১:
পৌঁছাতে বেলা গড়িয়ে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। এদিকে আকাশে মেঘের ঘনঘটা। পথে বৃষ্টিও পেলাম। শংকর দা কে মধ্যাহ্নভোজের অর্ডার টা দিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বেশ গুছিয়ে বসলাম। ঠিক করলাম, বিকেলের দিকেই একটু বেরুবো অরণ্যের অনুভুতি টা নেওয়ার জন্য। অবশ্য প্রধান ফটক দিয়ে ঢোকার সময় ফরেস্ট এর কর্মচারীদের অতিথি বৎসুলতায় মুগ্ধ হয়ে কিভাবে কখন ঘুরবো, তার পরিকল্পনা টা তখনই করে ফেলেছিলাম। বেশ VIP treatmennt ওনাদের। বাইরের visitor দের জন্য গেট তখন বন্ধ। Online booking এর কাগজ টা দেখাতেই স্বাদর অভ্যর্থনা। ওনাদের সাথে তখনই একটু গল্প করে জানলাম বাইরের visitor দের জন্য ২টো থেকে ৪টা গেট খোলা বেথুয়াডহরি অভয়ারণ্য।
আমি যেহেতু forest বাংলো বুক করেছি, আমার জন্য অরণ্য সারাক্ষন খোলা। কখন কিভাবে এই গহন অরণ্যের প্রতিটি মূহুর্ত আমি উপভোগ করবো, তা আমার ওপর। আর তাই স্বাভাবিক ভাবেই যখন বাইরের ভিসিটর এর পালা শেষ হবে, তখন আমার exploration শুরু হবে। বুঝলাম বিকেল 5 টার পর থেকে ১৬৭ একর এর বেথুয়াডহরি শুধু আমার আর গুটিকয়েক ফরেস্ট এর কর্মচারীদের দখলে!!
২:
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের কোনো এক সন্ধ্যে। বর্ষা এসে গেছে। চপ মুড়ি খেতে খেতে মন টা খালি টানছিলো অরণ্য ভ্রমণের জন্য। ভাবছেন বর্ষায় অরণ্য তো বন্ধ। ঠিকই। ডুয়ার্সের সমস্ত অরণ্য বন্ধ বর্ষায়। কিন্তু বর্ষায় জঙ্গলের যে রূপ তা যে অন্য কোনো সময় খুঁজে পাবো না। সেই রূপের খোঁজেই খুঁজে পেলাম বেথুয়াডহরি অভয়ারণ্য। বন্ধ থাকে না বর্ষায়। হোক না মাত্র ১৬৭ একর। তবু তো সে অরণ্য। হরিণ, ঘড়িয়াল, টার্টল, গোসাপ, পাইথন, শিয়াল (এটা বনকর্মী দের কথায়) এবং প্রচুর পাখি….এসব তো পাবই। তাই বেথুয়াডহরি।
৩:
অল্প রেস্ট নিয়ে বিকেল ৫.৩০ টায় বেরোলাম। সঙ্গে শুধু ক্যামেরা এবং অবশ্যই একটি প্যাকেট (ঠেকে শিখেছি বৃষ্টি না পড়লেও একটি প্যাকেট সঙ্গে রাখা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ক্যামেরার রক্ষারতে)। জুন মাসের ৫.৩০ হলেও আলো খুবই কম কারণ মেঘেদের আন্দোলন তখনও শেষ হয়নি। কটেজ থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের সরু রাস্তা ধরলাম। একটু সোজা হেঁটে বাঁ দিকের আরো সরু রাস্তা একটা ধরলাম। কয়েক পা এগোতেই অনুভব করলাম আমার দিকে কে যেন তাকিয়ে আছে। I am being watched. মুখ তুলেই বুঝলাম বেথুয়াডহরি আসার প্রথম স্বার্থকতা আমি পেয়ে গেয়েছি। হ্যাঁ। আমার ঠিক ১৫ ফুট দূরেই সেই ফালি রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে এক হরিণ শাবক।
আহ্লাদে আটখানা হয়ে ক্যামেরার লাইট মিটার এ চোখ রেখে বুঝলাম ট্রাইপড টা না এনে বেশ ভুল করেছি। ISO বেশ খানিকটা না বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। যাইহোক। ম্যানুয়াল অ্যাডজাস্টমেন্ট করে ভিউ ফাইন্ডার এ চোখ রেখে বেশ চমকে গেলাম। শাবকের পাশে তার মা। তার সিং এর বাহার দেখে প্রথম দর্শনে একটু ভয় লাগবেই। কারণ এত আর চিড়িয়াখানা বা ডিয়ার পার্ক নয়। হরিণ এবং আমি….আমরা এক একই অরণ্যের সহবাসী এখন। সিং নাড়িয়ে যদি তাড়া করে আমাকে, বর্ষায় পিচ্ছিল রাস্তা দিয়ে জোরে ছোটাও যাবে না। তবে ওরকম কিছুই হলো না। মা হরিণ টা তার সমস্ত ইন্দ্রিয় নিক্ষেপ করে আমার মুভমেন্ট ফলো করছিল। আমার common sense বলছিল, আমার একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা উচিত চুপচাপ যাতে করে ওরা বুঝতে পারে আমি ওদের কোনো ক্ষতি করতে আসিনি। এক দুটো ফটো নিয়ে…এক পা এগোলাম। এগিয়েই বুঝলাম ভুল টা করে ফেলেছি। মা এবং শাবক….দুজনেই একছুটে গহন অরণ্যে মিশে গেলো। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, বেথুয়াডহরির অরণ্য আয়তনে ছোট হতে পারে কিন্তু গভিরতা কোনো অংশে কম নয়। দিনের আলো থাকা সত্ত্বেও অরণ্যের বেশিরভাগ জায়গা অন্ধকার ।
যাইহোক। ঠিক করলাম, আরো সতর্ক পায়ে এগোতে হবে। এগিয়ে চললাম সেই ফালি রাস্তা ধরে গভীরে…আরো গভীরে। আলো আরো কমে এসেছে। ঝিঁঝি পোকার ডাক চারিদিকে…প্রচন্ড কানে লাগছে। অরণ্যের এই এক বৈশিষ্ট। একটু গভীরে এলেই নিস্তব্ধ চারিদিক। যেন পিন পড়লেও শোনা যাবে। আশপাশের গাছগুলো আধো অন্ধকারে যেন একেকটা রহস্যময় জীব। বেশ গা ছমছম করছে। নিজের মন কে বোঝালাম এই অরণ্যে হিংস্র প্রাণী নেই। হরিণ তো আর মানুষ খায় না। পরমুহূর্তেই মনে পড়লো বনকর্মীর কথা…গোসাপ, পাইথন, শিয়াল!!! সতর্ক হয়ে এগোতে থাকলাম। আমার চোখ দুটো স্তরে ঘোরাফেরা করছে।
সামনে হরিণ দেখার পিপাসা। আর নিচে পাইথন বা গোসাপ এর ভয়। যাইহোক। সেই ফালি রাস্তা ঘুরে ঘড়িয়াল পুকুরের দিকে যায়। সেখানে এসে দেখি দুটি ঘড়িয়াল আপত্তিজনক অবস্থায় বিরাজমান। দুইজনে চুমু খাচ্ছেন কিনা বুঝলাম না।
আমার দিকে অবশ্য তেনাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এদের বিদায় জানিয়ে এগোতে থাকলাম। এদিকে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। গায় না পড়লেও বুঝতে পারছি আওয়াজে….পাতায় পাতায় । ক্যামেরা তখনও ব্যাগ এ ঢোকাইনি কারণ অরণ্য এত গভীর যে বৃষ্টি খুব জোরে না পড়লে আমার গায়ে লাগবে না। এমন সময় একটা আওয়াজে পিলে চমকে গেল। ঠিক আমার ডান পাশের ঝোপ গুলো থেকে খসখস করে একটা আওয়াজ পেলাম। বেশ জোরে। ওটা হাওয়া বা বৃষ্টি নয়। কিছু একটা নড়ে চলে গেল। অন্ধকারে ঠাওর করতে পারলাম না। একা হাটছি। একটু ভয়ও পেলাম এবার। এগিয়ে চললাম। ১০ পা এগিয়েই বুঝলাম আমি কার আওয়াজ শুনেছি। আমার সামনে ২০ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে সিং ধারী বেশ বড়ো size এর একটি হরিণ। একেবারে রাস্তার মাঝামাঝি। আলো এত কম, জানি ফটো ভালো আসবে না। যতটা ISO বাড়ানো যায় ততটা বাড়িয়ে ছবি নিলাম।
আর দাঁড়ায়নি। এইবার একটু জোরেই পা চালালাম কারণ বৃষ্টি বেশ জোরেই পড়ছে ততক্ষণে। ক্যামেরা প্যাকেট এ ঢুকিয়ে নিয়েছি। দেখতে দেখতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলো। সে কি আওয়াজ। অরণ্যের বৃষ্টি এক অন্য জিনিস। আমার হাতে option দুটো। এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা যেখানে বৃষ্টি গাছের ঘনত্ব ভেদ করে অতটা ঢুকছে না। নতুবা ভিজে ভিজে বাংলো তে ফেরা। ২-৫ মিনিট দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় তাই choose করলাম। ক্যামেরার প্যাকেট টা বুকে জাপটে ধরে সজোরে পা চালালাম…বাংলোর দিকে। ফিরে শংকর দা কে দিয়ে গরম চা আর ফুলুরি আনিয়ে বেশ ধাতস্ত হলাম।
৪:
ঘুম টা ভালোই হলো কাল রাত্রে। গরমের লেশ মাত্র ছিল না। বৃষ্টি প্রায় সারারাত হয়েছে। সকাল ৭ টার মধ্যে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
প্রথমে গেলাম জঙ্গলের মধ্যেই একটি মিনি zoo তে। হ্যাঁ। নীলগাই, ময়ূর, painted stork, বাঁদর, খরগোশ ইত্যাদিতে ভরা এই মিনি zoo।
বাইরের ভিসিটর দের হরিণ দেখার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ ভিসটিং hour এ তেনারা গভীর জঙ্গলেই থাকতে অভ্যস্ত। কাজেই বাইরের জনতার জন্য এই মিনি zoo টাই প্রধান আকর্ষণ। জানতাম যে সকালের দিকে হরিণকে খেতে দেওয়া হয়। ওদের কিছু কিছু জায়গা আছে। সেই জায়গা গুলো খাবার ঢেলে দিয়ে বনকর্মীরা চলে যায়। আগের দিন বিকেলে বেরিয়ে মোটামোটি আইডিয়া করে নিয়েছিলাম কোথায় কোথায় এই খাওয়ার জায়গাগুলি আছে। খুব সহজেই আজ হরিনের দেখা পেয়ে গেলাম সেই জায়গা গুলোয়। আজ কিন্তু ওরা আমায় দেখেই দৌড় মারলো না। প্রথম জায়গাটায় গিয়ে দেখলাম প্রায় ৬ টা হরিণ একসাথে।
আমায় দূর থেকে দেখে এলার্ট হয়ে গেল ঠিকই তবে পিছটান মেরে দৌড় লাগলো না। বরং একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম। খেয়াল করলাম, বাকিরা যখন খেতে ব্যস্ত, কোনো একটি হরিণ তখন কান খাড়া করে সোজাসুজি আমার দিকে তাকিয়ে। আমার প্রতিটি মুভমেন্ট ও মাপছে।
মনে হচ্ছে ও যেন দলের সিকিউরিটির দায়িত্বে আছে। যাইহোক। আজ আর আমায় আটকাবে কে। ২০- ২৫ ফুট এর দূরত্বে আমার সামনে খোলা স্বাধীনভাবে হরিনের সংসার। মনের সুখে ছবি তুলতে লাগলাম। একটা খাবারের জায়গায় বেশ কিছুক্ষন কাটালাম। ছবি তুললাম। ওদের ব্যবহার গুলো বোঝার চেষ্টা করলাম। বেশ একটা ছন্দ আছে ওদের। আর হ্যাঁ। সদা সতর্ক। সামান্যতম আওয়াজই ওরা সবাই খাবার ছেড়ে মুখ উচু করে বোঝার চেষ্টা করছে…কোনো বিপদ ধেয়ে আসছে কিনা। বেশ লাগছিলো দেখতে।
একটু পরে হাঁটা লাগলাম অন্য দিকের খাবারের জায়গাটার দিকে। এসে দেখলাম এত পুরো হরিনের একান্নবর্তী পরিবার!!!! কে নেই সেখানে। আর দলবদ্ধ ভাবে আছে বলেই হয়তো দুঃসাহস টাও বুঝলাম একটু বেশি…..আমাকে অনেকটা কাছাকাছি যাওয়ার অনুমতি দিলেন এইবার ওনারা!!! প্রাণ ভরে….একেকটা করে কম্পসিশন সাজালাম ভিউ ফাইন্ডার এ আর লেন্স বন্দি করলাম ওনাদের।
এবার ফেরার পালা। বাংলো তে ফিরে রেডি হয়ে ঠিক উল্টোদিকের নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার টা একবার চাক্ষুস দেখে বাস ধরে চলে এলাম কৃষ্ণনগর সদর। সেখান থেকে টোটো তে করে কৃষ্ণনগর স্টেশন। কৃষ্ণনগর লোকাল কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে এলো। জানলার ধার নিয়ে বসে পড়লাম। এক সুন্দর, সুস্থ, বরষাস্নাত অরণ্য সুন্দরীর প্রেমে আসক্ত হয়ে…আবার ফিরে আসার আশা নিয়ে বেথুয়াডহরি কে বিদায় জানালাম।
কিভাবে যাবেন:
______________
কৃষ্ণনগর থেকে বাস এ ৪০ মিনিট। আর তাছাড়া শিয়ালদা থেকে লালগোলা ধরলে একেবারে বেথুয়াডহরি তেই নামতে পারবেন। Drive করে গেলে….NH34 এর একদম লাগোয়া এই অভয়ারণ্য।
Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.