Skip to content
Home » বারাণসী ভ্রমণ

বারাণসী ভ্রমণ

Share this in your social media

গঙ্গানিবাসী বারাণসী

 

| সুপ্রাচীন সভ্যতা |

সেই বরফের দেশ গোমুখ থেকে শুরু করে সমতলের গঙ্গাসাগর! মাঝে তাঁর যাত্রাপথে গঙ্গোত্রী, রুদরপ্রয়াগ, দেবপ্রয়াগ, হৃষিকেশ, হরিদ্বার, বিথুর, কানপুর, এলাহাবাদ, বেনারস, পাটনা, মুশিরদাবাদ, নবদ্বীপ এবং কোলকাতা। ভাবতেও অবাক লাগে – সেই একই নদী, অথচ কি ভিন্ন তার রূপ একেক জায়গায়। এরই মধ্যে গঙ্গা তীরে অবস্থিত আস্ত একটি শহর – বেনারস। Mark Twain এর কথায় –

” Benares is older than history, older than tradition, older even than legend, and looks twice as old as all of them put together.”

This is what Varanasi is. বেনারসের শিকড় খুঁজতে গিয়ে পৌঁছে যেতে হয় সেই আর্য্য সভ্যতার সময়। এমনকি হিন্দু বেদ উপনিষদেও কাশীর কথা বারবার আসে। শিব ঠাকুরের আপন শহর এই বেনারস। পূর্ণস্থানের আকর্ষণে না হোক, তবে ৩০০০ বছরেরও পুরোনো এই আদি শহরটিকে একবার চাক্ষুস দেখার লোভটাকে আর সংবরণ করতে পারলাম না। শীতের এক শুক্রবার বিকেলের হাওড়া-মথুরা চম্বল সুপেরফাস্ট আমায় পরদিন ভোর ০৪:৪৫ এ নামিয়ে দিলো মুঘল সরাই স্টেশনে। ভাবতেও পারিনি এই শীতে উত্তর ভারতের ট্রেন ৫ মিনিট বিফোর টাইম ঢুকিয়ে দেবে। ভোররাতের কনকনে ঠান্ডা হলেও অটো পেতে কোনো অসুবিধা হলো না। ওখান থেকে বেনারস ১৬ কিমি রাস্তা, প্রায় ৪০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম।

|গঙ্গা বিলাস|

দশাস্বমেধ ঘাটের আশপাশে খান দুয়েক হোটেলে খোঁজ করতে বুঝলাম তীর্থযাত্রী বা ভ্রমণপিপাসু মানুষজনের কোনো অভাব নেই, একটিতেও ঘর খালি নেই। এরই মাঝে কানে আসছে মাঝিদের চিৎকার – ” বাবু, সারে ঘাট ঘুমা দেঙ্গে। বোট চাহিয়ে?” এনাদেরই মধ্যে একজনের উপদেশে একটু এগিয়েই গলির ভেতর একটি হোটেল খালি পেয়ে গেলাম। একটু ফ্রেশ হয়েই সোজা ঘাটে এসে একটি বোট ঠিক করলাম, ১২-১৩ টি ঘাট ঘোরাবে ৪০০ টাকার বিনিময়। দিনের আলো ফুটলেও কুয়াশার জন্য একটা হালকা অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাব চারিদিকে।

দশাস্বমেধ ঘাটে তখন একটু একটু করে রং ধরতে শুরু করেছে বেনারসের।

গঙ্গার পার বরাবর যতদূর চোখ যাচ্ছে, সার সার নৌকা বাঁধা গায়ে গা লাগানো। দেখে মনে হয় এই শহরের একমাত্র যানবাহন বুঝি এই নৌকো। পুরো শহরটা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে গঙ্গার ওপর। কুয়াশা কাটিয়ে আমার বেনারসের প্রথম সূর্যের দেখা যখন পেলাম, তখন আমি মাঝ গঙ্গায়। সোনালী আভা গায়ে মেখে জেগে উঠেছে বেনারস। দেশি বিদেশী অনেকেই নৌকো নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। আকাশ জুড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে গাংচিলের ভিড় ( Sea Gulls )।

