রূপের ভাণ্ডার, ভান্ডিরবন
শান্ত সবুজ ছোট্ট সে গ্রাম। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সুন্দরী ময়ূরাক্ষী। তির তির জলধারায় বালুচরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা নদীটির সে এক মোহময়ী রূপ। পুকুরে ফোঁটা শালুক, পদ্ম, নাম না জানা আরও কত ফুল। ঝির ঝির হাওয়ায় গাছের পাতার কানাকানিতে রটে যায় অতিথি আসার খবর। অতিথি আপ্যায়নে আরও সুশীতল হয় ছায়া, আরও সুমধুর হয় সমীরণ। আবছা ভেসে আসে দূরের মন্দিরের ঘন্টা ধ্বনি, পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ। মন ভাল হয়ে গেল তো?
শহুরে হল্লা আর দুঃসহ দূষণের হাত থেকে অনেক দূরে এমন একটা গাঁয়েই আজ যাব আমরা। গ্রামের নামটি? ভান্ডিরবন। শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব— তিন ধারার তিন মন্দিরের অপূর্ব সহাবস্থান।
শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে আমাদের এবারের গন্তব্য। তাই সকাল সকাল বেরলেই ভাল হয়। আমিও ভোর ভোরই বেরিয়েছি। কলকাতা থেকে সরাসরি যেতে হবে সিউড়ী। ধর্মতলা থেকে বাস তো রয়েইছে। হাওড়া থেকে রয়েছে ট্রেনও। তবে ট্রেনে গেলে হুল এক্সপ্রেসই ভাল। কারন এটিই পৌনে সাতটায় ছেড়ে মোটামুটি সাড়ে এগারোটা নাগাদ পৌঁছয়। বাকি যে দুটি ট্রেন আছে সিউড়ী এক্সপ্রেস এবং ময়ূরাক্ষী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার সে দুটিতে গেলে দিনের দিন ফেরা অসম্ভব। আমি অবশ্য ধর্মতলা থেকে বাসেই চেপেছিলাম ভোরে। মাঝে শক্তিগড়ে প্রাতরাশ সেরে সেই বাস সিউড়ী পৌছল সকাল সাড়ে নটা নাগাদ। বাস স্ট্যান্ড থেকে খটঙ্গা যাওয়ার ট্রেকার পাওয়া যায়। ভান্ডিরবনের লাগোয়া গ্রাম খটঙ্গা। চেপে বসলাম সেই ট্রেকারে। একটু গাঁটের কড়ি খরচ করলে অটো বা টোটো ভাড়া করে নিয়েও যাওয়া যেতে পারে। টোটোয় অবশ্য সময় একটু বেশি লাগবে।
রাজনগরের রাজা আসাদউলজামানের বাকি পড়া খাজনা আদায়ে এসেছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাব আলিবর্দির দেওয়ান রামনাথ ভাদুড়ি। রাজা খুশি হয়ে দেওয়ানকে দিলেন ভান্ডিরবন এলাকার চার মৌজা। তিনি সমস্ত সম্পত্তি দেবতার নামে উৎসর্গ করে তিনটি মন্দির নির্মাণ ও রক্ষনাবেক্ষণের পাকাপাকি ব্যবস্থা করেন। ট্রেকারে বসেই গল্প শুনছিলাম স্থানীয় এক বৃদ্ধের মুখে। ট্রেকার নামালো ভান্ডিরবনে বড় রাস্তার মোড়ে। এখান থেকে গ্রাম এক কিলোমিটার মত। এবার হাঁটার শুরু।
গাছপালার মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ। মাঝে মধ্যে সবুজ ক্ষেত। নিরিবিলি সেই পথে যেতে যেতে গলা থেকে সুর বেরিয়ে এল আনমনেই। গুনগুন সুরে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চলেছি। মাঝে মধ্যে চেনা অচেনা পাখিদের আওয়াজ। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল এক কিলোমিটার কেন, এমন পথ পেলে দশ কিলোমিটারও হেঁটে যেতে পারি। মিনিট পনেরো পর একটা বাঁক ঘুরতেই দেখলাম মাঠের সামনে একটি মন্দির। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই জানলাম এটি গোপালের মন্দির।
সামনে বেশ বড় চাতাল বট গাছের ছায়ায় মোড়া। ভিতরেও মন্দির চত্বরে অনেকটা জায়গা। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সেই মন্দির চত্বরটিও বেশ মনোরম। গাছগাছালির ছায়া, পাখির ডাক, শান্ত শীতল পরিবেশ। মন্দিরেরে জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। দেব দ্বিজে আপনার ভক্তি থাকা বা না থাক গোপালবাড়ির পরিবেশটা আপনাকে আকর্ষিত করবেই।
বটের ছায়ায় বসে থাকতে দেখে নিজে থেকেই আলাপ করতে এগিয়ে এলেন স্থানীয় দুই প্রৌঢ়। কলকাতা থেকে এত দূরে তাদের গ্রাম দেখতে এসেছি শুনে তো বেজায় খুশি তারা। খুব উৎসাহ নিয়ে জানালেন মন্দিরের ইতিহাসও বেশ মনোগ্রাহী। সাল তারিখটা সেভাবে তারা জানাতে না পারলেও সব কটি মন্দির এবং তাদের দেব মহিমার কাহিনীগুলি শুনতে মন্দ লাগে না।
বৈষ্ণব সাধক ধ্রুব গোস্বামী বৈষ্ণব বলয়ে ফিরে যেতে চাইলেন। যাওয়ার সময় নিয়ে যেতে চাইলেন কিছু পুঁথি। আর বারোটি গোপাল। একে একে সব ঘাটের নৌকোতে চাপলেও যেতে চাইল না এক গোপাল। তাকে মাটি থেকে তোলা গেল না কিছুতেই। মাটি আঁকড়ে পরে থাকা দারুমূর্তিই আজ ভান্ডিরবনের গোপাল নামে প্রতিষ্ঠিত ও পূজিত হন।
গোপাল মন্দিরের থেকে সামান্য এগোলেই ভাণ্ডেশ্বর শিব মন্দির। সেটিও বড় চমৎকার পরিবেশে। সামান্য দূরে ময়ূরাক্ষীর কুলুকুলু জলধারা। বট অশ্বত্থের ছায়ায় ঘেরা উঁচু মন্দির। শোনা যায় এক সময়ে এই এলাকা ছিল ঘন বন। সেই গহন বনে আরাধ্যদেবতা শিবের সাধনায় মগ্ন ছিলেন বিভান্ডক নামে এক মুনি। বিভান্ডক মুনী শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন যা বিভাণ্ডেশ্বর নামে পরিচিতি পায়। বিভাণ্ডেশ্বর থেকেই লোক মুখে মুখে ভাণ্ডেশ্বর এবং সেখান থেকেই ভান্ডিরবন।
ভাণ্ডেশ্বর মন্দিরের পুজারি একজন মহিলা। তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, ছবি তুলতে রাজি হলেন না। জানালেন ভাণ্ডেশ্বরের পরিচিতি ছড়িয়ে পরুক সর্বত্র। এখনও অবশ্য দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন ভাণ্ডিরবনে। তবে এখানে পর্যটনের তেমন পরিকাঠামো না থাকায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত না হওয়ায় ইচ্ছে থাকলেও সকলে আসতে পারেন না। প্রসাদ খাওয়ার ব্যবস্থা আছে দুটি মন্দিরেই, তবে আগে থেকে বলে রাখলে ভাল হয়। এখানে গোপালবাড়ির সামনের মাঠে প্রতি বছর রাস এবং গোষ্ঠরথের মেলা বসে।
আমি তো বিগ্রহের চাইতে প্রকৃতির পূজারি বেশি করে। তাই এবার মন্দির দর্শনের পর পা বাড়ালাম সুন্দরী ময়ূরাক্ষীর দিকে। নদীর ধারটি বড় চমৎকার। উঁচু বাঁধ পেরিয়ে উঁকি দিতেই দেখলাম ময়ূরাক্ষীর বুকে জল বালির লুকোচুরি। নদীর পাড় বরাবর সবুজ ঘাসের গালিচা। এর মাঝেই চোখ টানল একাকি দাঁড়িয়ে থাকা একটি কিশোর বট গাছ। রোদের তাপও খারাপ না, তাই ওই বট গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
এতদূর এসে ময়ূরাক্ষীর সঙ্গে একটু খেলা করব না! তা কি হয়? চটি খুলে নেমে গেলাম জলে। হাঁটু ভেজা ঠান্ডা জল। নিচে বালির সুড়সুড়ি। কি যে ভাল লাগছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার ছেলে মানুষি দেখে এগিয়ে এল এক রাখাল বালক। মোবাইলে গান শুনছিল সে। ময়ূরাক্ষীর সঙ্গে তাদের সুখ দুঃখের সম্পর্ক। সেই উৎসাহী হয়ে ছবি তুলে দিল আমার। দেখলাম স্মার্ট ফোন ব্যবহারে আমার চাইতে ঢের গুন বেশি স্মার্ট সে।
এখান থেকে ম্যাসানজোড় এবং তিলপাড়া ড্যামের মাঝামাঝি এলাকায় ভাণ্ডিরবন। তাই নদীতে জল এখানে অনেকটাই কম। তাতে অবশ্য আমার ভালই হয়েছে। মনের সুখে জলে নেমে ময়ূরাক্ষীর সঙ্গে খুনসুটেমিতে মেতেছি। কেউ দেখারও নেই। খানিক পরে নিজের সঙ্গে নিজের খেলায় নিজেই হাঁপিয়ে গেলাম। ফের বট গাছের ছায়ায় গিয়ে জিরিয়ে নেওয়ার পালা। সঙ্গে থাকা কেক বিস্কুটের সদগতিও হল। রাখাল বালক অবশ্য ততক্ষণে আর ধারে কাছে নেই। জায়গাটি সত্যিই দারুণ, শুনলাম শীতকালে কেউ কেউ এখানে পিকনিক করতে আসেন। নদীর ধারে এমন সুন্দর পরিবেশ, পাশাপাশি ধর্মিয় আবহ তো উপরি পাওনা।
ময়ূরাক্ষীর সঙ্গে খেলা ধুলা শেষে এবার যেন কিঞ্চিৎ খিদে পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এখানে খাবারের তেমন বন্দোবস্ত নেই। আমি আগে থেকে বলে আসিনি, তাই মন্দিরের ভোগ মেলার সম্ভাবনা নেই। গিয়ে খেতে হবে সিউড়ীতেই। এবার পা বাড়ালাম পাশের গ্রাম বীরসিংহপুরের দিকে।
হেঁটে মিনিট দশেক গেলেই বীরসিংহপুর কালী মন্দির। কোনও এক সময়ে রাজনগরের রাজার অনাচারে দেখা দিল মহা প্লাবন। অনাচারে রুষ্ট কুলদেবী কালীর পাথরের প্রতিমা ভেসে গেল কুশকর্ণিকার জলের টানে। সেই মূর্তি এক জেলের জালে আটকে গেলেন ভান্ডিরবন সংলগ্ন খটঙ্গা গ্রামে। তিনিই বীরসিংহপুরের কালীরূপে পূজিতা হলেন। এখনও লোকে বলে মগধরাজ জরাসন্ধ এই কালীর উপাসক। মন্দিরটি তেমন বড়সর না হলেও কালী মা এখানে খুবই জাগ্রত এবং জনপ্রিয় বলে জানালেন স্থানীয়রা।
এবারে ফেরার পালা। ফের বড় রাস্তার মোড় পর্যন্ত এসে সেখান থেকে ট্রেকার ধরলাম। আধঘন্টার মধ্যে সিউড়ী বাস স্ট্যান্ড। পেটে তখন রীতিমত আন্দোলন কোলাহল শুরু হয়ে গিয়েছে। বাস স্ট্যান্ড লাগোয়া প্রচুর হোটেল। তারই একটাতে পেট ভরে মাছের ঝোল ভাত খেতেই শান্ত হল আন্দোলন। একই চত্বরে সরকারী বাস টার্মিনাস। সেখানে গিয়ে দেখলাম কলকাতা যাওয়ার বাস দাঁড়িয়ে। ব্যাস চেপে বসলাম তাতে। ঘন্টা চারেকের বিশ্রাম শেষে বাস নামালো ধর্মতলায়।
মনে রাখবেনঃ
নিজস্ব গাড়িতেও যাওয়া যেতেই পারে। সিউড়ীতে রাত্রিবাসের জন্য ভাল মন্দ মিশিয়ে অনেক হোটেল আছে। সিউড়ী থেকে আসার সময় এখানকার বিখ্যাত মোরব্বা নিতে ভুলবেন না। ভান্ডিরবন থেকে ম্যাসানজোড়ের দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার মত, ঘুরে আসতে পারেন সেখান থেকেও।
পেশা সাংবাদিকতা। সেই সূত্রেই বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরির সুযোগ। রাজ্য তথা দেশের বিভিন্ন অচেনা অজানা নিরিবিলি অথচ সুন্দর জায়গা দেখতে দেখতে পেশার পাশাপাশি ভ্রমণ যে কখন নেশা হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারিনি।