোনো অরণ্যের একটা নিজের ভাষা আছে। নিজের গন্ধ আছে। নিজের হাওয়া আছে। নিজের সবুজ আছে। নিজের আলো আছে। নিজের অন্ধকার আছে। আর সর্বোপরি নিজের একটা রহস্য আছে প্রতিটি পদক্ষেপে। অরণ্যের এই নিজস্বতা গুলো আমার বড় প্রিয়। তাই ওয়াইল্ড লাইফ দেখা বা না দেখা টা আমার কাছে অতটা গুরুত্ব পায় না। এগিয়ে চললো আমার নৌকো মাঝ নদীতে। চোখে পড়লো কিছু লঞ্চ আর কিছু নৌকো। বেশিরভাগ গুলোই তখন ফেরত আসছে। প্রত্যেকটিতেই লোক বোঝাই। তাদের যা কোলাহল আর যা তাদের নাচানাচি, তা দেখে মনে হলো এনারা কি সুন্দরবন দেখতে এসেছেন নাকি সুন্দরগ্রামে পিকনিক এ গেছেন!! ভাগ্যিস এমন সময়ে বেড়িয়েছি যখন ওয়াইল্ড লাইফ দেখার সম্ভাবনা কম। নাহলে ঠিক সময় এসেও এদের জ্বালায় বাঘ কুমির তো দূরে থাক…একটি পাখির ও টিকি পেতাম না। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার নৌকোটি একটি খাঁড়ির ভেতর ঢুকলো।
অদ্ভুত সুন্দর একেকটি খাঁড়ি। হেরোভাঙ্গার বিশাল জলরাশি থেকে যেন সম্পূর্ণ আলাদা একটি রাজ্য!! সূর্য তখন দিগন্তের পথে। আকাশে লালের আধিপত্য।
ঘাট থেকে মাঝ নদী অব্দি নৌকোটি মোটর এই এসেছে। তবে খাঁড়ি তে ঢোকার আগে আমি মোটর বন্ধ করিয়ে দিয়েছি। নৌকোর এক সীমান্তে আমার মাঝি ভাই বৈঠা হাতে, অন্য সীমান্তে আমি ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডার এ চোখ লাগিয়ে কি যেন খুঁজে চলেছি। আমার দুপাশে শুধু ম্যানগ্রোভ আর ম্যানগ্রোভ।
জল নেমে যাওয়াতে কোনো জায়গার চোখে পড়ছে মানগ্রোভের ধারালো কঠিন শিখর গুলো। হাঁটতে গেলেই পা ক্ষতবিক্ষত হওয়ার সম্ভাবনা। আলো আরো ক্ষীণ হয়ে আসছে। Common kingfisher, blue throated kingfisher, pied kingfisher….এসবই চোখে পড়লো। আরো কতরকমের নাম না জানা পাখির বাসায় ফেরা দেখতে দেখতে, এক খাঁড়ি থেকে আরেক খাঁড়ি ভেসে চললাম অতি সন্তর্পনে। খাঁড়ির দুপাশের মানগ্রোভের ছায়া এসে পড়েছে নিটোল জলে। রক্তিম আভায় কোনো এক শিল্পী যেন নিপুন হাতে এঁকে চলেছে নদীর বুকে এই অরণ্যের প্রতিচ্ছবি।
আমাদের সুন্দরী সুন্দরবন। মোহময়ী সুন্দরবন। গোধূলির আলোয় সে এক মায়াপুরী যেন। কিছুতেই ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু কথা তো রাখতে হবেই। তাই ধীরে ধীরে পারি দিলাম ঘাটের দিকে। ঘাটে এসে যখন নামলাম তখন অনেকটাই অন্ধকার হয়ে এসেছে। ছবির ভাষায় একে বলে blue hour.
হেরোভাঙ্গার বুকে তখন ইতি উতি ভেসে রয়েছে কোথাও নৌকো, কোথাও বা লঞ্চ। সবকটিই ঘটে নোঙ্গর করা। একদুটি লঞ্চ এ দেখলাম টিম টিম করে আলোও জ্বলছে। যদিও tripod আনিনি, তবুও এক দুটো long exposure নেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না সেই মায়াবী আলোয় হেরোভাঙ্গা কে লেন্স এ ধরে রাখার।
৫:
লজে ফিরে মোহন দার সাথে ঘোরার গল্প করলাম। ভালোবেসে ফেললাম ঝড়খালী কে, হেরোভাঙ্গা কে। সুন্দরবনের গভীরে ঢোকার আকর্ষণ যেন আরো বেড়ে গেল। নাই বা দেখলাম কুমির, নাই বা দেখলাম বাঘ। কিন্তু যা দেখলাম তাতো সুন্দরবনের এই প্রবেশদ্বারের প্রতি আমাদের আকর্ষণ আরো বাড়িয়ে দিলো। সুন্দরবনের সেই আদিম জংলী প্রলোভন বুকে নিয়েই পরের দিন ফেরার পথে রওনা দিলাম ক্যানিং হয়ে। পথে একটি ইটভাটায় দাঁড়ালাম।
ভেতরে প্রবেশ করে বেশ কিছু ছবিও নিলাম। দেখলাম একেকটি পরিবার যেন এখানে হাতে হাত দিয়ে …. কঠোর পরিশ্রমে… গড়ে চলেছে দেশের ভবিষ্যৎ ( থুড়ি। ওটা “ইঁট” পড়ুন)।
© Arijit Kar
Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.