এই ঋতুতে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে এসে ওরা কিছুদিনের জন্য বেনারসেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমার মাঝির সাথে সাথে তারাও এখন আমার গাইড। নৌকোর এতটাই কাছাকাছি তারা উড়তে অভ্যস্ত দেখে মনে হবে আমরা একই পরিবারের সদস্য। একদিকে এই গাংচিলের দল, অন্যদিকে গঙ্গাপারে রঙিন বেনারসের ছবি আর প্রতিচ্ছবি দেখতে দেখতে একেক করে দশাস্বমেধ ঘাট, হরিশ্চন্দ্র ঘাট, চৌষট্টি ঘাট, কেদার ঘাট, ললিতা ঘাট, রাজেন্দ্র প্রসাদ ঘাট, নারদ ঘাট, মীর ঘাট, দারভাঙ্গা ঘাট, মণিকর্ণিকা ঘাট…..নাঃ আর থাক।

গভর্নমেন্টের খাতায় ৮৪ টা ঘাট আর মাঝিদের মুখে আপনি প্রায় ৩০০ র হিসেব পেয়ে যাবেন। প্রতিটি ঘাটের নিজস্ব গল্প আছে, মাঝি ভাইয়ের কাছে সেই গল্প শুনতে শুনতে বেশ কেটে গেল সকালটা।

| সারনাথ |

হিন্দুদের কাছে যেমন বেনারসের মাহাত্ব, ঠিক তেমনই সারনাথের মাহাত্ব বৌদ্ধদের কাছে। বুদ্ধগয়ায় দিব্যজ্ঞান লাভের পর গৌতম বুদ্ধ এই সারনাথেই ধর্মচক্র প্রবর্তনের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মের সূচনা করেন। শুধু ভারতবর্ষ নয়, সমগ্র পৃথিবীর দর্শনার্থীদের কাছে সারনাথ একটি অন্যতম আকর্ষণ। বেনারস থেকে সারনাথ ১০ কিমি রাস্তা। জলখাবার খেয়ে অটো ভাড়া করে রওনা দিলাম সারনাথের পথে।

বেনারসের ঘিঞ্জি ট্রাফিক ছাড়িয়ে বরুনা নদীর ব্রিজ টপকে সারনাথ পৌঁছতে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেলো। অটোকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে একেক করে ঘুরে নিলাম চীনা মন্দির, জাপানী বৌদ্ধবিহার, বার্মিজ মনাস্টারি, থাই মনাস্টারি, ডিয়ার পার্ক, ধর্মরাজিক স্তূপ, ধামেক স্তূপ, চৌখন্ডী স্তূপ এবং সারনাথ মিউসিয়াম।

ধামেক স্তূপ চত্বরেই অবস্থিত ছিল সম্রাট অশোকের সেই বিখ্যাত ১৫.২৫ মিটার উচ্চতার অশোকা পিলার। এখন অবশ্য পিলারটি মিউসিয়াম এ স্থানান্তরিত হয়েছে। পিলারের নিচের দিকের কিছুটা অবশ্য এই চত্বরেই সংরক্ষণ করা আছে এখনও, সেটির এক দিকে ব্রামভি ভাষায় এবং অন্য দিকে পালি ভাষায় বুদ্ধের বাণী খোদিত। সুবজ গালিচার মাজখানে স্তূপটি দেখবার মতন।

এই চত্বরেই আছে মূলগন্ধা কুটির যেখানে গৌতম বুদ্ধ ধ্যানে বসতেন। সারনাথ দর্শন সেরে যখন হোটেলে ফিরলাম তখন প্রায় বিকেল চারটে।

|কাশী বিশ্বনাথ|

দশাস্বমেধ ঘাটে গঙ্গা আরতি শুরু হয় ৬.৩০ থেকে (সময়টা সূর্যাস্তের সময় হিসেবে নির্ধারণ করা হয়)। তবে সঠিক জায়গা দখল করার জন্য অন্তত ১ ঘন্টা আগে আমায় ঘাটে পৌঁছতে হবে। অর্থাৎ মোটামোটি দেড় ঘন্টা সময় আছে হাতে এখন। হোটেলে ক্যামেরা মোবাইল রেখে দিয়ে কাশী  বিশ্বনাথ মন্দির দর্শনে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরের দিকের প্রবেশদ্বার থেকেই সিকিউরিটির বজ্র আঁটুনি দেখে মনে হতেই পারে যে আপনি নিজেই অপরাধী। ৫টি আলাদা আলাদা জায়গায় চেকিং হলো। গলিপথ দিয়ে এঁকেবেঁকে মূল মন্দিরে পৌঁছলাম।

কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের ইতিহাস অতি সুপ্রাচীন। আদি মন্দিরটি ভাঙ্গা পরে প্রথমে কুতুব উদ দিন আইবক এর আক্রমণে। এরপরেও দুদুবার মন্দিরটি বানানো হয় এবং ফের মুঘল আক্রমণে তা ধ্বংস হয়। তৃতীয় বারটি স্বয়ং সম্রাট আওরঙ্গজেব মন্দিরটি ধ্বংস করেন এবং সেই জায়গায় জ্ঞানব্যাপী মসজিদের প্রতিষ্টা করেন। বর্তমান কাশীবিশ্বনাথ মন্দিরটির প্রতিষ্টাতা হলেন অহল্যা বাই হলকার এবং তিনি এই বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করেন ১৭৭৬ সালে ঠিক জ্ঞানব্যাপী মসজিদের পাশেই। মূল মন্দিরের চূড়া এবং গম্বুজের জন্য মহারাজা রণজিৎ সিং প্রায় ৯২০ কেজি সোনা উপহার দেন। বর্তমান মন্দির এবং মসজিদের মাঝখানে আছে জ্ঞানব্যাপী পাথকুয়া। কথিত আছে মুঘল আক্রমণের সময় এই পাথকুয়াতেই মন্দিরের শিব লিঙ্গটি লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। বাবা বিশ্বনাথের দর্শন, জল দেওয়া এবং পূজো দেওয়া সেরে হোটেলে ফিরে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

|গঙ্গা আরতি|

দশাস্বমেধ ঘাট পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য। সবাই যে যার সুবিধামতো জায়গা নিয়ে ঘাটের উঁচু বেদী গুলোতে এবং সিঁড়িতে বসে গেছে। তবে নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে পার জুড়ে শ খানেক নৌকো দাঁড়িয়ে আছে….৫০ থেকে ১০০ টাকার বিনিময় এই আপাত স্থাবর নৌকোয় বসে সামনে থেকে দিব্যি গঙ্গা আরতি দেখা যাবে। এই নৌকোর ফাঁকে ফোকরেই তীর্থযাত্রীরা তাঁদের মনস্কামনার দ্বীপ জ্বেলে মা গঙ্গাকে অর্পন করছেন।

এমনই একটি নৌকায় উঠলাম বটে, তবে ছবি তোলার জন্য এঙ্গেল টা ঠিক মনঃপুত হলো না। ঠিক করলাম ভ্রাম্যমান থাকবো। তাতে বসতে পারবো না ঠিকই কিন্তু কয়েকটি মুহুর্তের হয়তো ভালো ছবি পেতে পারি। ঘাটের এপাশে ৭ জন এবং ওপর পাশে ৫ জন পুরোহিত নিজেদের জায়গা নিয়ে নিলেন।

সামনে তাদের সুসজ্জিত  বড় চৌকি,গেরুয়া কাপড়ে মোড়া। তার ওপরে সাজানো আরতির সমগ্র সরঞ্জাম। পুরোহিতদের পরনে রাজকীয় সিল্কের বসন…হ্যালোজেনের আলোয় উজ্জ্বল হলুদ আর রাজকীয় গোলাপির সংগতে তাঁদের প্রত্যেককে একেকজন দেবদূত মনে হচ্ছে। গঙ্গা কিনারে এ যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক সুবিশাল রাজ্যপাট! ঠিক ৬.৩০টা নাগাদ শঙ্খধ্বনি দিয়ে আরতির সূত্রপাত করলেন পুরোহিতরা। তারই সাথে ভেসে আসছে সুর –

” ওম জয় গঙ্গে মাতা, শ্রী জয় গঙ্গে মাতা। যো নর তুমকো ধ্যাতা, মন বাঞ্ছিত ফল পাতা। ওম জয় গঙ্গে মাতা….”

