Skip to content
Home » বাংলার রত্ন কুড়িয়ে সবুজ দ্বীপের পথে

বাংলার রত্ন কুড়িয়ে সবুজ দ্বীপের পথে

Share this in your social media

১:

সেইবার যখন অম্বিকা কালনা গেছিলাম, হাতে সময় কম থাকার দরুন কালনার আশপাশ টা আর চেখে দেখা হয়নি। সেই “আশপাশ” যে এতটাই মণি মাণিক ভরা তা এইবার নিজে না গেলে বিশ্বাস হতো না। আগস্ট মাসের একটি শনিবার সকাল ৭টা নাগাদ একাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গী ক্যামেরা এবং অবশ্যই নেভিগেটর ম্যাডাম। কোলকাতা থেকে বৈদ্যপুর প্রায় ৯০কিমি। বেলঘরিয়া এক্সপ্রেস ওয়ে হয়ে NH 19 ধরে ৪৫ কিমি গেলে মগরা-গুরাপ রোডের একটি এক্সিট আছে। এই রাস্তা ধরে কিছুটা গিয়ে পেয়ে গেলাম বৈচি-কালনা রোড। ৭ কিমি কালনা রোড ধরে এগিয়ে ডান দিকে যে রাস্তাটি ঢুকে গেছে সেটাই পুরোনো বৈদ্যপুর রোড।

২:

পশ্চিম বাংলায় বেশ কিছু পাড়া বা গ্রাম আছে যার পরতে পরতে ছেয়ে আছে প্রাচীনত্বের ছোঁয়া। এমনই এক মিষ্টি ছোট্ট গ্রাম এই বৈদ্যপুর। রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠ ছাড়িয়েই আশপাশের বাড়িঘরের স্থাপত্যে এবং দুটি অর্দভগ্ন টেরাকোটা মন্দিরে অনুভব করলাম এই প্রাচীনত্বের ছোঁয়া। ঠিক যেন এক গ্রীষ্মের দুপুরে লাইব্রেরীর একেবারে ওপরের ধুলো মাখা সেল্ফ থেকে নামিয়ে আনা পুঁথির পাতায় একলা বসে বুঁদ হয়ে যাওয়া। সময় যন্ত্রের কাঁটাটাকে বেশ কয়েক পাক উল্টোদিকে ঘুরিয়ে পৌঁছে যেতে হয় ৪৫০ বছরেরও পেছনে এই বৈদ্যপুরের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে। নাঃ, ভুল বললাম হয়তো। বৈদ্যপুরের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিষ্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত মনসামঙ্গল কাব্যে, যেখানে বলা আছে লখিন্দরকে সর্প দংশনের পর বেহুলা এই বৈদ্যপুরেই আসেন বৈদ্যের খোঁজে এবং বেহুলা নদীর নামও এসেছে এই কাব্য থেকেই।

৩:

চোখ ও মন ধাঁধিয়ে যায় অতটা পেছনে ফিরে তাকালে। আপাতত ৪৫০ বছর আগে থেকেই শুরু করা যাক। আমার সামনেই রাস্তার একেবারে পাশেই জোড়া দেউল বা রেখ দেউল। বড় দেউল টি পূর্বমুখী এবং ছোট দেউল টি উত্তরমুখী। দুটো মন্দিরই একটি রাস্তা দিয়েই সংযুক্ত।

DSC_0070

মন্দিরের দেওয়াল সূক্ষ্ণ টেরাকোটার কাজে সজ্জিত, যাতে ফুটে উঠেছে কখনো সামাজিক চিত্র কখনো আবার হিন্দু মহাকাব্যের কাহিনী। ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্থার দ্বারা সংরক্ষিত এই দেউল তৈরী হয় ১৫৫০ খ্রীষ্টাবদে। এছাড়াও ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দে আপনার চোখ চলে যাবে দেউলের চূড়ায়, এক ঝাঁক টিয়া পাখি যেন মুখর হয়ে আছে দেউলের ইতিহাস আপনার কাছে ব্যক্ত করতে!

৪:

জোড়া দেউল থেকে কয়েক গজ এগিয়েই বাঁ দিকে বাঁক নিয়েছে রাস্তাটি। ছোট্ট একটুকরো খালি জমির একপাশে রাসমঞ্চ, অপর দিকে ছোট্ট একটি দোলমঞ্চ এবং সামনাসামনি একটি শিব মন্দির। পাশেই একটি চায়ের দোকান। গাড়িটি মাঠে রেখে চা বিস্কুটের সাথে আলাপ জমালাম দোকানের মালিকের সাথে। উদ্দেশ্য অবশ্য একটাই, বৈদ্যপুরের কোথায় কি আছে সেই মানচিত্রটি একটু মনে মনে ছকে নেওয়া।

DSC_0082

দোলমঞ্চের পাশ ঘেঁষে সরু একফালি রাস্তা দিয়ে কয়েক পা এগোলেই বৃন্দাবন চন্দ্রের মন্দির। সুবিশাল এবং সুউচ্চ মূল প্রবেশদ্বারের দুপাশ আলোকিত করে আছে থামের মাথায় দুটি পাথরের সিংহ। রুদ্ধ দ্বারের আশপাশে একটি শিশু কে পেয়ে জিজ্ঞেস করে জানলাম পুরোহিত মশাই কিছুক্ষন আগে পূজো দিয়ে চলে গেছেন, আবার আসবেন সেই ওবেলায়। অর্থাৎ এবারকার মতো মন্দিরের ভেতরে ঢোকা আর সম্ভব হলো না।

DSC_0088

DSC_0093

DSC_0103

৫:

অগত্যা অগ্রসর হলাম গাড়ি নিয়ে পরবর্তী গন্তব্য, নন্দীদের পূজোবাড়ির দিকে। গাড়ি বাড়াতেই বৈদ্যপুর বাজার। বাজার এলাকা ছাড়াতেই বাঁ হাতে রাস্তার ওপরেই সাবেকিয়ানায় আদ্যপান্ত মোড়া নন্দীদের পূজোবাড়ি। ঢোকার মুখেই দরজার মাথায় এক বিশাল গণেশ মূর্তি। গেট খোলা থাকায় ঢুকে পড়লাম।

DSC_0113

বাড়ির ভেতর পেয়ে গেলাম এক প্রবীণকে। কোলকাতা থেকে এসেছি শুনে তিনি খুশিই হলেন। গেট দিয়ে ঢুকেই বাঁ হাতে ছোট্ট একটি শিব মন্দির এবং সামনে উঠোন এবং সুসজ্জিত কারুকাজ করা দূর্গা দালান । আজও এই বাড়িতে প্রতি বছর দুর্গোৎসব, জন্মাষ্টমী, লক্ষীপূজো, কালী পূজো ইত্যাদি খুব ধুমধামের সহিত পালিত হয়।পূজোবাড়ির ভিতর মহল্লায় আছে নন্দীবংশের কুলদেবতা রাজরাজেস্বরীর মন্দির। এই মন্দিরের বিগ্রহ এক শালগ্রাম শিলা। প্রবীণ ভদ্রলোক শুধু যে আমাকে এই সবই দেখালেন তাই নয়, নন্দীবংশের প্রচুর তথ্যও আমি পেলাম ওনার থেকে।

DSC_0100

এই পূজোবাড়ি প্রতিষ্টা হয় সম্ভবত ১৮৩২-১৮৩৫ সালের মধ্যে। অবশ্য নন্দী পরিবারের সাথে বৈদ্যপুরের যোগাযোগ সপ্তদশ শতাব্দীর প্রায় মধ্যভাগ থেকে। তাঁদের প্রধান জীবিকা ছিল নুন, সুপুরি এবং মশলার ব্যবসা। ধীরে ধীরে অর্থ প্রাচুর্য্য ফুলে ফেঁপে ওঠেন তাঁরা এবং এক বিশাল জমিদারির অধিপতি হন। নন্দীদের আদিবাস ছিল অধুনা হালি শহরের কেওটা গ্রামে। ব্রিটিশদের অত্যাচারে পরে তারা বসতি গড়েন পাণ্ডুয়ার জামগ্রামে। পরবর্তীকালে নন্দীদের একাংশ বৈদ্যপুর চলে এসে বসতি গড়েন। বর্ধমানের কালনা, কোলকাতার বড়বাজার এলাকার পোস্তা এবং বেলেঘাটার খালপোলে ছিল তাঁদের ব্যবসার গদি। সল্টলেক, রাজারহাট, চন্দননগর, শ্যামনগরেও ছিল নন্দীদের সুবিশাল এস্টেট। প্রসঙ্গত বলে রাখি রাজারহাট অন্তর্ভুক্ত কেষ্টপুরের বারোয়ারিতলায় যে সুপ্রাচীন রাজ রাজেশ্বরী মন্দির আছে, তা এই নন্দী পরিবারেরই নির্মিত। পূজোবাড়ির সামনেই রাস্তার ওপারে আছে এক মজে যাওয়া পুকুর। অতীতে পুজোর যাবতীয় কর্মযজ্ঞ এই পুকুর পার থেকেই শুরু হতো।

৬:

পূজোবাড়ি থেকে বাজারের দিকে মুখ করে কয়েক পা এগোতেই বাঁ দিকে একটি জীর্ণ ভগ্নপ্রায় টেরাকোটার মন্দিরের পাশ দিয়ে একটি গলি ঢুকে গেছে। গলির মুখ থেকেই চোখে পড়লো অদূরে দুটি বহু প্রাচীন বাড়ি।

DSC_0132

গলির বাঁ দিকে কাচারী বাড়ির দরজা খোলাই ছিলো তাই অনায়াসেই ভেতরে ঢুকে দেখে নিলাম। এই বাড়ির ঠিক উল্টোদিকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নন্দীদের বৈঠকখানা বাড়ি। Neo classical শৈলীর এক অসাধারণ নিদর্শন। বাড়ির সামনের ভাগে আছে gothic শৈলীর পাঁচটি থাম এবং ঝুল বারান্দা যা বাড়িটির শোভা আরো দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। দোতলার জানালায় চোখে পড়লো অবশিষ্ট রঙীন দামী কাঁচ। এক সময় এ বাড়ির কি জৌলুস ছিলো তা একবার দেখলেই অনুমান করা যায়। এ বাড়ি আজ পরিত্যক্ত, বাসিন্দা আজ শুধুই পায়রার ঝাঁক।

DSC_0130

৭:

ফিরে এসে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেলাম পূজোবাড়ি ছাড়িয়ে। কিছুটা এগোতেই পেয়ে গেলাম পাশাপাশি দাঁড়ানো অতি প্রাচীন নবরত্ন মন্দির এবং আটচালা মন্দির। নবরত্ন মন্দিরটির আজ জীর্ণকায় অবস্থা রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে, তবে ভেতরে আজও বিরাজ করছে ৪.৫” ফুট উচ্চতার একটি কৃষ্ণবর্ণ শিব লিঙ্গ।

DSC_0108

কথিত আছে এই মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা করেন নন্দী বংশের জমিদার জয়দেব নন্দী ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মায়ের স্মৃতিতে। এই নবরত্ন মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকেই নন্দী বংশের মূল জমিদার বাড়ি যা আজও অক্ষত। ১৮৩২-১৮৩৫ সালে নির্মিত হয় এই জমিদার বাড়ি। অজস্র থাম, দোতলার ঠিক মাঝামাঝি একটি সুন্দর ঝুল বারান্দা এবং এক মানুষ উঁচু জানালাগুলো আজও দৃষ্টি কাড়ে। জমিদার বাড়ি লাগোয়া সরু গলিতে ঢুকে চোখে পড়লো আরেকটি টেরাকোটার শিব মন্দির। না জানি এই ছোট্ট মিষ্টি গ্রামটির আনাচে কানাচে কত এরকম প্রাচীন মন্দির ছড়িয়ে আছে!

DSC_0146

DSC_0149 1

৮:

ঘড়ির কাঁটা এখন প্রায় ১২ টার কাছাকাছি। বৈদ্যপুরের থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিলাম গোপালদাসপুরের রাখাল রাজা মন্দিরের উদ্দেশ্যে। নেভিগেটরের হিসেবে প্রায় ৫ কিমি রাস্তা, অর্থাৎ মিনিট পনেরোর বেশি লাগার কথা নয়। পাড়ার রাস্তা ছেড়ে হাইওয়ে ধরতেই বাঁ হাতে পেলাম তরু ছায়ায় পরিবেষ্টিত সুন্দর একটি বড় পুকুর।

DSC_0162

চোখ আটকে গেল সেই ছায়ায় বসে থাকা এক বৃদ্ধার দিকে। গাড়ি থামিয়ে ওনার কাছে গিয়ে বুঝলাম উনি ভিক্ষুক নন। অদ্ভুত এক প্রশান্তি তাঁর সারা মুখে। মুখ ভর্তি দোক্তা পাতা। গরমের এই দাবদাহের মধ্যেও কি শীতল এই পরিবেশ, মন জুড়িয়ে আসে। আবার চলার শুরু। বৈচি-কালনা রোড ছেড়ে ডান দিকের একটি রাস্তা ধরালো নেভিগেটর ম্যাডাম। বড় সুন্দর এই রাস্তা। দুপাশের নিবিড় সবুজ আর সুনীল আকাশ স্তিমিত করে দিলো আমার গাড়ির গতি। কিছু ছবি নিয়ে এগোতে থাকলাম। সামনেই প্রথমে পেয়ে গেলাম নারকেলডাঙ্গা গ্রামে অবস্থিত জগৎ গৌরী মাতার মন্দির। মনসামঙ্গল কাব্যে উল্লেখ আছে এই জগৎ গৌরী মন্দিরই সেই মা মনসার থান যেখানে বেহুলা তাঁর সর্প দংশিত স্বামীকে রেখে বৈদ্যের খোঁজে বৈদ্যপুর গেছিলেন।

DSC_0167

DSC_0195

 

৯:

দুপাশের সবুজ ধানের ক্ষেতের মধ্যে কোথাও কোথাও দোল খাচ্ছে সদ্য আসা কাশের সারি। আকাশেও যেন শরতের মেঘের আগমনী সুর। পৌঁছে গেলাম রাখালরাজা মন্দির। অনেকটা জায়গা জুড়ে ছেয়ে আছে এক বিশাল বটের শাখা প্রশাখা আর বটের ঝুড়ি। সেই প্রকান্ড বট গাছের এক পাশে মন্দিরটি।

DSC_0183

DSC_0173

এমন শান্ত, স্নিগ্ধ, শীতল এবং মনোরম প্রকৃতির কোলে এমন ছিমছাম মন্দির এর আগে বিশেষ দেখেছি বলে মনে পরে না। মন্দিরে কুপন কেটে ভোগ খাওয়ারও ব্যবস্থা আছে। প্রকৃতি এবং ধর্মের এই মেলবন্ধনে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। খানিকটা সময় এই শান্ত পরিবেশে নিজেকে বিলীন করে দিয়ে কালনার রাস্তায় গাড়ি বাড়ালাম।

DSC_0178

১৮ কিমি রাস্তা, তার সাথে খিদেও মন্দ পায়নি। বেশ টেনেই চালাচ্ছিলাম। বেহুলা নদীর ওপরে সেতুটায় এসে থমকে দাঁড়ালাম। এ কোথায় এসে পড়লাম? এতো দেখি পাটের সাম্রাজ্যে ঢুকে পড়েছি। টোকা মাথায় নর নারীর দল বেহুলার কোলে বসে মেতে আছে পাট সংগ্রহে। নদীর জল ছেয়ে আছে ভেজানো পাটে। নদী থেকে সেই পাট তুলে এনে ডাঁই করা হচ্ছে গরুর গাড়িতে।

DSC_0201

DSC_0234

১০:

কালনার প্রিয়দর্শিনী হোটেলে যখন পৌঁছলাম তখন বেলা গড়িয়ে প্রায় ২.৩০টা। কালনা বাস ডিপোর একেবারে উল্টোদিকেই বড় রাস্তার ওপর এই হোটেল। আমার এবং আমার বাহনের, দুয়েরই বিশ্রাম দরকার। লাঞ্চ সেরে রুমে গিয়ে বারান্দায় বসে চোখে পড়লো কালনা শহরের ব্যস্ততা। ভাবতে অবাক লাগে যে এই ঘিঞ্জি কর্ম ব্যস্ততার মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরেই পড়ে রয়েছে মধ্যযুগীয় এক প্রাচীন মন্দিরময় নগর, পড়ে রয়েছে নিঝুম বিকেলে বটের ছায়ায় একলা এক মন্দির অথবা কোনো এক ধানক্ষেতের ঠিক মাঝখানে পড়ে রয়েছে তির তির করে দুলতে থাকা ধানের শীষের মাঝে গ্রামবাসীদের মনস্কামনা ভরা একটি ছোট্ট মন্দির। পরদিন সকালে আবহাওয়ার বৈচিত্রে একটু বিরক্তই হলাম। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি আজ সকাল থেকেই।

১১:

পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক একেবারে চেকআউট করে সকাল ১০ টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম গুপ্তিপাড়ার উদ্দেশ্যে। বৃন্দাবন মঠ যাওয়ার পথে পেলাম সাবেকী দুর্গোৎসবের জন্য খ্যাত সেন বাড়ি এবং তার প্রায় পাশাপাশিই দেশ কালী মন্দির।

DSC_0243

DSC_0247

এই মন্দির চত্বরে আর কাউকে পান বা না পান, পাশের বটগাছ ভর্তি বাদুড়ের প্রায় তিন পুরুষের সংসার গাছ থেকে ঝুলে থেকে আপনাকে অভিবাদন জানাতে প্রস্তুত হয়ে আছে। এই কালীবাড়ি অনতিদূরেই রথতলা। টিনের বেষ্টনীতে ঢাকা আছে এক প্রকান্ড রথ, গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রার খ্যাতি অনেকরই হয়তো জানা। রথতলার পাশেই শুকোতে দেওয়া থোকা থোকা পাট কাঠির বাগানের মাথা থেকে উকিঁ দিচ্ছে বৃন্দাবন মঠের চূড়া। মন্দির চত্বরে চারটি মন্দির আছে – কৃষ্ণচন্দ্রের আটচালা, শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জোড়বাংলা, বৃন্দাবনচন্দ্রের আটচালা এবং রামচন্দ্রের একরত্ন। এই চার মন্দির একই চত্বরে এবং এদের একসঙ্গে বলা হয় বৃন্দাবনচন্দ্রের মঠ।

DSC_0255

DSC_0260

 

১২:

গুপ্তিপাড়া ছাড়িয়ে অগ্রসর হলাম সুখারিয়া গ্রামের দিকে। এই গ্রামেই অবস্থিত আনন্দময়ী মন্দির। একটি প্রকান্ড পুকুরকে ডানদিকে রেখে সরু রাস্তা ঢুকে গেছে। কয়েক পা এগোতেই বাঁ হাতে মিত্র মুস্তাফিদের রাজবাড়ি এবং ডান দিকে আনন্দময়ী মন্দির। ১৮১৩ সালে তৎকালীন জমিদার বীরেশ্বর মিত্র মুস্তাফি প্রতিষ্টা করেন এই মন্দিরে। মন্দিরের সামনে প্রশস্ত উঠোন। উঠানের দুপাশে পাঁচটি করে মোট ১০ টি শিব মন্দির। গঠনে অনেকটা দক্ষিনেশ্বর কালীবাড়ির সাথে মিল। মন্দিরটির চাল তিনটি স্তরে বিন্যস্ত।

DSC_0271

DSC_0270

মোট ২৫টি শিখর। চার চালার প্রথম স্তরে ১২টি, দ্বিতীয় স্তরে ৮টি, তৃতীয় স্তরে ৪টি এবং মধ্যস্থলে বৃহত্তম রত্ন বা শিখর। দর্শন সেরে বড় রাস্তায় এসে একটু পিছিয়ে রাস্তার উল্টোদিকের পাড়ায় ঢুকতেই পেয়ে গেলাম প্রথমে হর গৌরির মন্দির পুকুর পারে এবং তারপর নিস্তারিনী মন্দির।

DSC_0411

DSC_0415

এই সমস্ত জায়গা গুলোই এক সময় ছিল মিত্র মুস্তাফিদের জমিদারির ভাগ। গাড়ি বাড়িয়ে সোমড়াবাজার হয়ে চলে এলাম সবুজদ্বীপের ঘাটে। হ্যাঁ। এতো কাছে এসে সবুজদ্বীপ না গেলে চলে?

১৩:

এদিকে এতক্ষণের হিলসেগুড়ি বৃষ্টি ক্রমশ তার রূপ পরিবর্তন করে তেড়ে আসছে আকাশ ভেঙে। ঘাটে গাড়ি পার্ক করে এক মাঝির সাথে দরদাম করে ঠিক করলাম ৩৫০/- টাকায়- সবুজদ্বীপ যাওয়া আসা এবং ওখানে কিছুটা সময় ঘুরে দেখা। বাধ সাধলো তুমুল বৃষ্টি। মাঝিরও মুখ কাঁচুমাচু। আসলে বর্ষায় বিশেষ ট্যুরিস্ট এখানে আসেনা। মাঝির খোলা ছোটখাটো নৌকো, এই দুর্যোগে সে নৌকো নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার ক্যামেরা বাঁচিয়ে ওই অঢাকা নৌকোয় যাওয়া অসম্ভব। অগত্যা অপেক্ষা। প্রায় ঘন্টা খানেক পর বৃষ্টি থামলে নৌকো নিয়ে পাড়ি দিলাম সবুজদ্বীপের পানে। বেহুলা নদীর পারে পাট চাষের বিশাল কর্ম কান্ড দেখতে দেখতে এসে পড়লাম গঙ্গায়।

DSC_0291

DSC_0300

চোখে পড়লো ছোট দুটি টিনের বানানো মাছ ধরা ডিঙ্গি, একটিই মানুষ কোনোরকমে বসতে পারে এই ডিঙ্গি নৌকোয়। ঝড়ের বেগে দুজন আমাদের পাশ কাটিয়ে কোনাকুনি ভাবে গঙ্গার ওপারে বেয়ে চলে গেলো। মিনিট পঁচিশ পরে লম্বাটে সবুজ দ্বীপের একাংশ দৃশ্যমান হলো। দ্বীপের এদিকের এক কোনায় নৌকো ঘাটে লাগিয়ে মাঝি ভাই আমাকে নামিয়ে একটি খুঁটির সাথে নৌকো বেঁধে, পাশের একটি ওয়াচ টাওয়ারের টঙে উঠে বসে গেলেন।

DSC_0315

১৪:

বেড়ার একটি গেট পার করে আমি একাই এগোলাম ভেতরে। বুনো ঘাসের মধ্যে দিয়ে সরু একফালি পিচ্ছিল রাস্তা দিয়ে অতি সাবধানে হাঁটছি। গাঢ় সবুজে ঢাকা চারপাশ। উঁচু গাছগুলোর মাথায় ঝাঁকে ঝাঁকে শামুক খোল এসে বসেছে। তাদের শেন নজর আমার গতিবিধির ওপর। যত এগোচ্ছি সবুজের ঘনত্ব তত বাড়ছে। উঁচু গাছগুলোর পাতার বুনন এতটাই নিশ্ছিদ্র, যে যে আশপাশের ঝোপঝাড় গুলো কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। হঠাৎ খেয়াল হলো এতটা রাস্তা হেঁটে এলাম, একটি মানুষেরও তো দেখা পেলাম না।

DSC_0331

তবে কি এই দ্বীপে এই মুহূর্তে মানুষ বলতে শুধু আমরা দুজন – মাঝি ভাই আর আমি? মনে পরে গেলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা কাকাবাবুর গল্প – “সবুজ দ্বীপের রাজা।” দ্বিতীয় বেড়ার পরিখা টা পেরিয়ে চোখে পড়লো কৃত্রিম জিরাফ এবং একটি হাতি। আর তার সাথে পরিত্যক্ত ভেঙে পড়া একটি দরমার কাঠামো। এপাশে জঙ্গল কিছুটা ছেঁটে ফেলা হয়েছে, সম্ভবত শীতকালের পিকনিক পার্টির ভিড় সামলানোর জন্য। আরও গভীরে গিয়ে দেখি আরেকটি বাঁশের পরিখা এবং বেড়ার গেট। সেটি পার করে ইঁট বাঁধানো রাস্তা, তবে বর্ষায় পুরু শেওলার আস্তরণে ঢাকা পরে এ রাস্তা এখন ভয়ঙ্কর পিচ্ছিল। ঝরা পাতায় ছেয়ে আছে সেই রাস্তা। সেই পাতা গুচ্ছর ওপর পা ফেললে পিছলে পড়ার সম্ভাবনা কম, মেপে মেপে পা ফেলে এগোচ্ছি। কিছুটা গিয়ে রাস্তাটি বাঁ দিকে মুড়ে গেছে। বাঁ দিকে এগোতেই দেখি সারি দিয়ে ১০ টি অতি সুসজ্জিত কাঠের কটেজ। মাটি থেকে একটু উঁচুতে এই কটেজ গুলো, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার ব্যবস্থা আছে। প্রতিটি কটেজকে আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে আছে বিভিন্ন গাছ গাছালি। দেখলে মনে হয় যেন সবকটি গাছবাড়ি। কেন যে এই কটেজ গুলো জনসাধারণের জন্য এখনও খুলে ওঠা হয়নি, তা বোধগম্য হলো না। মন টা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। মনের গভীরে লিখে রাখলাম একটি সুপ্ত বাসনা – এমনই এক বর্ষার সকাল, দুপুর, বিকেল, রাত…আমি কাটাতে চাই সবুজদ্বীপের এই কটেজে।

DSC_0339

১৫:

ওয়াচ টাওয়ারের কাছে ফিরে এসে দেখি মাঝি ভাই টাওয়ার থেকে নেমে শুকনো একটি জায়গায় বসে দিব্যি গুন গুন করে গান গাইছেন। আমি উঠে পড়লাম ওয়াচ টাওয়ারে। দ্বীপের আয়তন এবং বনানীর গভীরতার অনেকটা আন্দাজ পাওয়া যায় এই ওয়াচ টাওয়ারের ওপর থেকে। নেমে এসে নৌকো নিয়ে পারি দিলাম ফেরার পথে। পারে ফিরে গাড়ি নিয়ে একই রাস্তায় ফেরা। পথে পড়লো সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, এটি অবশ্য নতুন মন্দির দেখলেই বোঝা যায়।

DSC_0410

মিত্র মুস্তাফা পাড়া হয়ে সোমড়াবাজার ছাড়িয়ে ধরলাম বৈচি-কালনা রোড। গাড়ি বাড়ালাম কোলকাতার পথে। পেছনে পরে রইলো বেশ কিছু সুখকর স্মৃতি আর নিয়ে চললাম কিছু অধুনা বাসনা।

DSC_0350

© Arijit Kar

0 0 votes
Article Rating

I am eager to know your views on this post. Please leave a reply

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
error: Content is protected !!
%d bloggers like this: