পালামৌ ভ্রমণ বৃত্তান্ত
১:
“স্যার, আপ লোগ মেইন গেট কা তরফ আইয়ে। হাম ওয়াহী পে ওয়েট কর রাহা হু।” – রাঁচি স্টেশনে নেমেই ড্রাইভার অনিলের ফোন। অবশ্য তখনও অবধি আমরা জানি লোকটির নাম সুনীল। কোলকাতা থেকেই কথা বলে ওনার টাটা সুমোটি বুক করেছিলাম। মেইন গেটের দিকে এগিয়ে দূরভাষ যন্ত্র কানে গুঁজে এলোপাথাড়ি হাত নাড়াতেই দেখি ১০ হাত দূরে দাঁড়ানো ছিপছিপে এক যুবক প্রত্যুত্তরে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে হাত নাড়াতে নাড়াতে।
হোয়াটসআপের ডিপির ছবিটির সাথে জলজ্যান্ত মানুষটার মুখের মিল না পেয়ে কৌশিক হেঁড়ে গলায় বলেই ফেললো – “আপ কৌন হো? আপ তো সুনীল নেহি হো।” স্মিত হেসে অনিল বোঝালো আমরা এতদিন তার দাদা সুনীলের সাথেই কথা বলেছি এবং ছবিটি সুনীলের। দুই ভাই একসাথেই এই ট্যুরিজম ব্যবসায় বহু বছর ধরে আছে। পুনরায় আমরা সুনীলকে ফোন করে আস্বস্ত হয়ে তার সাথে পার্কিং চত্বরের দিকে এগোলাম। গাড়িতে উঠতে গিয়ে ঠাওর হলো মালপত্র সমেত ৭ জনটা সুমোর ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে।
২:
অবশ্য আগামী তিনটে দিন পালামৌয়ের অরণ্যে বনবাসের আনন্দে আমাদের সাতটি প্রাণ এখন এতটাই আত্মহারা যে গাড়ি নিয়ে চর্চা করার অভিপ্রায় কারও নেই। নির্ধারিত সময়ের প্রায় সোয়া এক ঘন্টা পরে আমরা রাঁচি ঢুকেছি। সকাল গড়িয়ে এখন ৯টা ছুঁই ছুঁই।স্নেহাংশু, লীনা, বিদিশা, কৌশিক, শুভজিত, বিশ্বরূপ এবং আমি – সকলেরই পেটে ছুঁচোর ডন। গতকাল রাত্রের ১০.১০ এর ক্রিয়া যোগা এক্সপ্রেস আমাদের নিয়ে হাওড়া ছেড়েছিল প্রায় দেড় ঘন্টা দেরিতে। সঙ্গে আনা তর্কা রুটি ট্রেনে ওঠার আগেই সাফ করে দিয়েছিলাম।
হাইওয়ে তে কোথাও একটা ব্রেকফাস্ট করে নেবো এইটা অনিলের কানে ঢুকিয়ে রওনা দিলাম নেতারহাটের পথে। অনিল এবং তার গাড়ি আগামী তিন দিনের জন্য আমাদের ঘুরণচন্ডি দলের সদস্য তাই ওর সাথে আলাপচারিতা সারতে সারতে আমরা এগোলাম। অনিল ছেলেটি এমনিতেই একটু কম কথা বলে, তারওপর আমাদের সাত জনের বাংলা ভাষায় হরেকরকম শব্দকোষ! “স্যার, আপ লোগ সারে একহি জাগা সে আয়ে হো?” – অনেক্ষন আমাদের কলকাকলি শোনার পর ক্ষীণ গলায় অনিলের প্রশ্ন। “হাঁ। হামলোগ সারে একহি জাগা সে হুঁ। পিছলে হপ্তেহি রাঁচি মেন্টাল হসপিটাল সে ছুটকারা মিলা থা হামলোগোকো !” – লীনার গম্ভীর এবং “টু দা পয়েন্ট” উত্তর। এতক্ষনে অনিলের সবকটি দাঁত একসাথে দেখতে পেলাম আমরা। অট্টহাসির রোলের সাথে এগিয়ে চললো গাড়ি।
৩:
মাঝে সিঙ্গারা আর মিষ্টি দিয়ে জলখাবার সেরে রাঁচি শহরের আধুনিক সভ্যতাকে পেছনে ফেলে রেখে হাইওয়ে ধরে হু হু করে ছুটে চলেছি। রাঁচি থেকে নেতারহাট প্রায় ৪.৩০ ঘন্টার রাস্তা। নেতারহাট থেকে মহুয়াডার আরো ১.১৫ ঘন্টা। আজকের রাত্রিবাস আমাদের মহুয়াডারে। পরিকল্পনাটা এরকম, নেতারহাটে সূর্যাস্ত হওয়ার আগেই দিনের আলো থাকতে থাকতে আমাদের পাড়ি দিতে হবে মহুয়াডারের পথে কারণ পালামৌয়ের রাস্তায় সাধারণত কোনো ড্রাইভার সূর্যাস্তের পর গাড়ি চালাতে রাজি হয় না।
এখানে পালামৌ নিয়ে কিছু কথা বলে রাখা দরকার। ১১২৯.৯3 বর্গ কিমি জুড়ে ছেয়ে আছে এই পালামৌ অরণ্য। এর মধ্যে ৪১৪.৯৩ বর্গ কিমি পরে কোর এরিয়াতে, এবং ৬৫০ বর্গ কিমি বাফার জোনে। ঝাড়খণ্ডের লাতেহার জিলার অন্তর্ভুক্ত এই সুবিশাল বনাঞ্চল ১৯৭৩ সালে পালামৌ টাইগার রিসার্ভ হিসেবে আখ্যা পায়। বনাঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু গ্রাম, বন্যপ্রাণী সম্পদ এবং কিছু নক্সাল পকেট নিয়ে চির রহস্যময় এই পালামৌ।
৪:
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নেতারহাটের যা উচ্চতা তা প্রায় কালিম্পঙ শহরের কাছাকাছি। বেলা গড়িয়ে যখন প্রায় ১.৩০, সমতল ছেড়ে গাড়ি পাহাড়ি রাস্তা ধরলো। সরু পাকদন্ডী রাস্তা দিয়ে উঠতে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো এ তো আমাদের উত্তরবঙ্গ। একপাশে পাহাড়ি দেওয়াল আর অন্যদিকে অতল খাদ যেখান দিয়ে উকিঁ দিলেই বুঝি দেখা পাবো তিস্তার। তিস্তাকে না পেলেও কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখা হলো কোয়েলের সাথে।
বিলাতে ঘুরতে গিয়ে কোলকাতার বাঙালিরা ভিনদেশী কোনো বাঙালির দেখা পেলে যেমন আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি দেখি এক বাঙালি পরিবার গাড়ি থামিয়ে কলা খেতে খেতে কোয়েল কে তিস্তার গোত্রে ফেলে বেশ উপভোগ করছে। অনিল আশ্বাস দিলো কোয়েলের সাথে এরপর থেকে বহুবার আমাদের দেখা হবে, তাই এখানে আর সময় নষ্ট না করে এগিয়ে চললাম।
মুখে চোখে শীতল হাওয়ার স্পর্শ, সরু পাকদন্ডী রাস্তা, হেয়ার পিন বেন্ড, সবুজে ঢাকা পাহাড় আর কোয়েলকে পথের সঙ্গী হিসেবে পাওয়া…এসব যেন সত্যিই ভীষণভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছে সেবক ছাড়িয়ে সেই পাহাড়ী রাস্তা। সেই ভাবনার ষোলো কলা পূর্ণ করে দিলো পাহাড়ের ধারের রেলিংয়ে বসে থাকা বানর পরিবার।
৫:
কিছুক্ষণ আগে আসার পথে চোখে পড়লো একটি রাস্তা বাঁ দিকে চলে গেছে, কংক্রিটের স্তবকে সেদিকের দিক নির্দেশ- “মহুয়াডার”। অতএব নেতারহাট ঘুরে আমাদের এই রাস্তাই ধরতে হবে। এতটা পথ অতিক্রম করে এলাম। বেশ কিছু জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছবি তোলার ইচ্ছে থাকলেও লোভটাকে সংবরণ করে আসছিলাম এতক্ষন সময়াভাবে। কোয়েলকে এক ঝলক দেখে কিছুটা ওঠার পর দুপাশের আলো আঁধারিতে ঘেরা পাহাড়ী বনানীর হাতছানি আর উপেক্ষা করতে পারলাম না। গাড়ি দাঁড় করালাম। পড়ন্ত বেলার সূর্য উঁচু উঁচু গাছগুলোর ফাঁক থেকে উকিঁ মেরে এক নরম মখমলি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে অরণ্যে। নেতারহাট তার পাহাড়ী সৌন্দর্য একটু একটু করে আমাদের সামনে উন্মোচিত করছে।
৬:
একটি বাঁক নিয়ে পিচ রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তা ধরলো অনিল। কিছুটা যেতেই কয়েক হাত দূরত্বে নেতারহাট লেক। গাড়ি থেকেই তার দর্শন সেরে ছুট লাগালাম কোয়েল ভিউ পয়েন্টের পথে। হাঁটু সমান উঁচু হলদেটে ঘাসে ভরা একটি মাঠের ওপরে এসে গাড়ি থামলো। আদিবাসী কিছু মহিলা সেই ঘাস কেটে সংগ্রহ করতে ব্যস্ত। তাঁদের কারো পিঠে কাপড় দিয়ে বাঁধা তাঁদের কোলের বাচ্ছা। সেদিকে কয়েক পা এগিয়ে টের পেলাম বাচ্ছা শুধু পিঠে নয়, কয়েকটি কচিকাঁচা উঁচু ঘাসের আড়ালে দিব্যি আপনমনে খেলে বেড়াচ্ছে। ভালো করে না দেখলে এদের চোখেও পড়বে না।
মাঠটির বাঁ হাতে ঘন সবুজ পাইনের জঙ্গল। সামনে কিছুটা গিয়ে গভীর খাদ। অনেকটা নিচে কোয়েলের অস্তিত্বের প্রমান পেলাম বটে তবে সে অতি ক্ষীণ রেখা। পাইনের বনে কয়েকটি ফ্রেম ক্যামেরা বন্দী করে গাড়ি ঘুরিয়ে উঁচু নিচু মেঠো রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম আপার ঘাঘড়ি ফলস। মাটি আর পাথর মিশ্রিত সরু একফালি রাস্তা ধাপে ধাপে নেমে গেছে ফলস অবধি। জলধারাটি অতি প্রবল না হলেও, চারপাশের পাহাড়ের দেওয়ালে ঘেরা ঘাঘড়ি পড়ন্ত বেলার ক্ষীণ আলোতে বেশ মোহময়ী।
ঘাঘড়ি থেকে উঠে দেখি বিকেল পাঁচটা বাজতে আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। আকাশে সোনালী রঙের শেষ আভাটা প্রায় নিভু নিভু। অর্থাৎ এখনই আমাদের গাড়ি নিয়ে ছুটতে হবে মহুয়াডারের পথে অন্ধকার নামার আগে। আমাদের করুন মুখগুলো দেখেই হোক বা আমাদের উৎসাহ উদ্দীপনার পরশ পাথরের ছোঁয়াতেই হোক, অনিল হঠাৎ বলে বসলো – “ম্যাগনলিয়া সানসেট পয়েন্ট নেহি দেখোগে স্যার?” প্রশ্নটা অনেকটা বিড়ালকে মাছ খাবে কিনা জিজ্ঞেস করার মতো। কাল বিলম্ব না করে সদলবলে গাড়ি এসে থামলো ম্যাগনলিয়া পয়েন্টে। সঙ্গে অনিলের সাবধানবাণী – “সানসেট হোনেকে বাদ এক মিনিট ভি রাহিয়েগা মত। তুরন্ত ওয়াপাস আইয়েগা।”
৭:
সানসেট পয়েন্টের রেলিংয়ে ধারের উপচে পড়া ভিড় আর তাঁদের নিষ্পলক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থাকা দেখে মনে হলো মেলোড্রামার শেষ অধ্যায় টা দেখতে উৎসুক জনতা প্রায় হুমড়ি খেয়ে স্টেজের ওপর চলে এসেছে। বিভিন্ন স্থির চিত্রে এবং অস্থির চিত্রে দেখা ম্যাগনলিয়া পয়েন্টের সেই বিখ্যাত নেড়া গাছটির সাথে সেল্ফি তুলতে ব্যস্ত অনেকেই। আমাদের দলের সকলেই তখন ছন্নছাড়া। যে যার মতো জায়গা বেছে নিয়ে আবীর রাঙা চিত্রপটে পাহাড় সারির মাঝে নায়কের শেষ অন্তর্ধানটি ক্যামেরা বন্দী করতে ব্যস্ত। ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা অতিক্রম করে গেছে, অর্থাৎ যবনিকা পতনের আর বেশি দেরী নেই। একটু দূরে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে কিছু ছবি নিয়ে আমিও আমিও প্রত্যক্ষ করলাম রঙ্গমঞ্চের সেই শেষ দৃশ্য।
৮:
রঙ্গমঞ্চে যবনিকা পতনের পর দুটো জিনিস মাথায় এলো। প্রথমত আর মিনিট পনেরোর মধ্যে দিনের আলোর শেষ রেখাটিও বিলীন হয়ে যাবে, অতএব অনিলকে সন্তুষ্ট করতে এখুনি গাড়ির দিকে ছুটতে হবে। আর দ্বিতীয়ত দ্বিপ্রাহরিক আহার বলতে কারো পেটেই কিছু পড়েনি। হাতের কাছে ডিম সেদ্ধ পেয়ে প্রায় গোটা ৩০ ডিম আর সদ্য ভাজা কিছু পাকোড়া নিয়ে গাড়িতে ফিরে এলাম। অনিলের মুখে কোনো কথা নেই। শুধু গাড়ি স্টার্ট করে বললো “কাফি দের কর দিয়ে।” মহুয়াডারের রাস্তা যখন ধরলাম, দুপাশের জঙ্গল অন্ধকারে মিশে একাকার।
গাড়ির জোরালো হেড লাইট সেই অন্ধকার চিরে গোঁ গোঁ করে ছুটে চলেছে। মিনিট ১০ গাড়ি চলেছে… শুভজিত বসেছে সামনে, বলে উঠলো “দাদা তোমার ডান দিকে তাকিয়ে দেখো।” জানালার পাশ দিয়ে কখনো ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে রণপা লাগানো ছায়ামূর্তির মতো উঁচু উঁচু গাছ। আবার কখনো অন্ধকারের কম্বলে মোড়া শায়িত উঁচু নিচু মালভূমি যেন গাড়ি দেখে পাশ ফিরে হাঁ করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। মুখ ঘুরিয়ে দেখি সূর্যের আকারের রক্তিম এক থালা কখন জানি লম্বা ছায়ামূর্তি গুলোকে ছাড়িয়ে পূবের আকাশ থেকে আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।
কোন অভয়ারণ্যে নাইট সাফারির থেকে এ রাস্তা কোনো অংশে কম নয়। পূর্ণিমার চাঁদের এমন অরণ্য মানানসই রূপ খুব কমই চোখে পড়ে। জ্যোৎস্না স্নাত অরণ্য এবং তার চার পায়ী ও দু পায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে অনিলকে খান কয়েক প্রশ্ন করতে গিয়ে বেশ ধমক খেলো শুভজিত তার থেকে। “রাত কো পেহলি বার ইস রাস্তে সে হাম যা রাহা হেই। কভি ভি উত্ত লোগ আকে গাড়ি রোক সকতে হেই।
প্লিস মুঝে ডিসটার্ব মত কিজিয়ে।” – অনিলের এই সাবধান বাণীতে গাড়ির ভেতর যেন এক অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা নেমে এলো। হঠাৎ খেয়াল হলো আমরা প্রায় ২৫ মিনিট যাত্রা করেছি অথচ আমাদের গাড়ির সামনে বা পেছনে একটিও গাড়ির আলো দেখতে পাইনি। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা হলেও গাড়ির ভেতরে কয়েক জনের কপালে মনে হলো বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছি। রাতের অরণ্য যেন বাক শক্তি ছিনিয়ে নিয়েছে আমাদের সকলের থেকে! সকলেই আপনমনে শুধু প্রহর গুনছি মহুয়াডার পৌঁছানোর। অবশেষে আরো মিনিট ২০ চলার পর অবসান হলো আমাদের এই রুদ্ধশ্বাস নৈশ্য অভিযানের।অদূরে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা হলদেটে আলো দেখে বুঝলাম মহুয়াডার ঢুকছি আমরা।
৯:
“হোটেল কৌনসা হেই অপলোগো কা?” – অনিলের গলা এখন অনেকটাই নরম। বুঝলাম বিপদ কেটে গেছে। স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেললাম বটে সকলেই কিন্ত পর মুহূর্তেই অন্য এক উৎকণ্ঠা পেয়ে বসলো আমাদের। অনিলের প্রশ্নে এটাও প্রমান পায় যে সে ফরেস্ট রেস্ট হাউসের রাস্তা চেনে না। মহুয়াডার গঞ্জ হলেও এই শীতের সন্ধ্যায় সে এক নিঝুমপুরী। আমাদের সব কটি অরণ্য নিবাসের বুকিংই করা হয়েছে অনলাইন। দূরাভাষে কোনোরকম যোগাযোগের সম্ভাবনা ছিলনা।
অর্থাৎ আদৌ আমরা পথ খুঁজে অরণ্য নিবাস অবধি পৌঁছতে পারবো কিনা আর পৌঁছলেও সেখানকার কেয়ারটেকার উপস্থিত থাকবে কিনা? তবে কি গাড়িতেই থাকতে হবে? খাবার সংস্থানই বা কি হবে? গাড়িতে খাবার জলের শেষ কয়েক বিন্দু জল পড়ে আছে শুধু! এসব প্রশ্নের জটে যখন বেশ জর্জরিত আমরা, হঠাৎ হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো দেখি সামনে একটি খাবারের দোকান তখনও খোলা। গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল রুটি মাংস পাওয়া যাবে। শরীরে যেন বল এলো।
গাড়ি থেকে নামতেই এক নতুন চমক। অনিল আবিষ্কার করলো পেছনের বাঁ দিকের চাকাটি পাংচার হয়ে একেবারে বসে গেছে। বিরক্ত হওয়ার বদলে অনিল দেখি হাসি মুখে বজরংবলীর নাম নিয়ে বার কয়েক প্রনাম ঠুকল। আনন্দের কারণ টা হলো..এই পাংচার যদি মাঝ রাস্তায় জঙ্গলের মধ্যে হতো, তাহলে আমাদের মধ্যে কজন যে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারতাম তা নিয়ে ঘোর সংশয় ছিল। চাকা বদলের সাথে সাথে আমাদের রাত্রের খাওয়ার আয়োজনও সম্পন্ন হলো। জ্যোৎস্না স্নাত নিঝুমপুরীতে এবার খুঁজে নিতে হবে আমাদের রাতের মাথা গোঁজার জায়গা।
কিছুটা এগোতে দেখি উষ্ণতার খোঁজে পথের ধারে বসে দুটি লোক আগুনে হাত সেঁকছে। দেহাতি ভাষায় অনিল জিজ্ঞেস করে তাদের থেকে মনে হলো যথাযত কিছু উত্তর পেয়েছে। বেশ খোশ মেজাজে গাড়ি ছোটালো। সামনে এগিয়ে বাঁ দিকে একটা কাঁচা রাস্তা ধরলাম আমরা। এই রাস্তাটাই অবশেষে মহুয়াডার অরণ্য আবাস ( Mahuadanr FRH) পৌঁছে দিলো আমাদের।
FRH এর চওড়া গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকে হাঁকাহাকি করতেই কেয়ারটেকার বেরিয়ে এসে আমাদের বুকিং স্লিপ নিয়ে বাংলোর ভেতরে নিয়ে চললো। সমস্ত উৎকণ্ঠার যেন এক নিমেষে অবসান ঘটলো।একতলা বাংলোর চওড়া বারান্দা পার হয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই মন প্রাণ ভরে গেলো সকলের। সুবিশাল একটি বৈঠকখানা ঘর আপাদমস্তক কার্পেট পাতা এবং পর্যাপ্ত সোফা এবং সেন্টার টেবিল দিয়ে সাজানো।
লম্বা ঘরটির একেবারে শেষ ভাগে ডাইনিং টেবিল আর তারপরেই রান্নাঘর। বৈঠকখানার লাগোয়া বাঁ দিকে দুটি বড় শয়ন কক্ষ যার প্রতিটির সাথে লাগোয়া বাথরুম। পুরো বাংলোটাই আজ রাত্তিরে আমাদের। স্নান সেরে বৈঠকখানায় জমিয়ে বসা হলো আড্ডায়। বাংলার বাইরে পেছন দিকটায় বনদপ্তরের একতলা কোয়ার্টারস আর তারপরেই পাঁচিলের ওপারে জঙ্গল। জ্যোৎস্না স্নাত মহুয়াডারকে ভালোবেসে ফেলতে আমাদের কাল বিলম্ব হলো না। সারাদিনের ক্লান্তি নিমেষে উধাও। সোফায় শরীরটা এলিয়ে গল্পে গানে আমরা ভেসে গেলাম কখনো অরণ্যকে, কখনো কোয়েলের পারে আবার কখনো পালামৌ ভ্রমণে।
১০:
আজ পালামৌ এ দ্বিতীয় দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি মান্না আর দত্ত হাওয়া। হরিণ শাবকের ন্যায় এই দুজন তরুণ তুর্কীকেও শিষ্ট ভাবে পাশে বসিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। সুযোগ পেলেই কিরম জানি ছিটকে বেরিয়ে যায়। আমাদের আজকের রাত্রিবাস মারোমার অরণ্য নিবাসে। মারোমারের অরণ্য নিবাসে খাওয়া দাওয়ার কোনো সংস্থান নেই, এমনকি বাইরেও কোনো দোকানপাট নেই।
রান্নার ব্যবস্থা আছে তবে তেল, নুন থেকে শুরু করে যাবতীয় রেশন নিয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ মহুয়াডার থেকে বাজারহাট করাও আমাদের আজ একটি প্রধান কাজ। অনিল এদিকে গাড়ি নিয়ে সকালে বেরিয়ে গেছে কিছু মেরামতের কাজ করাতে। ঘড়িতে এখন সকাল ৭.৩০। পরিকল্পনা মাফিক সকাল ৮টার মধ্যে আমাদের বেরিয়ে পড়ার কথা লোধ ফলসের উদ্দেশ্যে। অনিল না ফেরা অবধি বেরোনোর উপায় নেই। ক্যামেরা নিয়ে বাংলোর চারপাশটা একাই ঘুরে এলাম।
এখানে বলে রাখি মহুয়াডার এশিয়ার একমাত্র নেকড়ে অভয়ারণ্য। কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলে জানলাম গাড়িতে প্রায় ৭-৮ কিমি রাস্তা অভয়ারণ্য। সাফারির কোনো ব্যবস্থা নেই, তবে নিজেরা গাড়ি নিয়ে কিছুটা ঢোকা যায়। তবে বেশি ভেতরে না যাওয়াই শ্রেয় কারণ জঙ্গলটা নাকি মাওবাদী অধ্যূষিত এলাকা। মনে মনে ঠিক করলাম যদি সময় পাই তবে একবার ঢুঁ মেরে যাবো।
১১:
প্রায় ৯টা নাগাদ অবশেষে অনিল ফিরলো। আমরা তৈরী হয়েই ছিলাম। বেরিয়ে প্রথমে গেলাম ব্রেকফাস্ট সারতে বাজার চত্বরে। সাত জনের পুরি সবজি করতে গিয়ে দোকান ওয়ালার প্রায় ভীরমি খাওয়ার জোগাড়। আটা বেলা থেকে শুরু করে থালায় আসা অবধি পুরো পদ্ধতিটায় বেশ কিছুক্ষন সময় লেগে গেলো। লীনা অবশ্য তার মধ্যেই বুদ্ধি করে অন্য একটি দোকান থেকে ডাবল ডিমের ওমলেট বানিয়ে আনলো সকলের জন্য। যাইহোক, গোগ্রাসে খেয়ে আমরা রওনা দিলাম লোধের পথে। বাজারের উল্টোদিকের রাস্তা।
গাড়ি ঘুরিয়ে অরণ্য আবাসকে ডান হাতে রেখে লোধের পথে এগোলাম কাঁচা রাস্তা ধরে। কখনও অরণ্য, কখনো ছোট ছোট গ্রাম আবার কখনও মালভূমির রাঢ় শুষ্কতা আমাদের সঙ্গী হলো এই উঁচু নিচু রাস্তায়। চাক্ষুস হলো মাওবাদী কীর্তি কলাপও। গ্রামের একটি ট্র্যাক্টর সম্পূর্ণ দগ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে অনিল বুঝিয়ে দিলো নতুন ট্র্যাক্টর কিনলে মালিককে কিছু টাকা দিতে হয় মাওবাদীদের। এটাই নাকি নিয়ম। উক্ত ট্রাক্টরের মালিক এই নিয়মের ব্যতিক্রমী হতে চেয়েছিলেন তাই তাঁর এই সর্বনাশ।
১২:
ঘন্টা খানেক লাগলো আমাদের লোধ পৌঁছতে। বর্ষাকালে এ রাস্তা বড়ই দূর্গম তবে আমরা যে সময়ে এসেছি তাতে লোধের একেবারে ঘাড় অবধি গাড়ি নিয়ে পৌঁছে যেতে কোনো অসুবিধা হলো না। গাড়ি ছেড়ে পায় হাঁটা পথে অবতীর্ন হলাম। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে থাকে থাকে সাজানো কংক্রিট এবং পাথুরে রাস্তা কখনো চড়াই কখনো উতরাই।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই আমরা লোধ ফলসের একেবারে মুখোমুখি চলে এলাম। ঝাড়খণ্ডের উচ্চতম ঝর্ণা এই লোধ। প্রায় ৪৭০ ফুট ওপর থেকে বুরহা নদী পাথুরে পাহাড় বেয়ে আছড়ে পড়েছে লোধে। বিপুল জলরাশি ৩-৪ ধাপে নেমে এসেছে নিজের ব্যাপ্তি প্রসারিত করতে করতে। বড় বড় পাথর গুলোর ওপর যেখানে আমরা এখন দাঁড়িয়ে, তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে স্নিগ্ধ ,সবুজ, টলটলে, শীতল লোধ। অথচ সামনে ৩০ ফুট দূরেই সে বড়ই চঞ্চল…বড়ই উচ্ছল।
আরও দূরে সে আরও অপ্রতিরোধ্য, সুউচ্চ পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নিচে। যেন এক দামাল কুমারী উঁচু গাছের ডাল থেকে তরতর করে নেমে নেমে এসে এক পাথর থেকে আরেক পাথরে দৌড়তে দৌড়তে আমাদের পাশে এসে কিঞ্চিত বিশ্রাম নিচ্ছে এবং তারপর পুনরায় এই দামাল খেলায় সে লিপ্ত হচ্ছে…অনবরত অনন্তকাল ধরে! এই দামাল কুমারীর প্রেমে মত্ত হয়ে ঘন্টা দেড়েক কেটে গেল তাকে অনুভব করতে এবং মানস ও যান্ত্রিক ফ্রেমে তাকে চিরতরে ধরে রাখতে।
১৩:
লোধ কে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে যখন ফিরলাম তখন ঘড়িতে ১২.১০। “উই আর রানিং শর্ট অফ টাইম, ম্যান। উলফ স্যাংকটুয়ারী কি হবে?”- কৌশিকের এংলো স্বগতক্তিতে লীনা তিতিবিরক্ত। দুজনকেই বোঝালাম যে সবই নির্ভর করবে সময়ের ওপর, এখন এ নিয়ে লড়াই করে লাভ নেই। মারোমার আমাদের আজ দিনের আলো থাকতে থাকতে পৌঁছতেই হবে। রওনা দিলাম অরণ্য আবাসের দিকে। সেখানে সকলের লাগেজ গোছানোই ছিল। পাঁচ মিনিটে চেক আউট করে চলে গেলাম বাজারে।
চাল, ডাল,তেল নুন চা থেকে শুরু করে যাবতীয় মুদিখানা বাজার, সব্জী বাজার, নুডলস এর প্যাকেট, বিস্কুট, কোল্ড ড্রিংকসের বোতল এবং মুরগীর মাংস…দু জন করে তিনটি দলে ভাগ হয়ে অপটু হাতে বাজার সারতে সময় খেয়ে গেল বেশ কিছুক্ষণ। সাতজনের তিন বেলার রেশন নেহাত কম নয়! আগে থেকেই লাগেজ সমেত আমরা ফুল প্যাকড হয়ে ছিলাম,নতুন অতিথিদের গাড়িতে পুরতে বেশ বেগ পেতে হলো। অবশেষে গাড়ির চাকা যখন গড়ালো অনুভব করলাম আমাদের গাড়িটি শিয়ালদার বৈঠকখানা বাজারের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণে পরিণত হয়েছে। ড্যাশবোর্ড এ আপন মনে হেলে দুলে খেলে বেড়াচ্ছে লাল টম্যাটো। কারো কোমরে মাঝে মাঝেই সুড়সুড়ি দিয়ে উঠছে পলিথিনের প্যাকেট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা লম্বা বেগুনের বোঁটা।
মাঝের সিটে বসে পায়ের তলায় গড়িয়ে চলে আসা ২ লিটারের নরম পানীয়ের বোতল গুলোকে অনবরত অতি নিপুন দক্ষতায় ড্রিবল করে চলেছি। টপ রেমনের নুডলস এর প্যাকেট বিদিশার জুতোর তলায় মিক্সার-গ্রাইন্ডার এর ন্যায় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে সুপ পাউডারে পরিণত হয়েই চলেছে। গাড়ির ঝাঁকুনিতে পেছনের সিটে সদ্য নিহত মুরগীটি চরম আক্রোশে কখনও বা স্নেহাংশু আবার কখনও দত্তর কোলে গিয়ে আছড়ে পড়ছে। প্রায় ৪০ মিনিট পর আমরা এই চলমান বৈঠকখানা বাজার থেকে রেহাই পেয়ে অবতীর্ণ হলাম সুগাবাঁধ জলপ্রপাতের সামনে।
১৪:
সুগা যেন সাদা পাথরে সুসজ্জিত এক বিশালাকায় রাজকীয় পালঙ্ক। তার মাঝখানের নরম বালুচর দিয়ে ধীর স্থির গতিতে বয়ে চলেছে বুরহা নদী। বেলা গড়িয়ে প্রায় ৩টে। পশ্চিম আকাশে সূর্যের দাপট অনেকটাই কম এখন। জলরেখায় ছড়িয়ে পড়েছে তার মৃদু হাসির ঝলক। সুগ্গা কথাটির মানে টিয়া পাখি। কথিত আছে বহু বছর আগে বুরহা নদী যখন এই পাথরের পালঙ্কে ধাক্কা খেয়ে আটকে পড়েছিল, তখন তাকে মুক্তি দিতে একদল টিয়া পাখি ঠোঁট দিয়ে খুঁটে খুঁটে পাথরের গায়ে অজস্র ছেদ করে বুরহা কে মুক্তি দিয়েছিল। এইভাবেই নাকি এই এই বাঁধের উৎপত্তি এবং তার থেকেই এর নাম সুগা বাঁধ।
ভৌগোলিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী পাথরের সাথে নদীর অনবরত ঘর্ষণের ফলে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় এই বাঁধের সৃষ্টি। বাঁধের পাশেই পারের ওপর একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে যার ওপর থেকে পালামৌয়ের বার্ডস আই ভিউ দূর্দান্ত। সুগা বাঁধকে বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম মারোমারের পথে। সুগা থেকে মারমারের রাস্তা অসামান্য সুন্দর। পাহাড়ের গায়ে অরণ্যের প্রলেপ, রাস্তা কিঞ্চিৎ চড়াই। সারাটা রাস্তা জনমানব নেই বললেই চলে। কিছুটা এগোতেই পেয়ে গেলাম বারেসার চেক পোষ্ট। এই বারেসারেও আছে অরণ্য নিবাস। বারেসার ছেড়ে গাড়ি কিছুটা গড়াতেই একটি পুল পার হতে হলো, দেখা হলো কোয়েলের সাথে পুনরায়। ৫ মিনিট পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম মারোমার ফরেস্ট রেস্ট হাউসের প্রধান ফটকে।
১৫:
চওড়া লোহার গেটে উদ্ধত দুটি বাইসন স্বাগত জানালো আমাদের। মারোমার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬১৫ ফুট ওপরে তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাপমাত্রা মহুয়াডারের থেকে অনেক কম। চারিদিকে অরণ্য পরিবেষ্টিত এই ফরেস্ট রেস্ট হাউস। উঁচু উচুঁ গাছ গুলোর ডালপালা ও পাতার আস্তরণ ভেদ করে এমনিতেই সূর্যের আলোকে বেশ বেগ পেতে হয় রেস্ট হাউসের জমি অবধি আসতে, তায় আবার এখন শীতের পড়ন্ত বেলা।
এখনই বেশ ঠান্ডা লাগছে জানিনা সন্ধ্যার পর তাপমাত্রা কোথায় নামবে। কয়েক পা এগিয়েই হলুদ রঙের মনকাড়া একতলা বাংলো। এই বাংলো নির্মিত হয় ১৯৪৭ সালে। শোনা যায় ব্রিটিশ আমলে কোম্পানির বাবুরা শিকারে আসতেন এই মারমারের জঙ্গলে এবং তাঁদের জন্যই একটি বিশ্রাম কক্ষ বানানো হয়েছিল এখানে। বাংলোর ডান দিকে ১০ পা দূরেই রান্নাঘর এবং লাগোয়া কেয়ারটেকার এর ঘর। বাংলোর সামনের বারান্দার পাশ দিয়ে ইঁট বাঁধানো রাস্তা দিয়ে কিছুটা দূরে দেখা যাচ্ছে গাছবাড়ি।
কংক্রিটের পিলারের ওপর দুটি গাছবাড়ি আপাতত বর্তমান। আমাদের দেখে অল্প বয়সী একটি ছেলে এগিয়ে এসে পরিচয় দিলো কেয়ারটেকার হিসেবে। আমাদের বুকিং বাংলোর একটি ঘর এবং ট্রী হাউসে আরেকটি ঘর। মান্না, দত্ত আর লীনা রান্নাঘরের ব্যাপারটা ভালো করে বুঝে নেওযার জন্য কেয়ারটেকার কে সঙ্গে নিয়ে সেদিকে হাঁটা দিলো। বাকি চারজন আমরা মালপত্র এবং বাজারহাট নামিয়ে দুটি ঘরের দখল নিলাম।
১৬:
দিনের আলো থাকতে থাকতে বাংলোর বাইরে চারপাশটা একটু ঘুরে আসতে হবে। ইতিমধ্যে কেয়ারটেকার কে সঙ্গে নিয়ে ওই মুহূর্তের সব থেকে বড় কর্ম যজ্ঞটি শুরু করে দিয়েছে মান্না আর দত্ত। মাটির উনুনে লম্বা কাঠের লগ গুঁজে আঁচ দিয়ে তৈরী আমাদের দুই তরুণ তুর্কী। অক্ষত অবস্থায় থাকা টপ রেমনের দুটি প্যাকেট বের করে চটজলদি কড়াইতে বসানো গরম জলে ঢেলে দেওয়া হলো। তৈরী হলো নুডলস। তার সাথে চা। আজকের দ্বিপ্রাহরিক আহার আমাদের এটাই। আহার সম্পন্ন করেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। গেট খুলে কাঁচা রাস্তায় পড়তেই আমাদের দেখে এক বানর যুগল খচমচ আওয়াজ করতে করতে তরতরিয়ে উঠে গেলো গাছের একেবারে টঙে। ৭০-৮০ মিটার হেঁটে গেলেই পিচ রাস্তা। তার উল্টাদিকে সরু একটি কাঁচা রাস্তা এঁকেবেঁকে গিয়ে অদৃশ্য হয়েছে দূরের পাহাড়ে।
গোধূলির আলস্য মেখে এগিয়ে চললাম এই রাস্তা ধরে। ডানহাতে চাষের ক্ষেত পেরিয়ে দূরের পাহাড় গুলোর আড়াল থেকে অস্তায়মান সূর্য রাঙিয়ে রেখেছে সারা আকাশ। বাঁ হাতে দু একঘর কাঁচা বাড়ি। রাত্রের যেন আর তর সইছেনা। দিনের শেষ আলোর রেখাটিকে দ্রুত ঢেকে দিতে চাইছে সে গভীর অন্ধকারে। কিছুক্ষন আগে থেকেই বোধ করছিলাম শরীরটা যেন মনের সাথে ঠিক তাল মিলিয়ে উঠতে পারছেনা আমার। হয়তো একটু বিশ্রাম দরকার। বাকিদের থেকে বিদায় নিয়ে রেস্ট হাউসের পথে পা বাড়ালাম।
পিচ রাস্তার মোড় টায় যখন এলাম তখন পুরোপুরি অন্ধকার নেমে গেছে। আলো বলতে রেস্ট হাউসের আলো গুলোই টিম টিম করে জ্বলছে। বাংলোয় যাবার ওই ৭০ মিটারের রাস্তাটায় উঠেই গা টা কেমন যেন শির শির করে উঠলো আমার ঠিক পেছনেই ডান দিকে শুকনো পাতার মাঝে ঘসঘষ একটা আওয়াজ পেয়ে। চকিতে পিছন ফিরে কিছুই দেখতে পেলাম না। দু পা বাড়াতেই গাছের ওপর থেকে পিলে চমকানো এক কর্কশ আওয়াজ। হয়তো কোনো পাখি। কিন্তু এই অন্ধকারে হঠাৎ সেই আওয়াজ সারা শরীর নাড়িয়ে দিলো আমার। একটু জোরেই পা চালালাম।
কয়েক মুহূর্ত নিজেকে সবে সামলে নিতেই দেখি ডানদিকের উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল টার দিকে হুড়মুড়িয়ে কেউ বা কারা যেন গিয়ে মিলিয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে গাছের ডালের নড়াচড়া ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না। বাঁদর কি? হবে হয়তো। এই অশরীরী বা শরীরী রা যেই হন না কেন, এই ৭০ মিটার পথ আমার মনের গভীরে পাকাপাকি বাসা করে নিলো। গেট টা খুলে ভেতরে ঢুকে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
১৭:
গরম জলে স্নান সেরে বেরোতেই শরীর টা বেশ চাঙ্গা হয়ে গেল। ততক্ষনে বাকিরাও ফিরে এসেছে। বাংলোর মাথার ওপর নক্ষত্র খচিত গাড় নীল আকাশে উকিঁ মারছে পূর্ণিমার চাঁদ। মান্না আর দত্ত যথারীতি হেসেলর দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। ভাত, বেগুন ভাজা আর মুরগীর ঝোল…এই হলো মেনু। কৌশিক আবদার রাখলো সে আমাদের চিকেন সালাড বানিয়ে খাওয়াবে। ভাত টা একেবারে শেষের জন্য রেখে বাকি জিনিসগুলো উনুন বদলা বদলি করে এগোতে থাকলো। মান্না আর দত্ত কে সাহায্য করতে সকলেই কমবেশি টুকটাক হাত লাগালাম।
একবাটি সেদ্ধ মুরগী নিয়ে বসে নিপুণ হস্তে সাইজ করছে কৌশিক…চিকেন স্যালাড এর প্রাথমিক পর্যায়। ভাত ছাড়া সবই তৈরী সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে। বাংলোর চওড়া বারান্দায় কাঁচের টেবিল ও চেয়ার আগে থেকেই পাতা ছিল। কৌশিক যে শুধু যত্ন করে স্যালাড টা বানিয়েছে তা নয়, ওর ওপর শশা আর টম্যাটো দিয়ে নক্সা করে যেভাবে পরিবেশন করলো তাতে সত্যি প্রকৃত শিল্পীর ছোঁয়া। বারান্দায় সোলার চালিত আলো থাকলেও এই পরিবেশে সেটি বেমানান। সবকটি আলো নিভিয়ে মোমবাতির আলোতে জমিয়ে বসা হলো মাহফিল সাজিয়ে। কৌশিকের চিকেন স্যালাড যে এতটা সুস্বাদু হতে পারে,এইটা সত্যি আমরা কেউই আন্দাজ করিনি। গল্প, গান, মেহফিল, চিকেন স্যালাড এবং জ্যোৎস্না স্নাত মারোমার কে ক্যামেরা বন্দী করতে করতে কেটে গেল বেশ কয়েক প্রহর।
দূরের কালচে নীল ক্যানভাসে অতন্দ্র প্রহরীর মতো আমাদের পাহারা দিচ্ছে একের পর এক পাহাড় গায়ে গা লাগিয়ে। তাদের আবছা উপস্থিতি এবং থেকে থেকে দূর থেকে ভেসে আসা নেকড়ে আর শিয়ালের ডাক এক আদিম বন্যতায় ছেয়ে রেখেছে পালামৌ কে। একদৃষ্টে সেদিকে তাকালে মনে হয় ওটাই বুঝি পৃথিবীর শেষ প্রান্ত। ওই যে আবছা পাহাড়….ওর ওপারে বুঝি শুধুই শূন্যতা! সময় যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে সেখানে। কল্পনার পক্ষীরাজে চরে যখন সকলেই পারি দিয়েছি সেদিকপানে, “দাদা রা, দিদি রা…এবার কিন্তু ভাত টা বসাতে হবে। রাত ১০টা বাজে”- মান্নার অ্যালার্ম এ সম্বিৎ ফিরলো সকলের। বাকি রান্নাটা সেরে খাওয়া দাওয়া মিটিয়ে সেই রাত্রের মতো অবসর নিলাম সকলেই।
১৮:
পরদিন ভোরে সব থেকে আগে ঘুম ভাঙলো শুভজিতের। তার ডাকাডাকিতে উঠে পড়লাম আমি, মান্না আর লীনাও। চোখ কচলিয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দেখি দত্ত ততক্ষণে পগার পার। আগের দিন বিকেলে অধরা রয়ে গেছিলো মারোমারের অরণ্য গ্রামটি। চটজলদি তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম তিনজনে সেই গ্রামের পথে। ভোরের মিষ্টি আলোয় রাঙা মাটির সরু পথ এঁকেবেঁকে কখনও বা ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে আবার কখনও সবজি ক্ষেত, সর্ষে ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে নিয়ে চললো আমাদের সেই ছোট্ট গ্রামে। বাঁশের মাচার ওপর খড়ের গাদায় আছড়ে পড়েছে সকালের সোনা রোদ।
কুঁড়েঘরগুলির সামনে সংগ্রহ করা ডালপালা জ্বালিয়ে উনুনে আগুন দিচ্ছে গৃহিনী এবং পাশে বসে তার আধা ঘুমন্ত ছোট্ট মেয়ে মুখে দাঁতন গুঁজে তাকিয়ে তার মায়ের দিকে। কোথাও বা চাটাইয়ে শুকোচ্ছে মহুয়া ফল। আবার কোথাও খুঁটিতে বাঁধা বাছুর রোদ পোহাতে পোহাতে আপন মনে খেলে বেড়াচ্ছে। গ্রামটিতে দাঁড়িয়ে যেদিকেই তাকাই, সুদূরে দিকচক্রবাল রেখা গিয়ে মিশেছে কোনো না কোনো পাহাড়ে। ফেরার পথে দত্তর সাথে দেখা। ঘড়ির কাঁটা থেমে থাকে না, বেলা গড়িয়ে প্রায় ৮টা। মারোমারকে বিদায় জানিয়ে রওনা হতে হবে পরবর্তী গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে। ফিরে এলাম রেস্ট হাউসে।
১৯:
সিংহভাগ বাঙালিরা গরম ভাতে ঘী আলুসেদ্ধ দিয়ে খেতে ভালোবাসে। আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। গ্রাম থেকে ফিরে আগেরদিন রাত্রের মতো একই পন্থায় দো নলা উনুনে কাঠের লগ গুঁজে ঢাউস হাঁড়িতে চাপিয়ে দেওয়া হলো ভাত। একেবারে লাগেজ পত্র গুছিয়ে আমরা ডাইনিং হলে খেতে বসে গেলাম। গরম ভাতে ঘী আলুসেদ্ধ দিয়ে বেশ তৃপ্তি করে খেলাম। সঙ্গতে একটি ডেকচিতে রাখা ছিল ১৫টি ডিম সেদ্ধ। ডেকচির ঢাকনা তুলতেই আবিষ্কার করলাম ওর মধ্যে বেশ কয়েকটি পচা। আসলে আগের দিন বিকেলে বড় রাস্তার মোড়ের মাথায় একমাত্র দোকানে ডিমের অর্ডার দিয়ে এসেছিলাম। ১৫ টি ডিম শুনে লোকটি যেমন চোখ বড় বড় করেছিল, তখনই কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল। আসলে ওনাদের দোষ নেই…এই অরণ্য গ্রামে অতগুলো ডিমের একসাথে প্রয়োজন কোনো বাড়িতে পরে না। পুরোনো স্টক ঘেঁটে বার করতে গিয়ে হয়তো অনিচ্ছাকৃত ভাবেই কিছু পচা ঢুকে গেছে। সে যাই হোক, আগের পাতে ঘী আলুসেদ্ধর মহিমায় ১৫ থেকে গোটা ৯ য়েক ডিমে নেমে গেলেও ব্যাপারটায় খুব বেশি বিরক্ত কেউই হলাম না।
২০:
মারোমারকে বিদায় জানিয়ে আমরা অগ্রসর হলাম মিরচাইয়া ফলসের পথে। কাল যে পথে বারেসার থেকে মারোমার এসেছি, সেই পথেই মারোমারকে পেছনে ফেলে আরও এগিয়ে চললাম। মাত্র ৫ কিমি মতন গিয়েই রাস্তার একেবারে ধার ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করালো অনিল – “আ গেয়ে মিরচাইয়া ফলস।” এপাশ ওপাশ কোথাও ফলসের নাম গন্ধও নেই। আমাদের মুখেচোখে ভ্যাবাচ্যাকা ভাব দেখে গম্ভীর অনিলের রসবোধ জেগে উঠলো। “আইয়ে আপকো ম্যাজিক দিখাতে হেই”, বলে রাস্তার ওপারে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটা লাগিয়ে তার পিছু নিতে বললো। আঁকাবাঁকা সরু পায়ে হাঁটা পথে কিছুটা এগিয়ে..সত্যি ম্যাজিক। মাত্র ১০ হাত দূরেই কে যেন জাদু বলে হঠাৎ করে পাথুরে উপত্যকার একটি মিষ্টি ঝর্ণা আমাদের সামনে উপহার হিসেবে দিলো।
পেছনে তাকিয়ে দেখি অনিলের ঠোঁটের কোনে ততোধিক একটি মিষ্টি হাসি। সত্যি, বড় রাস্তা থেকে কোনোভাবেই এই মিরচাইয়ার হদিশ পাওয়া সম্ভব নয়। মসৃন, চওড়া এবং সুবিস্তৃত পাথরের তট গিয়ে মিশেছে সবুজ বনানীতে। তার প্রেক্ষাপটে ঘন নীল আকাশ। সামনের দিকে অর্থাৎ আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে, বড় বড় পাথরে ফাঁক দিয়ে ঝর্নার জল চলে এসেছে একেবারে আমাদের পায়ের কাছাকাছি। ধীর, স্থির আর স্বচ্ছ সেই জল। সব মিলিয়ে বড়ই মনমহিনী রূপ এই মিরচাইয়ার।
ঝর্নার জলের দেখা পেলেই সেই জলে স্নান না করা অবধি যেন জীবন স্বার্থক হয়না মান্না বাবুর। কি ভাগ্যিস লোধে গামছা খান আলাদা করে নিতে ভুলে গেছিলো! এখানে তো সমস্ত লাগেজই সঙ্গে গাড়িতে। আমরা যখন সামনের দৃশ্যাবলী ফ্রেম বন্দী করছি, সেই ফাঁকে কখন জানি মান্না একছুটে গাড়ি থেকে গামছা নিয়ে এসে হাজির হয়েছে। ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কেউই খেয়াল করিনি। হঠাৎ এখন চোখে পড়লো কিছুটা দূরে যেখানে দুধারের পাথরের মাজখানে মিরচাইয়ার উৎস বলে মনে হচ্ছে, ঠিক সেখানে লেপটে বসে স্নানে মগ্ন আমাদের মান্না। আমাদের বিস্তর হাঁকাহাকিতে অবশ্য সে বেচারা দীর্ঘক্ষণ সেখানে জলকেলি করতে সক্ষম হলো না। বন্য মান্না সভ্য মান্নায় অবতীর্ন হলো শীঘ্রই এবং আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু করলাম বেতলার পথে।
২১:
গারু রোড ধরে হুহু করে ছুটছে অনিল। বারেসার অথবা মারোমারের সব থেকে কাছাকাছি বাজার এলাকা বা জনপদ বলতে এই গারু, যা কিনা মারোমার থেকে প্রায় ৯কিমি দূরে অবস্থিত। গারুর বাজার এলাকা ছাড়িয়ে কিছুটা এগোতেই আবার দেখা হলো কোয়েলের সাথে। গত দুদিনে যতবার দেখা হয়েছে তার সাথে , আজকের তিনি সব থেকে মোহময়ী রূপ ধারণ করে এখন আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন।
কোয়েল এখানে বিস্তর চওড়া। ওপর দিয়ে গাড়ি যাবার জন্য ঝকঝকে চওড়া ব্রিজটি দৈর্ঘ্যেও নেহাত কম নয়। সেতুর মাঝ বরাবর এসে আমরা নেমে পড়লাম, অনিলকে বললাম গাড়ি নিয়ে এগিয়ে ওপারে দাঁড়াতে। নিচে কোয়েলের দিকে তাকিয়ে মনে হলো যেন অনেক কথা বলার আছে ওর। হলদেটে বালির চরে সেই না বলা কথাগুলো যেন অনবরত লিখতে লিখতে অতি ক্ষীণ শিরায় বয়ে চলেছে কোয়েল এখানে। দূরে সে বাঁক নিয়ে আবার মিশে গেছে অজানা পাহাড়ের দেশে। মনের মনিকোঠায় এবং ক্যামেরার যান্ত্রিক কুঠুরীতে কোয়েলকে বন্দী করে আমরা এগোলাম বেতলার উদ্দেশ্যে।
মুনরু, লভর, ছিপাদোহার ছুঁয়ে প্রায় ৩২ কিমি রাস্তা এখান থেকে বেতলা ন্যাশনাল পার্ক। এই রাস্তার সিংহভাগটাই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে । অরণ্যের ঘ্রান নিতে নিতে মিনিট পঞ্চাশে পৌঁছে গেলাম বেতলা অভয়ারণ্যের একেবারে গেটের সামনে। মুঘল স্থাপত্যের ছোঁয়ায় পেল্লাই গোলাপী রঙের গেট। বেতলা পার্কে বিকেলের সাফারির সময় ৪টে থেকে ৬টা। সাফারির গাড়ি দুই প্রকার – বলেরো এবং কমান্ডো জীপ। আমরা কমান্ডো নেবার আশা ব্যক্ত করতে, অনিল ভেতরে গিয়ে গাইড সহ আমাদের সকলের সাফারি বুকিং সেরে এলো।এখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় ২টো ছুঁই ছুঁই। অর্থাৎ হাতে দু ঘন্টা মতন সময়।
২২:
অন্যান্য জায়গাগুলোর মতন এখানেও আমাদের অনলাইনে বুকিং করা আছে বেতলা ফরেস্ট রেস্ট হাউস। দলমত নির্বিশেষে ঠিক হলো রেস্ট হাউসে চেকইন করে লাগেজ পত্র নামিয়েই আমরা দৌড়াবো পালামৌ ফোর্টের উদ্দেশ্যে। অনিল গাড়ি স্টার্ট দিতেই দেখি অল্পবয়সী বেঁটে খাটো চওড়ামুখো একটি ছেলে পেছনে রাখা লাগেজ গুলোর মধ্যিখানে অতি নিপুন দক্ষতায় একগাল হাসি ঝুলিয়ে নিজেকে সেঁধিয়ে দিল। শুভজিত পেছন থেকে হাঁই হাঁই করে ওঠাতে চওড়া মুখে চওড়া হাসি নিয়ে ছেলেটি বলে উঠলো, – “স্যার। হাম অপলোগো কা গাইড হুঁ।” অনিল তার কথায় সম্মতি সূচক আওয়াজ করায় এটা বুঝলাম যে এই শর্মাই আমাদের সাফারি গাইড।
কিন্তু এইটা বোধগম্য হলো না যে সাফারির ২ ঘন্টা আগে থেকে কেন আমাদের তাকে প্রয়োজন হবে। যাইহোক, অনিল গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টোপথে কিছুটা এগিয়ে বাঁ দিকের একটি রাস্তা ধরলো। ২-৩ মিনিট গিয়েই পেয়ে গেলাম ফরেস্ট রেস্ট হাউস। ঢালাও লম্বাটে ইস্কুল বাড়ির মতন উঁচু চওড়া বারান্দা ওয়ালা একচালা বাংলো। পাশাপাশি ৪ টা ঘর। অল্প হাঁকাহাকিতেই এগিয়ে এলেন ফরেস্ট লজের কেয়ারটেকার, শঙ্কর বাবু। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দুটি ঘর আমাদের জন্য খুলে দিয়ে হাঁক পারলেন, “আরে এ শংকর। সাহাব লোগো কা লাগেজ থোড়া আন্দার কর দে।” শঙ্কর বাবুর মুখে শঙ্কর সম্বোধন শুনে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম সকলে। পরে কথা বলে বুঝলাম আসলে গাইড টির নামও শঙ্কর। “জয় শঙ্কর!” – বলে বাজখাঁই গলায় একটা হুঙ্কার ছেড়ে কৌশিক এই দ্বৈত শঙ্কর পর্বের আপাত ইতি টেনে বুঝিয়ে দিলো যে আমাদের এখুনি না বেরোলে দেরী হয়ে যাবে।
২৩:
আদ্যোপান্ত বন্যতায় মোরা ইতিহাসের খোঁজে রওনা দিলাম আমরা পালামৌ ফোর্টের পথে। পালামৌ তে দুটি দূর্গ – পুরোনোটি সমতলে এবং অপেক্ষাকৃত নতুনটি পাহাড়ের ওপরে। মিনিট ২০র মধ্যেই অনিল আমাদের পৌঁছে দিলো পুরোনো দূর্গটির প্রধান ফটকের সামনে। এই দূর্গের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে ফিরে তাকাতে হবে ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে।
মুঘলদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে এই অঞ্চলে তখন চেরো সম্প্রদায়ের রাজত্বের অধিপত্তন হয়েছে চেরো অধিপতি অনন্ত রাই এর হাত ধরে। পালামৌ এর আদি দূর্গটি তাঁরই আমলে তৈরী হয়। বংশানুক্রমে অনন্ত রাই এর মৃত্যুর পর রাজ্যপাটের দায়িত্ব চলে আসে তাঁর সুপুত্র মেদিনী রাই এর হাতে। পালামৌকে আরও শক্তিশালী করে তোলেন মেদিনী রাই এবং এই পুরোনো দূর্গটিকে আরও সম্প্রসারিত করেন তিনি। তাঁর আমলেই পাহাড়ের ওপরে দ্বিতীয় দূর্গটি নির্মাণ হয় যেটিকে পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র প্রতাপ রাই তাঁর রাজ্যপাট সামলানোর জন্য ব্যবহার করেন।
একদল ইতিহাসবিদ অবশ্য বলেন যে পালামৌয়ের পুরোনো দূর্গটির ইতিহাস আরও পুরোনো এবং দূর্গের আদি নির্মাতা আসলে রাজপূত বংশের রাজা রাস্কেল। তবে সে যেই বানিয়ে থাকুক, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে মোঘলদের বিতাড়িত করার পর প্রায় ২০০ বছর ধরে রাজত্ব করেছেন চেরো রাজারা এই তল্লাটে। দূর্গটি আকারে একটি আয়তক্ষেত্র, যাকে ঘিরে আছে প্রায় ২৫ ফুট উঁচু দেওয়াল। ভেতরে ঢুকে সুপ্রাচীন ইতিহাসের ছোঁয়া পেলাম দ্বিতলে ওঠার সুরঙ্গের মতো সিঁড়িতে, উপরের ধ্বংসপ্রায় দীর্ঘ করিডোরে, দূর্গের এক প্রান্তে বিশাল পাথকুয়াতে এবং আরো কিছু অবলুপ্ত প্রায় স্থাপত্যে।
২৪:
মেদিনী রাই এর দূর্গ দেখে আমরা পৌঁছে গেলাম কাছেই কমলডাহা দীঘিতে। কথিত আছে চেরো রাজাদের শাসন কালে এই দীঘি পদ্ম ফুলে ছেয়ে থাকতো এবং রাণীমা এই দীঘিতেই নাইতে আসতেন। চারপাশে বনানীতে ঘেরা এই দীঘি আজও যেন সেই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। হ্রদের একপাশে চোখে পড়লো এক জায়গায় পর্যটকদের একটি জটলা।
এগিয়ে গিয়ে দেখি দুটি কুনকি হাতিকে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা সেই জটলা। সেলফি উৎসবে মেতে রয়েছেন সকলে। সেই উৎসবে লীনা আর বিদিশাও যোগদান করতে গিয়ে আরেকটু হলেই হাতির শুঁড়ের আলিঙ্গনে প্লুটোনিক প্রেম পর্বে লিপ্ত হতো। কোনোরকমে তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে এসে অগ্রসর হলাম নতুন দূর্গ অর্থাৎ প্রতাপ রাইয়ের দূর্গের পথে। পিচ রাস্তা থেকেই নুড়ি পাথরময় একটি রাস্তা স্বল্প উচ্চ একটি পাহাড়ের ওপর পাকদন্ডী বেয়ে উঠে গেছে।
সচরাচর কোনো গাড়ি এই বিপজ্জনক পথে উঠতে রাজি হয় না। পদব্রজে উঠে দূর্গ দর্শন সারতে হলে ওদিকে বেতলার সাফারি ফসকে যাওয়ার যে সমূহ সম্ভাবনা, তা বোধহয় অনিলও আন্দাজ করে নিয়েছিল। বিনা বাক্যব্যয়ে সে গাড়ি নিয়েই উপরে চড়তে থাকলো অতি সাবধানে। পাকদন্ডীর একটি বাঁক ঘুরেই থমকে দাঁড়াতে হলো হঠাৎ। গাড়ির একেবারে সামনে ঠিক ৫-৬ ফুট দূরেই জ্বলজ্বলে চোখে কান খাড়া করে সরাসরি আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে একটি শিয়াল।
পড়ন্ত বেলার সূর্যের তেরছা রশ্মি এক সোনালী আভায় মুড়ে রেখেছে তাকে। আমার পাশে রাখা ৭০-৩০০ লেন্স গোঁজা আলোক যন্ত্রটা হাতে তুলতে যতটা সময় লাগে, আকস্মিক এই বন্যপ্রাণী দর্শনের সময়সীমাটি তার থেকেও বেশি ক্ষণস্থায়ী হলো। ভিউ ফাইন্ডারে চোখটা ঠাসার আগেই এক লাফে কোথায় যে সে মিলিয়ে গেল, আর কোন তার হদিসই পেলাম না।
হাতে সময় বড়ই কম, তাই অভিপ্রায় থাকা সত্ত্বেও শিয়াল অভিযান থেকে বিরত থেকে আরো কিছুটা চড়াই অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম দূর্গে। দূর্গের মূল ফটকটির কারুকার্য দেখার মতন এবং তাতে মুঘল ছোঁয়ার স্পষ্ট প্রমান। দূর্গের পেছন দিকের অন্ধকারাচ্ছন্ন পাকদন্ডী সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে বিস্মিত হলাম। প্রতাপ রাইয়ের সমস্ত রাজ্যপাট যেন আমার হাতের মুঠোয়। ঔরঙ্গা নদীকে বুকে আঁকড়ে ধরে দিগন্ত বিস্তৃত চেরো রাজ্য তার ৩৬০° ভিউ মেলে ধরেছে চোখের সামনে!
২৫:
নতুন দূর্গ থেকে যখন নামলাম ঘড়িতে তখন প্রায় ৩.৪০। নেহাত এখান থেকে বেতলা অভয়ারণ্যর দূরত্ব খুব বেশি নয় তাই ৪ টা বাজার কিঞ্চিৎ আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম বেতলার প্রধান ফটকে। এতক্ষন ঘড়ির কাঁটার সাথে কুস্তি লড়তে লড়তে ভুলেই গেছিলাম মনুষ্য জাতির খিদে নামক একটি বস্তু আছে। সাফারি যে আমরা ফসকাচ্ছিনা এইটা উপলব্ধি করতেই খিদের ব্যাপারটা মাথা চারা দিয়ে উঠলো। স্নেহাংশু আর শুভদীপ রাস্তার উল্টোদিকের একটি দোকান থেকে সিঙ্গারা সংগ্রহ করতে গেলো।
ঠিক চারটায় আমাদের পেছনের একটি কমান্ডো পাশ কাটিয়ে সাফারিতে ঢুকে গেলো। স্নেহাংশুদের কোনো পাত্তা নেই। এদিকে আরেকটি গাড়ি ভেতরে ঢোকার তোড়জোড় করছে। ৩-৪ টা গাড়ি একসাথে গেলে সামনের গাড়ির ওয়াইল্ড লাইফ সাইটিং এর সম্ভাবনা সব থেকে বেশি এই ধারণা টা আমাদের মাথায় বদ্ধ পরিকর হয়ে বসেছিল। আমরা গাড়িতে বসে হাকপাক করছি দেখে মান্না ছুটে গিয়ে স্নেহাংশুদের ডেকে আনলো। সিঙ্গারা তখনও সেই দোকানের করার তেলে খাবি খাচ্ছে।
২৬:
” ঘাবরাইয়ে মত। হাম আপনা তরফ সে পুরা কোসিশ করেঙ্গে তা কি আপলোগ জানোয়ার দিখ পায়ে।” – বেলা ৪.০৭ নাগাদ সাফারি শুরু করে আমাদের সান্ত্বনা দিলেন ড্রাইভার সাহেব, নাজিবুল্লা। অভয়ারণ্যের ভেতরের গেটটি দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়লো ডান দিকে একটি টাঁর মত জায়গায় খেলে বেড়াচ্ছে একদল হরিণ। খান কয়েক ছবি নিয়ে কিছু দূর এগোতেই দেখা পেলাম একদল হনুমানের। দল না বলে একান্নবর্তী পরিবার বলাই ভালো।
পড়ন্ত বেলার কোমল সোনালী রং এক উজ্জ্বল দীপ্তি নিয়ে আছড়ে পড়েছে তাদের পিঠে ঘাড়ে। এদের মধ্যে সব থেকে প্রবীণ যিনি, তিনি বসেছেন একটি উঁচু ঢিবিতে আর বাকিরা তাঁর দিকে মুখ করে ঢালের দিকে বসে একমনে পাঠ নিচ্ছে এই অরণ্য পাঠশালায়। আমাদের গাড়ির দিকে বিশেষ ভ্রুক্ষেপ তাদের নেই। এই অরণ্য পাঠশালাকে ক্যামেরা বন্দী করে এগিয়ে চললাম আরও গভীরে। পথে উল্টোদিক দিক থেকে আসা কোনো সাফারি জীপ পেলেই দাঁড় করিয়ে নাজিবুল্লা তাকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে জন্তু জানোয়ার কিছু চোখে পড়েছে কিনা। ইতিবাচক উত্তর কিছু পাওয়া গেলো না।
২৭:
নাজিবুল্লার সাথে এতক্ষন কথা বলেই বুঝে গেছিলাম বেতলার অরণ্যের প্রতিটি কোনা তার নখদর্পনে। তবে বন্য প্রাণীর দেখা পাওয়ার ব্যাপারটা নাজিবুল্লার জ্ঞানের সাথে সাথে আমাদেরও নসীবের পরীক্ষা বটে। বিস্তীর্ন অরণ্যের বুকের ওপর কাঁচা রাস্তার বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় ঢুকে আমাদের ৯ জোড়া চোখ এলোপাথারি খুঁজে চলেছে কিছু একটা। এই “কিছু” টা যে ঠিক কি, তা ওই মুহূর্তে কিন্তু কেউ সঠিক জানি না।
এই খুঁজে চলাটাই যে কি রোমহর্ষক তা প্রকৃত অরণ্য প্রেমিকরাই বুঝবেন। অরণ্য এখানে কোথাও বা গভীর নিশ্ছিদ্র, আবার কোথাও পাতলা। আমরা খেয়াল করছিলাম যে পথ অন্য কোন সাফারি জীপ মাড়িয়ে এসেছে, নাজিবুল্লা সেই পথে তৎক্ষণাৎ ঢুকছে না। এমনই একটি পথের বাঁকে এসে দেখা হলো অপর দিক থেকে আসা একটি জীপের সাথে। এটি বনদপ্তরের জীপ। তাঁদের মুখেও সেই একই কথা – গত ১০ মিনিট তাঁরা যে পথে এসেছেন তাতে কিছুই চোখে পড়েনি। এদিকে ২ ঘন্টা সাফারির দেড় ঘন্টা প্রায় আমরা নিঃশেষ করে ফেলেছি।
দিনের আলোর সাথে সাথে আমাদের বন্যপ্রাণ দেখতে পাওয়ার আশাও ক্ষীণ হয়ে আসছে। সামনের পথটিতে ঢুকেবো কি ঢুকবো না সে নিয়ে যখন নাজিবুল্লার মস্তিষ্কে বিভিন্ন তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই ওই পথেই ২০ হাত দূরে একেবারে রাস্তার মাঝখানে চোখে পড়লো একটি ” কমন হুপ”। মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে কি যেন খেয়েই চলেছে। এই হুপের ছবি তোলার জন্যই সব সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে ঢুকেই পড়লাম আমরা ওই রাস্তায়। এদিকটায় বাঁ দিকের তুলনায় ডান দিকের জঙ্গলের ঘনত্ব অপেক্ষাকৃত কম।
২৮:
গাড়ির সামনের সিটে আমি, লীনা আর ড্রাইভার। আমি বাঁ দিকের জানালার ধারে। মাঝের সিটে মান্না, স্নেহাংশু আর শুভদীপ। পেছনে বিদিশা আর কৌশিক। বাঁ দিকের জঙ্গল টি ঘন হওয়ায় আমাদের সকলেরই চোখ সেদিকে। পরীক্ষার হলে শেষ কয়েক মিনিট বাকি থাকতে পরীক্ষার্থীদের পেন যতটা জোরে চলতে থাকে, ঠিক ততটাই জোরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলেছি বাঁদিকের নিশ্ছিদ্র অরণ্যে। মুখে কারুর টু শব্দটি নেই, তা সে হতাশার জন্যই হোক বা একাগ্রতার জন্যই হোক।
এমত অবস্থায় হঠাৎ লীনার তীক্ষ্ণ অথচ সংক্ষিপ্ত আর্তনাদ – “হাতি !!!” আমরা যারা বাঁ দিকে তাকিয়ে ছিলাম তারা এতটাই বিস্ফোরিত চোখে সেদিকে তাকাতে লাগলাম তাতে সমূহ সম্ভাবনা ছিল আমাদের অক্ষিগোলক গুলি কোঠর থেকে বেরিয়ে এসে গড়িয়ে পরে যাওয়ার। কিছুই খুঁজে না পেয়ে এক ঝটকায় লীনার দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি মুখ হাঁ করে তাকিয়ে আছেন সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে। ওর চোখ অনুসরণ করে তাকাতেই গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেলো আমাদের। ডান দিকে গাড়ির পাশেই কিছুটা ফাঁকা জায়গা, টাঁর বলা যায়। টাঁরের ওপারেই মাঝারি উচ্চতার গাছের জঙ্গল। সেই জঙ্গল ভেদ করে সোজা টাঁরের দিকে এগিয়ে আসছে এক বিশালাকায় মহাকাল।
তার সাথে আমাদের গাড়ির দূরত্ব ৬০-৭০ ফুটের বেশি হবেনা। মুক্ত অরণ্যে এতটা কাছ থেকে এমন বন্য দানবাকৃতি এর আগে দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমাদের কারুরই হয়নি। বিস্ময় আর ভয়ের ক্রমাগত টানাপোড়েন চলছে মনের ভেতর। সেই টানাপোড়নে মাঝে মধ্যে ছিটকে আসছে অস্ফুট কিছু শব্দ – “ওহ মাই গড”, “এত্তো বড়”, “তাড়া করবে না তো”…ইত্যাদী। সাময়য়িক ঘোর কাটিয়ে উঠে ততক্ষনে আমাদের চোখে উঠে এসেছে ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডার। গাড়ির স্টার্ট অফ করার আর সাহস করেনি নাজিবুল্লা।
জীপের পাদানিতে দাঁড়িয়ে এক হাতে সাইডের রডটা পেঁচিয়ে, অন্য হাতে ক্যামেরাটি চালান করে দিয়েছি জীপের মাথার ওপর। গাড়ি ছেড়ে কেউ এক পাও যেন না নামে, এ ব্যাপরে প্রচন্ড কড়াকড়ি বেতলাতে। শুভজিত একবার নেমেও নাজিবুল্লা আর শঙ্করের যৌথ ধমকানিতে সঙ্গে সঙ্গে উপরে উঠে এসেছে। মূর্তিমান মহাকাল তখন ওদিকের জঙ্গলের ছেড়ে কোনাকুনি ভাবে টাঁরটির প্রায় মাঝ বরাবর চলে এসে আমাদের পর্যবেক্ষণ করে চলেছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। তার হাবভাবে অবশ্য মনে হলো সে আমাদের দেখে একটুও বিচলিত নয়। আর হবেই বা কেন! সে জানে যে আমাদের দিকে তার সামান্য একটি পদক্ষেপ বা একটি ব্রিঙ্গন আমাদের রক্ত হিম করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
মিনিট কয়েক এভাবেই সেও নিস্তব্ধ, আর আমরাও। আওয়াজ বলতে শুধুই মাঝে মাঝে ক্যামেরার শাটারের ওঠা নামার আওয়াজ। অবশেষে হাতিটি আমাদের গাড়িটিকে তার ডান দিকে রেখে টাঁরটি ডিঙ্গিয়ে এক রাজকীয় আলস্যে রাস্তা পার করে ওপর দিকের জঙ্গলে গিয়ে মিশে গেল। আমাদের জন্য সে রেখে গেল এক রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা যা এ জীবনে ভুলবার নয়।
২৯:
এবার ফেরার পালা। ১০ মিনিট মতো গাড়ি গড়িয়েছে নাজিবুল্লা। সদ্য পাওয়া “লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট” এর স্মৃতি রোমন্থনে ব্যস্ত আমরা সকলেই। হঠাৎ ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে ঠোঁটে তর্জনী চেপে আমাদের থামিয়ে দিলো নাজিবুল্লা। ইঙ্গিতে বোঝালো বাঁ দিকের জঙ্গলের দিকে তাকাতে। সূর্য পাটে যাওয়ার পরেও একটি ক্ষীণ আলো থেকে যায়। একে বলে ব্লু হওয়ার। গোধূলির সেই আলোতে বাঁ দিকের বনের মধ্যে কোন একটি জীবের নড়াচড়ার পরিষ্কার আভাস পেলাম। এত ক্ষীণ আলোতে অবয়ব টা সুস্পষ্ট নয়।
একটু ভালো করে দেখতেই বুঝলাম কোন একটি জীব নয়, ভারী চেহারার বেশ কয়েকজন সেখানে নড়াচড়া করছে। ধৈর্য্য ধরে আর কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করতেই তাদের মধ্যে এক দুজন ঝোপ ঝাড়ের আড়াল থেকে কিছুটা শরীর বার করে আমাদের দিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আধো আধাঁরে জ্বলজ্বল করে উঠলো তাদের চোখ। পায়ে তাদের লম্বা সাদা সাদা মোজা। বাইসন। হ্যাঁ, একদল বাইসন এতক্ষন ঝোপের আড়াল থেকে আমাদের পর্যবেক্ষণ করছিল।
নাজিবুল্লার মুখে একগাল হাসি। এই হাসি আত্ম তুষ্টির। ১৫ বছর ধরে এই জঙ্গলে গাড়ি চালাচ্ছে সে। পর্যটকদের ঠিক মতো সাইটিং না করাতে পারলে তাদের নিজেরও যে মনটা খচ খচ করে। ফেরার পথে বাকি রাস্তাটা পুরোটাই অন্ধকার পেলাম। হেড লাইটের আলোতে ছিন্নভিন্ন হতে থাকলো নিকশ কালো অন্ধকার। আলোর সেই অসির আঘাতে পথের ধারে জড় হয়ে থাকা হরিণের দল দলভঙ্গ হয়ে ছিটকে যেতে থাকলো গভীর অরণ্যে।
৩০:
প্রধান ফটকে পৌঁছে নাজিবুল্লা আর শঙ্কর কে নিয়ে রাস্তার উল্টোদিকের দোকানে চা আর সিঙ্গারা খেলাম। অনিল চায়ের দোকানের পাশে গাড়ি রেখে এখানেই অপেক্ষায় ছিল আমাদের। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারি সেই চায়ের দোকান ওয়ালাকে মুরগী কিনে এনে দিলে সে রুটি আর মুরগির মাংস বানিয়ে FRH এ নিয়ে আসবে সময় মতো। সারাদিনের ধকলের পর এর থেকে সুব্যবস্থা আর হয় না। কাছাকাছি একটি দোকান থেকে মুরগি কিনে তার জিম্মায় দিয়ে রওনা দিলাম FRH এর দিকে। ঘরে পৌঁছনোর আগেই বিদ্যুৎ বিভ্রাট। FRH এ সে রাত্রে আমরা ছাড়া আর কারো বুকিং ছিল না। কেয়ারটেকার শঙ্কর বাবুকে খুঁজে পেতে আনতে একটু বেগ পেতে হলো।ঘন্টা খানেকের বিদ্যুটা বিভ্রাটে মোমের আলোয় আড্ডা আর তার সাথে জাকির হোসেনের তবলা এবং রাকেশ চৌরাশিয়ার বাঁশির সঙ্গতটি স্পিকারে বেশ জমে গেলো। যথাসময় রুটি মাংস হাজির হলো। নৈশ ভোজের পর সেই রাত্রের মতো সকলেই অবসর নিলাম।
৩১:
গতকালের গেরিলা তৎপরতায় ভ্রমণের ন্যায় FRH এর আশপাশ টা ভালো করে দেখা হয়ে ওঠেনি। সকালে উঠে কম্পউণ্ডের ভেতরটা ক্যামেরা হাতে একটু পায়চারি করলাম। আমাদের বারান্দার সামনে মস্ত উঠোন। তার একেবারে অপর প্রান্তে আরও কয়েকটি কটেজ। উঠোনের পাশ দিয়ে সরু ইঁট বাঁধানো রাস্তা সেদিকে গেছে। নানা রকমের গাছ উঠোন টাকে ঘিরে আছে।
আজ পালামৌ এ আমাদের চতুর্থ এবং এবারকার মতন অন্তিম দিন। ফিরতি শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস আমরা ডাল্টনগঞ্জ থেকে ধরবো বেলা ১.২০ তে। বেতলা থেকে কেচকি ১০ কিমি আর কেচকি থেকে ডাল্টনগঞ্জ ১৭ কিমি। অর্থাৎ হাতে এখন পর্যাপ্ত সময়। ৮টা নাগাদ শঙ্কর বাবুকে বিদায় জানিয়ে চেক আউট করে সোজা চলে এলাম সেই চায়ের দোকানে। গরম গরম লুচি সবজি লিটটি খেয়ে অনিলকে নিয়ে রওনা দিলাম কেচকির পথে।
৩২:
বেতলা অভয়ারণ্যের গেট ছাড়িয়ে কিছুটা এগোতেই পেয়ে গেলাম অরণ্য মিউসিয়াম। আজ রবিবার, মিউসিয়াম বন্ধ। আমাদের সপ্ত সুরের অনুরোধ কিউরেটর সাহেব অবশ্য ফেলতে পারলেন না। ১০ মিনিটের মধ্যে দেখে চলে আসবো বলে তাকে কথা দিয়ে আমরা ভেতরে গেলাম। কাঁচের বাক্সে বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের কঙ্কাল এবং অস্থি বিশেষ সযত্নে সংরক্ষিত এই মিউসিয়ামে। একেবারে সামনের ঘরটিতে সুসজ্জিত আছে মাটির তৈরী পালামৌ অরণ্যের মডেল ম্যাপ এবং এই অরণ্যের বিভিন্ন জন্তু জানোয়ার দের মডেল। কিউরেটরকে দেওয়া কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আমরা যথাসময় বেরিয়ে এসে এগোলাম কেচকির পথে। আধ ঘন্টার মধ্যে অনিল আমাদের পৌঁছে দিলো একেবারে কেচকি অরণ্য নিবাসের গেটের সামনে। গত তিন দিনে পালামৌকে যে রূপে দেখেছি , কেচকি সঙ্গম তার ব্যতিক্রম। কোয়েল আর ঔরঙ্গা নদীর সঙ্গম এই কেচকি।
চওড়ায় কেউ কারুর থেকে কম যায় না এই দুই নদী। অরণ্যের গাঢ় রেখা ক্ষীণ হতে হতে এসে বিলীন হয়েছে নদী পারের বালিয়াড়িতে। দুই ধার থেকে দুই নদী এসে সৃষ্টি এক কোণের। সেখানেই তাদের সঙ্গম। বছরের এই সময় নদীতে হাঁটু জল বললেই চলে তবে বর্ষায় অবশ্যই তার দামাল রূপ। স্থানীয় মানুষ জনের অবাধ বিচরণ এপার থেকে ওপারের গ্রামে – কেউ বা পদব্রজে, কেউ বা সাইকেল নিয়ে অথবা কেউ বা মোটর সাইকেল নিয়ে। ভেঙে পড়া কংক্রিটের ব্রিজের মস্ত পিলার গুলো জানান দিচ্ছে একই সাথে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা এবং স্থানীয় মানুষ জনের দুর্দশার কথা।
নদীর পারে গাছের ছায়ায় বসে নদী সঙ্গমের এই ব্রতকথা পড়তে পড়তে কেটে যেতে পারে বেশ কয়েক ঘন্টা। বিশ্বরূপ আর শুভজিত যথারীতি লোভ সংবরণ না করতে পেরে গামছা জড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো জলে। ওদের জলকেলি শেষ হওয়ার পর আমরা রওনা দিলাম ডাল্টনগঞ্জের পথে। এইখান থেকে ডাল্টনগঞ্জ প্রায় ১ ঘন্টার রাস্তা। গাড়ি যখন ডাল্টনগঞ্জ স্টেশনের কাছে, চার দিনের আটকে থাকা লীনার একটি সুপ্ত বাসনা হঠাৎ প্রকট হলো – ” অনিল জী জব তক আপ মুঝে ধুসকা নেহি খিলাওগে , হম স্টেশন নেহি জায়েঙ্গে।”
এখানে বলে রাখি নোনতা মালপোয়া মতন খেতে ও দেখতে এই ধুসকা ঝাড়খণ্ডের এ তল্লাটে বেশ প্রসিদ্ধ এবং লোভনীয় একটি খাবার। পালামৌয়ে আমাদের এই অন্তিম আবদারটিকেও যথাক্রমে পূরণ করলো অনিল। ১ টা নাগাদ আমাদের ডাল্টনগঞ্জ স্টেশনে ছেড়ে বিদায় জানাল অনিল। এই চারটি দিনে ছেলেটি আমাদেরই একজন হয়ে উঠেছিল যেন। অনিলের গাড়িটা যে পথে চলে গেলো সেই দিকে বিষণ্ন বদনে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখের সামনে জল ছবির মতন ভেসে উঠছিল এই চার দিনের বিভিন্ন মুহূর্ত গুলো।
পালামৌয়ে যেমন সাক্ষী হয়ে থাকলাম এমন অজস্র চিরকাল মনে রাখার মতো বেশ কিছু মুহূর্তের, ঠিক তেমনই মনের গভিরে বাসা বেঁধে ফেললো সময়াভাবে না পাওয়া কিছু মুহূর্ত। যত্ন করে মনের মনিকোঠায় সাজিয়ে রাখলাম সেই না পাওয়া মূহুর্ত গুলি পরের বারের জন্য – মহুয়াডারের নেকড়ে অভয়ারণ্যে রহস্যের খোঁজ করা, কোয়েলের পারে বসে পাখির কুজন কান পেতে শোনা, নেতারহাটের হ্রদের পাশের ওই আদিবাসী গ্রামের পথে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানো আর মারোমার এর ওই রাত্রে পাহাড়ি পথ বেয়ে বেশ কিছুটা হেঁটে যাওয়া।
Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.
Can you pls. let me know the phone number of driver, Anil ? We are planning to travel to Ranchi/Netarhat.
9162637000
Hello Arijit babu… I would like to thank you for sharing such an adventurous journey with all of us. I am a rookie and knows nothing about travelling but have developed a late desire to do some travelling after reading and seeing glimpses thru pix of such breath holding scenaries.
Can u please provide the contact no. of that car rental Mr.Anil . All my best wishes for you sir.
Thanks…his contact no: 9162637000