মাতৃ আরাধনা শুরু হলো একেক করে ধুপ, ধুনো, কর্পূর, প্রদীপ, সপ্তপ্রদ্বীপ, চামর, পাখা এবং ফুল দিয়ে। সাতটি দেবদূতের মনপ্রাণ এবং শরীর যেন একই সুরে একই সূত্রে বাঁধা।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো সাক্ষী থেকে গেলাম এই রাজকীয় আয়োজনের। ফেরার পথে পরের দিন চুনার আর বিন্দাচল এর জন্য একটি গাড়ি ঠিক করে নিলাম এক ট্রাভেল এজেন্টের থেকে। ভাড়া ১৯০০/- টাকা ঠিক হলো।

|চুনার ফোর্ট|

বেনারসে আজ আমার দ্বিতীয় দিন। সকাল সকাল তৈরী হয়ে ৮.৩০ নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম চুনার ফোর্ট এর উদ্দেশ্যে। ঘাট সংলগ্ন বড় রাস্তা ছাড়িয়ে ২-৩ কিমি যেতেই পেয়ে গেলাম এক অন্য বেনারসকে। ঝাঁ চকচকে রাস্তা আর তার সাথে তাল মিলিয়ে বেশ আধুনিক ঘরবাড়ি এই রাস্তায়। গঙ্গা পার করে পথে পেলাম রামনগর ফোর্ট।

গুটি পায়ে এগিয়ে দেখি ফোর্ট খুলবে ১০ টায়, ঘড়িতে এখন সবে ৯.০৭। চুনারের দূরত্ব ৩৩ কিমি আর চুনার থেকে বিন্ধ্যাচল আরও ৪৩ কিমি। শুনেছি চুনার থেকে  বিন্ধ্যাচল  রাস্তা খুব খারাপ হওয়ার দরুন সময় লাগবে প্রচুর তাই এখানে আর অপেক্ষা না করে রওনা দিলাম। হুহু করে ছুটে চলেছি আমরা। বেশ কিছুটা গিয়ে ডান হাতে একটি রাস্তা ধরে পেয়ে গেলাম লেভেল ক্রসিং। এর পরের রাস্তাটি বেশ সুন্দর।দুপাশে কয়েক ঘর ছোট ছোট গ্রাম সবুজের ফাঁকে ফাঁকে। একটু এগিয়েই আদ্রি পাহাড়ের পাকদন্ডী রাস্তা বেয়ে একেবারে চুনার ফোর্টের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে গেলাম ১০.৩০ টা নাগাদ।

বর্তমানে দূর্গটির রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বে আছে ইন্ডিয়ান আর্মি। ২৫০০ বছরেরও পুরোনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই চুনার দূর্গ। চুনার ফোর্টের আরেকটি নাম চরণাদরী। পৌরাণিক মতে সত্বযুগে স্বয়ং বিষ্ণু বামন অবতার নিয়ে মর্তে এসেছিলেন এবং দরিদ্র ব্রাহ্মণের বেশে বালি রাজার কাছে ৩ ফুট জমি ভিক্ষা চেয়েছিলেন। উদার রাজা বিষ্ণুকে তখন এই আদ্রি পাহাড়ের তিন ফুট জায়গা দান করেন। আদ্রি পাহাড়ে বিষ্ণুর চরণ পড়ায় তখন থেকে জায়গার নামকরণ হয় চরণাদরী। হ্যাঁ, চুনার কে চরণাদরী ও বলা হয়। ইতিহাসের পাতা বলে উজ্জইন অধিপতি রাজা বিক্রমাদিত্য চুনার দূর্গ নির্মাণ করেন তাঁর সংসার বিবাগী নির্জনবাসী ভ্রাতা ভারথারির জন্য। শেষ জীবনে এই ভারথারি নাকি এই দূর্গের এক প্রান্তে জীবন্ত সমাধি গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই দুর্গের দখল নেন একেক করে বাবর, শের শাহ সুরি, হুমায়ুন, আকবর এবং আওরঙ্গজেব। ১৭৬৮ সালে মুঘলদের সরিয়ে এই দূর্গ দখল করে ইংরেজরা। বহমান গঙ্গা এখানে ইংরেজী হরফের ‘S’ আকৃতি।

নদীর একেবারে কোল ঘেঁষে আদ্রি পাহাড় আর তার চূড়ায় এই চুনার ফোর্ট। দূর্গের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য গঙ্গার ওপার থেকে আসা শত্রুপক্ষের আগমন অনেক আগে থেকে ধরা পরে যেত। পাহাড়ের ওপর থেকে চুনার শহরটা পুরোটাই দৃশ্যমান।

একেক করে দেখে নিলাম সনওয়া মন্ডপ, রাজা বিক্রমাদিত্যের তাঁর রানীর জন্য বানানো সুবিশাল পাথকুয়া, শের শাহ সুরির রাজ দরবার এবং বন্দিদের জন্য মাটির নিচে বানানো কুখ্যাত কাল কোঠরী যেখানে আলো বাতাস ঢোকার একমাত্র রাস্তা ছিল ছোট্ট একটি ফুটো।

কথিত আছে হাজার হাজার বন্দি এই কাল কোঠরীতে প্রাণ ত্যাগ করেছেন এবং আজও রাত্রে সেই সহস্র মানুষের হাহাকার বাতাসে ভেসে আসে ফিসফিসিয়ে। শের শাহ সুরির দরবারটি ইংরেজ আমলে ওয়ারেন হেস্টিংস সাহেব তাঁর বাংলো হিসেবে ব্যবহার করতেন এবং আজ এটি PWD র গেস্ট হাউস। দরবারের পাশ থেকে বেরিয়ে আসা ঝুল বারান্দা বা ঝারোখা টি সত্যি দৃষ্টি আকর্ষণ করে, রানীমা এই বারান্দা থেকেই রাজ দরবারের অনুষ্ঠান দেখতেন বা অংশগ্রহণ করতেন।

|বিন্ধ্যাচল|

“বিন্ধ্যা হিমাচল যমুনা গঙ্গা, উচ্ছল জলধি তরঙ্গ।”

সেই ছোটবেলা থেকে আজ অবধি জাতীয় সংগীতের এই পংক্তি টা মনের মধ্যে ঘর বেঁধে ফেলেছে পাকাপাকি ভাবে। হিমালয়…হিমাচল ছুঁয়ে এলেও বিন্ধ্যা রেঞ্জ আমার কাছে এখনো অধরা। চুনার থেকে বেরিয়েই রং তুলি দিয়ে মনের ক্যানভাসে বিন্ধ্যাচল পর্বত শ্রেণীর একটি জলছবি আঁকতে থাকলাম, আর কিছুক্ষণ পরেই যে এই ছবি বাস্তবায়িত হবে! চুনার আর  বিন্ধ্যাচল দুটোই মির্জাপুর ডিস্ট্রিক্টে পরে। দূরত্ব যতটা না,তার থেকে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর রাস্তার অবস্থা। যত এগোচ্ছি দুপাশের রুক্ষতা আরও বাড়ছে আর তার সাথে তাল মিলিয়ে ধুলোর ঝড় আর খানা খন্দে ভরা জীর্ণ রাস্তা। গতিবেগ ৩০-৪০ এর ওপর ওঠানোই দায়।

প্রায় ২ ঘন্টা এইভাবে যুদ্ধ করে নিজের শিরদাঁড়াকে তার নিজস্থানে অক্ষত রাখতে সক্ষম হয়ে বাঁ দিকের একটি সরু রাস্তা ধরলাম। ঝাঁকুনিতে ততক্ষনে আমার মনের ক্যানভাসে তৈরী হওয়া বিন্ধ্যাচলের ছবিটি ধুয়ে যেতে শুরু করেছে  চলকে পরা জলে। বিন্ধ্যাবাসিনি মন্দিরের কাছে এসে যখন নামলাম তখন ছবিটা একেবারেই মিলিয়ে গেল। কোথায় পাহাড়, এতো শুধুই সমতল! বিন্ধ্যাবাসিনি মন্দির, কালী খোহ মন্দির এবং মা অষ্টভুজা মন্দির…বিন্ধ্যাচলের এই তিন মন্দির দর্শনকে বলা হয় ত্রিকোণ যাত্রা।

দেবীর ১০৮টি সতীপীঠের মধ্যে বিন্ধ্যাবাসিনি অন্যতম। কথিত আছে দ্বাপর যুগে দেবকী এবং বাসুদেবের ঘর আলো করে কৃষ্ণের জন্মানোর পর বিষ্ণুর আদেশে মহামায়া জন্ম নেন গোকুলে নন্দ এবং যশোদার কোলে। কংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বাসুদেব কৌশলে কৃষ্ণকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন গোকুলে নন্দর কাছে এবং তাঁর জায়গায় যশোদা কন্যা রূপী দেবী মহামায়াকে কারাগারে নিজের কাছে এনে রেখেছিলেন। কংস যখন কৃষ্ণ ভেবে এই কন্যা সন্তান কে হত্যা করতে যান কন্যাসন্তানটি তাঁর হাত থেকে পিছলে বেরিয়ে এসে মহাদেবী আদিশক্তির রূপ ধারণ করে দৈববাণী করেন যে কংসের মৃত্যু কৃষ্ণের হাতেই লেখা আছে এবং সে অন্য জায়গায় বাড়ছে। এরপর মহাদেবী মহামায়া বিন্ধ্যাচলে এসে আশ্রয় নেন। বিন্ধ্যা তে নিবাস তাই দেবী এখানে বিন্ধ্যাবাসিনি।

দর্শন সেরে এগোলাম ৬ কিমি দূরের কালী খোহ মন্দিরের দিকে। দূরে নীলচে পাহাড়ের রেখা দেখে মুছে যাওয়া জলছবিতে আবার একটু একটু করে রং ধরতে শুরু করলো।

রাস্তাটিও বেশ সুন্দর, হালকা পাহাড়ী চড়াই অতিক্রম করে প্রথমে যে মন্দিরটায় পৌঁছলাম সেটিও একটি গুহা কালী মন্দির তবে কালী খোহ নয়। কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতেই দেখি এক জায়গায় হাজার হাজার রং বেরঙের চেলী কাপড় বাঁধা আর তার ওপর একটি মাটির হাঁড়ি…এটি মানত করার জায়গা।

গুহাটির উচ্চতা যতটা তাতে আমার ৫ফুট ৮.৫০ইঞ্চির দেহটাকে একটু কুঁকরেই ঢুকতে হলো। আলো আঁধারিতে রাখা বিগ্রহটি দেখে মনে হলো এটি একটি শিলাখন্ড। বেরিয়ে একটু এগিয়েই পেয়ে গেলাম কালী খোহ মন্দির। ভক্তদের ভিড়ে রীতিমত লাইন পরে গেছে।

ভালো করে দেখলে বোঝা যায় বড় একটি গুহাই এখানে মন্দির। মহাকালী এখানে অসুর রক্তবীজ নিধনকারীনি দেবী দূর্গা রূপে পূজিত। ত্রিকোণ পরিক্রমার তৃতীয় মন্দিরটি হলো দেবী অষ্টভূজা মন্দির। দেবী এখানে মহাসরস্বতী হিসেবে পূজিত।

ত্রিকোণ পরিক্রমা শেষ করে যখন বেনারস ফিরলাম তখন গঙ্গা আরতি সময় প্রায় হয়ে এসেছে। হোটেলে না ফিরে সোজা চলে গেলাম ঘাটে। কাল যে নৌকাগুলো আরতি দেখার জন্য ১০০ করে হাঁকছিলো, আজ দেখলাম তারাই ১০ এ নেমে এসেছে।

আজকের গঙ্গা আরতি নৌকো থেকেই দেখলাম। আজ আমার বেনারসের শেষ রজনী, তাই আরতির পর একটি নৌকোয় চেপে বেরিয়ে পড়লাম গঙ্গা বক্ষে রাত্রের বেনারসের ঘাটগুলোর রূপ উপলব্ধি করতে। দশাস্বমেধ ঘাটের সুসজ্জিত ১২ টি বেদী মাঝগঙ্গা থেকে দেখা সত্যি এক অভিনব অভিজ্ঞতা।

ওদিকে মণিকর্ণিকা ঘাটের চিতার আগুন তখনও জ্বলে চলেছে দাউ দাউ করে। গতকাল অত ভোরেও এই আগুন আমি দেখেছি…সত্যিই মণিকর্ণিকার আগুন কখনো নেবে না। প্রতিটি ঘাটই তার নিজস্বতায় মোহময়ী রূপে সজ্জিত….নৌকায় বসে মনে হলো এ যেন চরাচর ব্যাপী এক বায়োস্কোপ যার প্যানরেমিক স্ক্রিনে কোনো এক চলচিত্র উৎসবে মেতে আছে পুরো বেনারস।

|বেনারসের রোজনামচা|

সকালে উঠে বুকের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগলো। আজ ফেরার পালা। বিভূতি এক্সপ্রেস বেনারস স্টেশন থেকে ছাড়বে সেই সন্ধ্যে ৬.০৮ এ। অতএব অগাধ সময় হাতে।অনুভব করলাম মনটা কোথাও যেন অপুর্ন রয়ে গেল। বেনারস মানে তো শুধু নৌকোয় করে ঘাট দেখা নয়। বেনারস মানে তো শুধু কাশী বিশ্বনাথ বা গঙ্গা আরতি নয়। বেনারস মানে তো শুধু সারনাথ, চুনার আর বিন্ধ্যাচল নয়। এর বাইরেও বেনারসের ঘাটগুলোর আর তার সংলগ্ন গলি গুলোর যে রঙবাহারী জীবন যাপন, তা যে এখনো পুরোপুরি উপল্লবধি হয়নি আমার! ১১ টায় চেক আউট করে বেরিয়ে পরে সোজা দশাস্বমেধ ঘাটে গিয়ে বসলাম। পাশেই দেখি এক ছাইভস্ম মাখা সাধু তাঁর অস্থায়ী আস্তানাতে বসে দিব্যি কল্কেতে টান দিতে দিতে এক বিদেশী পর্যটকের সাথে সাপলুডু খেলতে বসেছে।

পাশে রাখা তাঁর কমন্ডুল এবং ত্রিশূলের মাথায় গাঁদা ফুলের মালা। একটু দূরে আরেক গেরুয়া বসনা সাধু সকালের রোদে পিঠ দিয়ে কোনো এক হিন্দি দৈনিক খবরের কাগজের পাতাতে চোখ বোলাচ্ছেন।

সন্ধ্যাবেলায় যে বেদীগুলোতে পুরোহিতরা গঙ্গা আরতি করছিলেন সেগুলো এখন জ্যোতিষিদের দখলে, বেতের ছাতার নিচে পসার সাজিয়ে বসে তাঁরা এখন দেশ ও দশের ভাগ্য নির্ধারণে ব্যস্ত।

দশাস্বমেধ ঘাটে পাশেই মানমন্দির ঘাট রাজা মান সিং এর নামে। এই ঘাটেই আছে মান মহল এবং মানমন্দির (observatory). টিকিট কেটে ঢুকে দেখে নিলাম রাজা মান সিং এর এই মহল এবং পাথরের তৈরী সম্রাট যন্ত্র, লঘু সম্রাট যন্ত্র, দক্ষিণবীথি যন্ত্র, চক্র যন্ত্র, দিগাংশা যন্ত্র এবং নারীবলয় দক্ষিণ উত্তর গোলা।

মহলটির ছাদে যেখানে যন্ত্রগুলো রাখা আছে, সেখান থেকে গঙ্গা পাড়ের বেনারসের অসামান্য ভিউ পাওয়া যায়।মহল থেকে বেরিয়ে ঘাট ধরেই হাটতে থাকলাম। পায়ে পায়ে চলে এলাম নেপালী ঘাটে। সেখানে দর্শন পেলাম পশুপতিনাথ মন্দির নেপালী ঘরানায় তৈরী।

এরপর মণিকর্ণিকা ঘাট এবং তার সংলগ্ন কুন্ড। স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু মহাদেব কে খুশি করার জন্য তাঁর চক্র দিয়ে এই কুণ্ডের সৃষ্টি করেন। খুশি হয়ে শিব বর দেন যে এই তীর্থ পবিত্রতম তীর্থ হিসেবে গণ্য হবে মর্তে এবং এই কুণ্ডে যাঁরা শাস্ত্রমতে স্নান করবেন তাঁরা মোক্ষ লাভ করবেন। এরপর শিব পার্বতী এই কুণ্ডে পবিত্র স্নান করেন। স্নান সেরে শিব আনন্দে যখন তাঁর মাথা ঝাঁকান তখন তাঁর কানের দুল এই কুণ্ডে পরে যায়। সেইথেকেই কুণ্ডের নামকরণ হয় “চক্র পুস্করিনী মণিকর্ণিকা কুন্ড”।

হিন্দুদের বিশ্বাস মণিকর্ণিকা ঘাটে শেষকৃত্য সম্পন্ন হলে স্বর্ণলাভ নিশ্চিত আর সেই কারণেই বহু মানুষ জীবনের শেষ কটা দিন বেনারসে এসে ঠাঁই নেন। মণিকর্ণিকা ঘাটের পাশেই সিন্দিয়া ঘাট যেখানে অর্ধ নিমজ্জিত শিব মন্দিরে আজও দৃশ্যমান। কথিত আছে মন্দিরটি নির্মাণের পরেই ভার সামলাতে না পেরে অর্ধেকটা গঙ্গা বক্ষে ধসে যায়। সেইথেকে এভাবেই পরে আছে মন্দিরটি।

ঘাট থেকে উঁচু সিঁড়ি উঠে গিয়ে মিশেছে বিভিন্ন অলিগলিতে। হাতে সময় তো অনেক। ক্ষতি কি এই অজানা ভুলভুলিয়া গলিতে একটু হারিয়ে যেতে?

অলস পদক্ষেপে নিজেকে হারালাম একের পর এক সরু গলিতে। বহু প্রাচীন বাড়িঘর আর ততোধিক আদি ঐতিহ্য যেন চুঁয়ে চুঁয়ে বেরোচ্ছে একেকটি পাড়া থেকে। চোখে পড়লো বেশ কিছু বাড়িতে বাইরের দেওয়ালে লাগানো পোস্ট বক্স। আজও এখানে ঠিকানা বলতে পোস্ট বক্স নং।

৪ ফুটের গুলিগুলোতেই কোথাও বা ষাঁড় পথ আটকে দাঁড়িয়ে, কোথাও বা গলির পাশেই বাড়ির রকে সবজি বাজার আবার এমনই কোনো এক গলির বাড়ির নিচের কয়েকটি ঘরে রংবাহারি দোকান পসরা সাজিয়ে বসে গেছে।

গলি ঘুঁজির ভুলভুলিয়া তে সত্যি হারিয়ে ফেললাম আমার আমিকে। বাড়িগুলোর দেওয়ালে আঁকা সহস্র বছর আগের রাজ্য এবং রাজ্যপাটের মধ্যে যেন নিজেকেও খুঁজে পেতে লাগলাম। বেনারসের জীবনযাত্রার এক মিষ্টি  রামধনু রং বুকের ভেতর নিয়ে এবং আবার ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি নিয়ে রওনা দিলাম স্টেশনের পথে। ট্রেনে বসে ক্যামেরার LCD তে আমার তোলা ছবিগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে আমার ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা হাসি দেখে উল্টোদিকের সহযাত্রীর প্রশ্ন –

“দাদার হাসি দেখে মনে হচ্ছে দারুন ঘুরলেন?”

“ভালোবেসে ফেললাম আমার বেনারসকে!” – আমার স্বগতোক্তি!!

© Arijit Kar

4.7 3 votes
Article Rating

I am eager to know your views on this post. Please leave a reply

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
error: Content is protected !!
%d bloggers like this: