১৯ এপ্রিল ২০২১। রাত তখন প্রায় ১১.৩০। রাত্রে খাওয়া দাওয়া সেরে মন টা কেমন যেন আনচান করা শুরু করলো। পরের দিন টা অফিস নাই। বিশেষ কোনো কাজও নাই। টিভির চ্যানেল গুলো ঘোরাতে ঘোরাতে কয়েকটা খবর মাঝে মাঝেই মস্তিষ্কে আঘাত হানতে থাকলো। মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, দিল্লী… ফের নাকি লক ডাউনের কবলে। সার্স কোভিড-২ নাকি কোভিড ১৯ এর থেকেও আরো ভয়ঙ্কর এবং তা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে বিস্তর আলোচনা তর্কাতর্কি। টিভির পর্দাটা ঝাপসা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে চোখের সামনে। বেদনাদায়ক ২০২০র স্মৃতি উগরে উঠে আসছে গলা দিয়ে। তবে কি আবার সেই? আবার সেই গৃহবন্দী অবস্থা? যদি আর কখনো বেরোতে না পারি? মনটা বড় এলোমেলো হয়ে গেলো হাজারো প্রশ্নে। টিভি বন্ধ করে দিয়ে মোবাইলে ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে ঠিক করে ফেললাম পরের দিন হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে বসে কোথাও একটা চলে যাবো। কোনো এক অজানা অদেখা গ্রামে। মনে মনে একটা জায়গা ঠিক করে নিয়ে ঘুম লাগালাম।
২০ এপ্রিল ২০২১। হাওড়া থেকে ১১.২২ এর বর্ধমান লোকাল ( কর্ড লাইন) এ চেপে বসলাম। ট্রেন মোটামুটি ফাঁকা তাই পছন্দ মতন জানালার ধারটা বাগিয়ে নিতে পারলাম অনায়াসে। ডানকুনি ছাড়ানোর পর বাইরের দৃশ্যপটে রং লাগতে শুরু করলো। সে রং বড় তৃপ্তির। সে রং এক মনোরম সবুজের। সে রং জীবনের ব্যালান্স শিট থেকে মনটাকে এক টানে ছিটকে নিয়ে যায় সম্পূর্ণ এক অন্য জগতে। সে রং জানান দেয় সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছোটার ঘরদৌড়ের বাইরেও একটা জগৎ আছে, যেখানে বিলাসিতা হয়তো নেই। কিন্তু আছে স্বস্তি…এক নিবিড় শান্তি…আছে মাটির গন্ধ…আছে মানুষ কে জানার অনেকটা সময়…আছে বেঁচে থাকার তৃপ্তি। তাই হয়তো অন্ধ ভিকিড়ির নাকি সুরে ” অন্ধজনকে একটু সাহায্য করবেন”, গলায় স্পিকার ঝুলিয়ে প্যান্ট শার্ট পরা বৃদ্ধের গলায় “পুরানো সেই দিনের কথা…দাদারা দিদিরা একটু হেল্প করবেন, বাক্স হাতে “যারা ভালো জলের খোঁজ করে থাকেন একবার এই বিশ্লেরীর ঠান্ডা জল পান করে দেখেন”, প্যাকেট হাতে “বাইরে ৩০ টাকা কিন্তু আমার কাছে ২০ টাকায় খেজুরের প্যাকেট, ছোট ছোট প্যাকেট হাতে “এই গরমে শরীর ঠান্ডা রাখতে আপনাদের জন্য ঘরের বানানো তাজা দইয়ের ঘোল”, ঝুড়িতে বিক্রয়রত পেয়ারা, ছোলা মিকসচার, ঝালমুড়ি, গজা…. এসব কিছুতেই আর বিরক্তি লাগছে না। বরঞ্চ মনে সাহস পাচ্ছি এই ভেবে জীবনটা শুধুই মনে হয় “আরো” থেকে “আরো বেশির” জন্য নয়। দেড় ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম গুরাপ স্টেশন। ছোটখাটো ছিমছাম একটি স্টেশন। ৩ নং প্ল্যাটফর্মে নেমে ইতিউতি চেয়ে দেখি বেশিরভাগ জনগণ ওভারব্রিজ পেরিয়ে ১ নং এর দিকে হাঁটা লাগাচ্ছেন। তাঁদের অনুসরণ করে আমিও সেইদিকে এগোলাম। এখানে একটা কথা বলে রাখি যে কোলকাতার লোকাল ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা আমার খুবই কম কারণ কর্মসূত্রে বাস ট্যাক্সি বা নিজের গাড়ি দিয়েই কাজ চলে যায়।
স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে একটু খোঁজ করতেই পেয়ে গেলাম ভাস্তাড়া যাওয়ার অটো। ভাড়া ২০ টাকা। গুরাপ থেকে প্রায় ৫ কিমি দূরে এই ভাস্তাড়া। আমার লক্ষ্য ভাস্তাড়া গ্রামের সিংহ দের জমিদার বাড়ি। সে বিষয়ে অটো চালককে জিজ্ঞেস করায় খুব মিষ্টি হেসে বললো “সেটির নাম তো ঠিক শুনি নি। আমি আপনাকে ভাস্তাড়া স্টপেজে নামিয়ে দেব। সেখানে কাউকে জিজ্ঞেস করলে ঠিক দেখিয়ে দেবে”। যথাস্থানে নেমে খোঁজ নিয়ে বুঝলাম আমি প্রায় ১ কিমি মতন এগিয়ে এসেছি।কমলসাগর বলে একটি জায়গা থেকে গ্রামের ভেতর দিয়ে একটি পথ আছে যেটি জমিদার বাড়ির দিকে যায়। অগত্যা পিছটান দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। বেলা গড়িয়ে তখন প্রায় ১.৩০ টা। গ্রীষ্মের দুপুরে মধ্যগগনে সূর্য। কষ্ট যে হচ্ছে না তা নয়। তবে অজানাকে জানার সন্ধানে কেন জানিনা কষ্ট টা সেভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে কাবু করতে পারছে না আমায়। কমলসাগর জায়গাটির মধ্যে আদিম গ্রামের ছোঁয়া বেশ স্পষ্ট। বেশ কয়েকটি মাটির বাড়ি চোখে পড়লো। সেই মাটির বাড়ির বাসিন্দা দের জিজ্ঞেস করতেই সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে গেলাম।
পায়ে পায়ে একটু এগোতেই চোখে পড়লো একটি প্রাচীন আমলের সাব পোস্ট অফিস বা ডাকঘর। পাশেই পঞ্চায়েত সমিতির অফিস। এঁকেবেঁকে রাস্তাটি চলে গেছে গ্রামের ভেতরে। গ্রীষ্মের দাবদাহ অতিমাত্রায় থাকলেও গ্রামের এই পথটির দুধারে গাছগাছালি প্রচুর। তার ছায়ায় যেন এক শীতল প্রলেপ। কিছুটা এগোতেই পেয়ে গেলাম ভাস্তাড়া জমিদার বাড়ি। উল্টোদিকেই সিংহ বংশের জমিদার যজ্ঞেশ্বর সিংহের ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
এই বিদ্যালয় স্থাপনের সময় স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁর পদধূলি আজও সংরক্ষিত আছে হেড মাস্টারের ঘরে। বিদ্যাসাগর মঞ্চও স্থাপিত আছে বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে। এই বিদ্যালয়ের ১১ ও ১২ শ্রেণী এখন কোয়েড। আগে অবশ্য পুরোটাই কোয়েড ছিল। পরে মেয়েদের জন্য ১০ম শ্রেণী অবধি আলাদা একটি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।
সিংহদের জমিদার বাড়ির অনেকটাই আজ ভগ্নপ্রায়। তবে বাড়ির একাংশে আজও বসবাস করেন সিংহ দের বংশধরেরা। তাঁদের অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করলাম জমিদার বাড়িতে। এই রাজবাড়ীর ইতিহাস সুপ্রাচীন। রাজবাড়ীর দুর্গাদালান আজও বর্তমান। এই স্থাপত্য আজও মাথা উঁচু করে ফিসফিসিয়ে বলে যায় সুপ্রাচীন ইতিহাস। আনুমানিক প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো দুর্গাপুজো আজও ধুমধামের সহিত পালিত হয় এখানে।
Front view of Durgadalan of Bhastara Rajbari
সিংহ বংশের এই জমিদাররা মূলত রাজস্থানের রাজপুত ঘরানা। রাজস্থান থেকে বর্ধমান জমিদার। সেখান থেকে ধনিয়াখালি বোসো । বোসো থেকে ভাস্তাড়া। আনুমানিক ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে জমিদার এককড়ি সিংহ বাড়িটি নির্মাণ করেন। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে এই বংশের ই জমিদার যজ্ঞেশ্বর সিংহ ভাস্তাড়ায় একটি উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। যজ্ঞেশ্বর সিংহর পিতা ছকুরাম সিংহ সারা বাংলায় খ্যাতি লাভ করেন দানশীল জমিদার হিসেবে। বাংলার এই প্রান্তের সার্বিক উন্নতি ও উন্নয়নের পিছনে এই সিংহ পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। বর্গী আক্রমণে বহুবার বিদ্ধস্ত হয়েছে এই ভাস্তাড়া। সিংহ পরিবারের এক সদায় সুখদেব সিংহ অন্দরমহলে একটি তুলসী মঞ্চের পাশে নিহত হন বর্গী আক্রমণের দ্বারা। সেই তুলসিমঞ্চ আজও স্বজত্নে রাখা আছে। তৎকালীন বর্গী নেতা ভাস্কর পন্ডিতের নামেই এই গ্রামের নাম ভাস্তাড়া।
জমিদার বাড়ি দর্শন সেরে গ্রামের পথে কিছুটা ঘুরে বেড়ালাম। চোখে পড়লো অসংখ্য আম গাছ। বাতাবি লেবু গাছ। বহু বাড়ির লাগোয়া বাগানে আছে আম গাছে। তাতে শোভা পাচ্ছে সদ্য ফলা আম। কাছেই আছে একটি চন্ডী মন্দির। সময় এই গ্রামে তার নিজস্ব খাতে বয়। জীবনকে চোখ রাঙানোর সাহস সে পায় না। ভাবতে অবাক লাগে কোলকাতা থেকে মাত্র ৫৭ কিমি দূরত্বে এক সুপ্রাচীন ইতিহাস আজও টিম টিম করে জ্বলছে এই বাংলার বুকে। গ্রাম ঘুরে ফিরে এলাম কমলসাগরের মোড়ে।
সহজেই পেয়ে গেলাম গুরাপ স্টেশনের অটো। ভাড়া ১৫ টাকা। গুরাপের আর একটি ইতিহাস আছে। বাংলা মিডিয়ামে কেশবচন্দ্র নাগের অঙ্কের বই পড়েনি এমন খুব কম বাঙালিই আছে। এই কেশবচন্দ্র নাগের জন্মভূমি গুরাপ। গুরাপ স্টেশন থেকে টোটো ভাড়া করে ইচ্ছে হলে দেখে আসতে পারেন কেশবচন্দ্রর বাসস্থান। আমার অবশ্য এখন ফেরার পালা। দৈনন্দিন উচাটনের জীবনে ভাস্তাড়ার মতন একটি গ্রাম এনে দেয় প্রশান্তি।
বাংলার ঐতিহ্য রোজকার ঘরদৌড়ে নয়। বাংলার ঐতিহ্য জীবন দর্শনে। সেই জীবন দর্শনের সংস্পর্শে আসতে হলে এমন ভাবেই উঠে পড়তে হবে কোনো এক ট্রেনে। যে ট্রেন আপনাকে নিয়ে চলে যাবে কোনো এক পোড় খাওয়া লাইব্রেরিয়ান এরও অজানা এক জগতে…. যেখানে আজও হয়তো খুঁজলে পাওয়া যাবে খাঁটি সোনার সন্ধান। বেঁচে থাকার আসল নির্যাস! অপেক্ষায় থাকলাম, এমন ১৯ এপ্রিলের রাত বহুবার আসুক আমার জীবনে।
Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.
[…] 0 Comments Inline Feedbacks View all comments previousভাস্তাড়া রাজবাড়ি […]
[…] 0 Comments Inline Feedbacks View all comments previousভাস্তাড়া রাজবাড়ি […]