Skip to content
Home » ময়নার আয়না

ময়নার আয়না

Kalidaha Trench at Moynagarh Rajbari
Share this in your social media

১ঃ

প্রতি বছরের মতন এবারেও মনের সুপ্ত ইচ্ছা গুলোকে গলা টিপে মেরে পূজার দিনগুলো বাধ্য কর্পোরেট চাকুরীজীবী হয়ে ঘরে বসেই কাটিয়ে দিলাম কারন মুম্বাইয়ের ক্যালেন্ডার দুর্গা পূজা মানে শুধুই দশমী বা আরও পোশাকি ভাষায় দসেরা বোঝে। ভ্রমনপ্রিয় বাঙ্গালিদের জন্য পুরো অক্টোবর মাসটাই যেন প্রজাপতি মাস। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্মী পূজা, কালী পূজা, ভাইফোঁটার হাত ধরে এই প্রজাপতি মাস চলে যায় নভেম্বর অবধি। ইংরাজি নববর্ষের ক্যালেন্ডার এর কপি টা হাতে এলেই এনারা দাগিয়ে নিয়ে পরিকল্পনা সেরে ফেলেন সেই বছরের প্রজাপতি মাসে কোন কাননের ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াবেন।

ভাগ্যবান বাঙালি এনারা। আমাদের মতন কিছু ভাগ্যহারা, কর্পোরেট মুম্বাইকে অনুসরণ করা কর্মচারীদের বছরের এই সময়টা বেশ হাঁসফাঁস করেই কাটে যখন দেখি অন্য ইন্ডাস্ট্রির বন্ধু বান্ধবরা বেশ পাখনা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। এমনই এক অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে যখন IRCTC ঘেঁটে ঘেঁটে বিতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি, তখনই ডিজিটাল সামাজিক মাধ্যমের মারফৎ জানা একটি নাম মগজের হার্ড ডিস্ক থেকে উঠে এলো। ময়নাগড়।। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। চটজলদি গুগল ঘেঁটে শনিবারের জন্য একটি পরিকল্পনা করে ফেললাম। আমার

চিরসঙ্গী আলোকযন্ত্র টিকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শনিবার সকালে। দুরাভাষে কথা বলে নিয়েছিলাম তমলুকের গ্রিন ভ্যালী রিসোর্টে কারন ময়নাগড়ে থাকার সেরকম কোন জায়গা নেই। কোলকাতা থেকে ১১০ কিমি মতন রাস্তা ময়নাগড়, মোটামুটি পৌনে তিন ঘণ্টা লাগবে টানা গেলে। কোলাঘাট থেকে ২০ কিমি গেলেই নিমতৌড়ির মোড়। সেখান থেকে ডানদিকে যে রাস্তাটি ঢুকে গেছে, সেটাই ময়নার রাস্তা। সোজা বেড়িয়ে গেলে, নন্দকুমার। তমলুক যেতে গেলে কিন্তু নিমতৌড়ির কিছুটা আগেই রাধামনি থেকে বাঁ দিকে SH4 ধরে নিতে হবে। রাধামনি থেকে ৬ কিমি গেলেই গ্রিন ভ্যালী রিসোর্ট। ঠিকই করে রেখেছিলাম ময়নাগড় ঘুরে তবে হোটেলে গিয়ে ঢুকবো তাই রাধামনি- নিমতৌড়ি হয়ে প্রথমেই পৌঁছে গেলাম ময়নাগড়।

Main gate for Moynagarh Rajbari island

The gate saying “An island within an island’

২ঃ

ময়নায় ঢোকার প্রধান তোরণ টির মাথায় এই শব্দগুলো লেখা। ” An Island Within An Island.” হ্যাঁ, রাজ্য হেরিটেজ কমিশন এই নামেই ভূষিত করেছেন ময়নাগড় কে কয়েক বছর আগে। গাড়িটি এই প্রধান ফটকের সংলগ্ন মাঠে রেখে প্রবেশ করলাম। ময়নার ইতিহাস এবং ভূগোল – এই দুয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রাচীন অনেক রহস্য। আজ থেকে বহু বছর আগে তমলুক ছিল ভারতের একটি বন্দরনগরী। তমলুক থেকে ১৬ কিলোমিটার পশ্চিমে কেলেঘাই, কংসাবতী, চন্ডীয়া নদী ঘেরা দ্বীপ এলাকার সবচেয়ে প্রাচীন এলাকা হল ময়নাগড়। ময়নাগড় এর অপর নাম ময়না চৌরা। স্থানীয় মানুষজনের মুখে “ময়না চৌরা” নামটাই বেশি শোনা যায়। এই “চৌরা” শব্দটির অর্থ ওড়িয়া ভাষায় হল জলবেষ্টিত উন্নত ভূমি।

Moyna Chaura at Moynagarh Rajbari island

Moyna Choura

ভৌগলিক বিশেষজ্ঞদের মতে আজ থেকে বহু বছর আগে কেলেঘাই নদীর মোহনায় জেগে উঠেছিল স্থলভূমি। মোহনায় জেগে ওঠা চর পরে ‘ময়না চৌরা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ময়নাগড়ের ইতিহাসের শিকড় খুঁজতে গেলে চলে যেতে হয় বহু শত বছর আগের ধর্মমঙ্গল কাব্যে। একদল ইতিহাসবিদদের মতে ধর্মমঙ্গল কাব্যের নায়ক পালবংশের রাজা লাউসেন এই ময়নাগড়ের প্রতিষ্ঠাতা। আরেক দলের মতে দ্বিতীয় মহীপাল (৯৮৮-১০০৮ খ্রিষ্টাব্দ) এই একাধিক নদীবেষ্টিত দ্বীপের মতো স্থানে জলদুর্গটি তৈরি করেন। তবে এর মধ্যে লাউসেনের দিকেই পাল্লাটা বেশি ভারী। সে যাই হোক, একটি ব্যাপারে সকলেই সহমত যে পালবংশের রাজ্যপাট শেষ হয়ে যাওয়ার পর বহুকাল এই ময়নাগড় পরিত্যক্ত ছিল।

Island of Moynagarh Rajbari

Island of Moynagarh Rajbari

এই সময় জলবেষ্টিত ময়নাগড় চলে আসে জলদস্যুদের কবলে। সে সময়ের কুখ্যাত জলদস্যু শ্রীধর গেঁড়ে বসে এই ময়নাগড়ে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় দস্যুবৃত্তি করে বেড়াত। তাকে সাহায্য করত মগ ও পর্তুগিজ দস্যুরা। শ্রীধরকে শায়েস্তা করতে তৎপর হন উৎকল রাজ। তাঁর আদেশে সবংয়ের রাজা গোবর্ধনানন্দ ময়না গড় অবরোধ করে শ্রীধরকে পরাস্ত করেন। উৎকলের রাজা এর পরেই গোবর্ধনানন্দকে ‘বাহুবলীন্দ্র’ উপাধি দেন বলে কথিত রয়েছে। আজও ময়নাগড়ের রাজ পরিবার ‘বাহুবলীন্দ্র’ পদবিই ব্যবহার করেন। এর ঠিক পরেই রাজা গোবর্ধনানন্দ সবংয়ের বালিসীতার বাসস্থান ছেড়ে ময়নাগড়েই তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। ময়নাগড়ের চতুর্দিকে অনেকগুলি গভীর পরিখা তৈরি করে এই গড়কে এক দুর্ভেদ্য জায়গায় রুপান্তরিত করেন। ৩০টি ছোট ছোট দ্বীপ, ৩৫টি ছোটবড় খাল বা পরিখা নিয়ে বাহুবলীন্দ্র রাজবংশের দুর্গ যেন এক আলাদা পৃথিবী। তিনটি বড় বড় এবং সুগভীর পরিখা পার হয়ে তবে পৌঁছানো যেতো এই গড়ে। এর মধ্যে প্রথম পরিখা কালিদহ পাল রাজাদের সময়ে তৈরি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরিখা তৈরি করান গোবর্ধনানন্দ (১৫৬১-১৬০৭)। তৃতীয় পরিখাটি আর নেই। দ্বিতীয়টির নাম মাকড়দহ। সেটিও প্রায় অবলুপ্তির পথে। কংসাবতী নদীসেতুর সংযোগকারী রাস্তা, সেতুর থাম নির্মাণ করতে গিয়ে বুজে গেছে মাকড়দহ।

Under construction bridge at Moynagarh Rajbari

Under construction bridge near Moynagarh Rajbari at Moyna Chaura

রয়ে গেছে শুধু কালিদহ। এই কালিদহ ও মাকড়দহ পার না করে ময়নাগড়ে প্রবেশ করা ছিল অসম্ভব। বাহুবলীন্দ্ররা তাদের সেই সময়ের রাজত্বকালে এই পরিখাটে ছেড়ে রাখতো অজস্র হিংস্র কুমীর। দ্বীপ টিকে ঘিরে থাকতো হিংস্র শ্বাপদসংকুল জঙ্গল যার দুর্ভেদ্য কাঁটা বাঁশ বন এখনো খানিকটা দেখা যায়। ছোট বড় বিভিন্ন উঁচু ঢিপি পরিবেষ্টিত ছিল এই গড় এবং সেই উঁচু ঢিপির ওপর মজুত থাকতো কামান ২৪ ঘণ্টা। শত্রু পক্ষের কাছে এই গড় ছিল চরম দুর্ভেদ্য। ইংরেজ শাসনকালে অবশেষে ইংরেজ সৈন্য এই সমস্ত বাধা অতিক্রম করে যদিও বা গড় অবধি পৌঁছায়, কিন্তু তৎকালীন রাজা জগদানন্দ বাহুবলীন্দ্রকে জীবন্ত ধরতে পারেনি। কিছু বিশ্বস্ত অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে রাজবাড়ির ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠে আত্মগোপন করেন জগদানন্দ, জীবদ্দশায় আর সেই গুপ্ত কুঠুরি থেকে বের হননি তিনি।

৩ঃ

এই মুহূর্তে আমি দাঁড়িয়ে আছি কালিদহ পরিখার সামনে। হঠাৎ দেখলে কেরালার ব্যাক ওয়াটার মনে হয়। চারিদিকে সবুজের আস্তরণে মোড়া পরিখাটিকে ঘিরে আছে অজস্র গাছ আর তাদের শ্যামল ছায়ায় জলের রংও গাঢ় সবুজ। এই শান্ত শীতল কালিদহকে দেখে ধারনাও করা যায় না সে সাক্ষী হয়ে আছে কত রোমহর্ষক ঘটনার। এখানেই রাজদ্রোহী প্রজাকে কুমীরের মুখে ছুঁড়ে ফেলা হত একসময়। রাজপরিবারে নববধূ এলে তাঁকে পালকি শুদ্ধ পরিখার জলে চুবিয়ে শুদ্ধ করে রাজবাড়িতে তোলা হত। এবং যে সদ্য বিবাহিত মেয়েটি কালিদহ পার করে একবার ময়নাগড়ে পা রাখত, তার আর কোনোদিন বেরোবার নিয়ম ছিল না। আমৃত্যু থাকতে হত অন্তঃপুরবাসিনী বন্দিনী হয়ে। রাজবাড়ির মেয়েদের জন্য ছিল কড়া অনুশাসন। বিধবাদের এক বেলা স্বপাকে খেতে হত।

তাঁদের রান্নার জ্বালানি কাঠ কালিদহের জলে ভিজিয়ে রাখা হত, যাতে সারাদিন সেই ভিজে কাঠ জ্বালিয়ে রান্না করতেই কেটে যেত। বর্তমান ময়নাগড়ে বাহুবলীন্দ্র পরিবারের বংশধরেদের বাস। আজও ময়নাগড় পৌঁছানোর একমাত্র পথ হল ১৭০ ফুট প্রশস্ত কালিদহ পরিখা, নৌকো ছাড়া সেখানে পৌঁছানোর আর কোন উপায় নেই। বাহুবলীন্দ্র পরিবারের বর্তমান সদস্যদের সকলেরই নিজস্ব ঘাট আছে এবং তাতে বাঁধা থাকে তাদের নিজস্ব নৌকো।

জনসাধারনের জন্য নৌকো চলে সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ১২ টা অবধি। ১২ টার পর একমাত্র রাজ পরিবারের লোকজন এবং ময়নাগড়ের পুরোহিত মশাই ছাড়া আর কারো এই পরিখা পারাপারের অনুমতি নেই। বিচিত্র এই দ্বীপের মোহে মোহিত হয়ে ছবি তুলতে তুলতে ঘড়ির কাঁটা এদিকে ১১.১৫ ছুঁই ছুঁই।

Approaching Moynagarh Rajbari

Glimpses of Moynagarh Rajbari while approaching

Boat from Moynagarh Rajbari

Priest coming from Moynagarh Rajbari on boat

এদিক ওদিক খোঁজ করেও যখন কোন নৌকো পেলাম না, ঠিক তখনই দেখি ওপার থেকে এক মাঝি সাদা ধুতি পরিহিত এক পুরোহিত মশাই কে নিয়ে এপারে আসছে। পারে নৌকো ভেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই গলদ ঘর্ম হয়ে তাঁর কাছে গিয়ে অনুনয় বিনয় করলাম আমাকে পার করে দেবার জন্য। তিনি নিজে না গেলেও সহৃদয় হয়ে অন্য একটি নৌকোর ব্যাবস্থা করে দিলেন, তবে তার সাথে কড়া অনুশাসনে এটাও বলে দিলেন ১২ টার মধ্যে যেন ওই পার ছেড়ে চলে আসি।

৪ঃ

টলমল পায়ে উঠে পড়লাম সরু নৌকোয়। তার এক প্রান্তে আমি আর অন্য প্রান্তে মাঝি। অদ্ভুত এক নিরিবিলি পরিবেশ চারিদিকে। নীল আকাশের চাদরে মোড়া অবাক পৃথিবী এই ময়নাগড়। কালিদহর মাঝ বরাবর গিয়ে দেখতে পেলাম রাজবাড়ির নিজস্ব ঘাট এবং তাতে তাদের নৌকো বাঁধা। দ্বীপের পারের তাল গাছে এমন ভাবে বেঁকে ঝুঁকে পড়েছে পরিখার ওপরে,দেখে মনে মনে হয় অতন্দ্র পাহারায় রত সেই গাছ গুলি।

Kalidaha Trench at Moynagarh Rajbari

Kalidaha Trench

জলের ওপর তাদের ছায়া যেন পুরো দ্বীপটিকে ঘিরে একটি গণ্ডি কেটে জানান দিচ্ছে ময়নাগড়ের দুর্ভেদ্যতা। ওপারে পৌঁছে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতেই প্রথমে পেলাম আটচালার লোকেশ্বর শিব মন্দির। মন্দিরের ভেতরে ১৫ ফুট গভীরে রয়েছে স্বয়ম্ভূ শিবলিঙ্গ। কথিত আছে কংসাবতী নদীর সঙ্গে এ মন্দিরের সরাসরি সুড়ঙ্গ পথে যোগাযোগ রয়েছে। নদীতে জল বাড়লে শিবকুণ্ড ডুবে যায়।

Lokeshwar Shiva Temple of Moynagarh Rajbari

Lokeshwar Shiva Temple

এরপর গেলাম রাজ পরিবারের কুলদেবতা শ্যামসুন্দর জীউর মন্দিরে। এই মন্দির পঞ্চরত্ন অর্থাৎ পাঁচ চূড়া বিশিষ্ট মন্দির। নিত্যপূজা হয় এখানে। মন্দিরের পাশেই রয়েছে নাটমন্দির।

Nat Mandir of Moynagarh Rajbari

Nat Mandir

Shyamsundar Temple of Moynagarh Rajbari

Shyamsundar Temple

প্রতি বছর রাস পূর্ণিমার সন্ধ্যায় শ্যামসুন্দর জীউকে নিয়ে নৌকো বিহারে বেরোনো হয়। সেই সময় এক মাস ধরে চলে রাস উৎসব। পুরনো দুর্গের সাক্ষী হিসেবে রয়ে গেছে কিছু ধ্বংসাবশেষ। নাট মন্দিরের কাছেই পরিত্যক্ত হলুদ রঙের সেই রাজবাড়ি আজও বর্তমান। ভেতরে ঢুকতেই কেমন যেন গা ছম ছম করে উঠলো।

Abandoned Fort of Moynagarh Rajbari

Abandoned Moynagarh Rajbari

বাহবতে অবাক লাগে কত মানুষের কান্না হাসির সাক্ষী হয়ে আছে এই ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ি।  বাহুবলীন্দ্র পরিবারের উত্তরসুরিরা আজ যেখানে বসবাস করছেন, তা নির্মিত হয়েছে অনেক পরে। ১২ টা বাজতে তখনও ৫ মিনিট বাকি। চলে এলাম কালিদহের পারে যেখানে নৌকোটি আমায় নামিয়েছিল। কিঞ্চিৎ অপেক্ষা করতেই আমার নৌকো এসে হাজির। ওপারে গিয়ে পরিখা টিকে আমার ডান দিকে রেখে হাঁটতে শুরু করলাম গড় টিকে বৃত্তাকার একটি চক্কর দেবার জন্য। কিছুদুর এগোতে পেলাম একটি মুস্লিম কবরখানা।

Muslim Cemetery at Moynagarh Rajbari island

Muslim Cemetery

সরু একটি রাস্তা টার পাশ দিয়ে গিয়ে উঠেছে একটি ছায়া সুনিবিড় মাঠে। মাঠ টা পার করেই চোখে পড়লো একটি মাজার।

Muslim Shrine at Moynagarh Rajbari island

Muslim Shrine

এখানে বলে রাখি – একসময় এই ময়নাগড় ছিল হিন্দু, মুসলিম এবং বৌদ্ধদের সহাবস্থান। খেয়াল করলাম দ্বীপটির পাশ দিয়ে পরিখা বরাবর বৃত্তাকারে ঘুরে আপাতত আমি পৌঁছে গেছি ময়নাগড়ের প্রধান ফটকের কাছাকাছি।

৫ঃ

রওনা দিলাম গ্রিন ভ্যালী রিসোর্টের উদ্দেশ্যে। আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। ছিমছাম সুন্দর থাকার জায়গাটি চারিদিকে মোড়া সবুজের প্রলেপে। স্নান খাওয়া সেরে বারান্দায় গিয়ে ক্লান্ত শরীরটিকে এলিয়ে দিলাম চেয়ারে। সামনে অবাধ প্রকৃতি। রিসোর্টটি পাশকুরা-তমলুক হাইওয়ের ওপর হলেও বেশ নিরিবিলি। বেলা গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয় হয়। এই পড়ন্ত বেলায় আর তমলুকের দিকে গিয়ে লাভ নেই, যখন কালকের পুরো দিন হাতে আছে ফেরার আগে। বিকেল টা রিসোর্টের লাগোয়া বাগানেই সময় কাটিয়ে দিন টা শেষ করলাম।

Green Valley Resort

Green Valley Resort

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো পাখির কলরবে। চোখ কচলাতে কচলাতে বারান্দায় এসে দেখি সামনের বাগানে খেলে বেড়াচ্ছে এক ঝাঁক গ্রিন বি ইটার। মন টা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল চায়ের কাপ হাতে তাদের হুটোপুটি দেখতে দেখতে। ১১.৩০ টা নাগাদ একেবারে ছেল আউট করে বেড়িয়ে পড়লাম। আজকে যে যে জায়গায় যাবো, সবই হাতের কাছের তমলুক শহরে। প্রথমেই গেলাম রামকৃষ্ণ মঠে।

Ramakrishna Temple at TAmluk

Ramakrishna Temple

গেট বন্ধ থাকায় ভেতরে ঢুকে ঘয়াঘুরির সুযোগ পেলাম না। তবে এক স্বামিজিকে অনুরধ করায় তিনি মূল উপাসনা গ্রিহের একটি ছবি তোলার ব্যাবস্থা করে দিলেন। মঠ থেকে বেড়িয়ে ১০ মিনিট যেতেই পৌঁছে গেলাম বর্গভীমা মন্দিরে।

Bargabhima Temple at Tamluk

Bargabhima Temple

বর্গভীমা বা ভীমরূপা মাতা বঙ্গদেশের পৌরাণিক তাম্রলিপ্ত জনপদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তিনি হলেন কালী মতান্তরে উগ্রতারা। তিনি পশ্চিমবঙ্গের তথা প্রাচীন বঙ্গদেশের ঐতিহাসিক বন্দরশহর তাম্রলিপ্ত শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন। অনুমান করা হয়, পৌরাণিক তাম্রলিপ্ত জনপদ প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই তাঁর মন্দির এই স্থানে প্রতিষ্ঠিত। ভারতের অন্যতম জাগ্রত ও প্রধান শক্তিপীঠ। পীঠ নির্ণায়ক তত্ত্ব অনুযায়ী এটি ৫১ পীঠের প্রথম পীঠ।

Tamluk Rakshit Bati Entrance

Rakshit Bati Entrance

বর্গভীমা মন্দিরের খুব কাছেই আছে রক্ষিত বাটী। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিপ্লবীদের সম্মিলিত হয়ার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল এই বাড়িটি। প্রখ্যাত বিপ্লবী যাদুগোপাল, ধনগোপাল মুখপাধ্যায়, পূর্ণ সেন, যোগজীবন ঘোষ, গনেশ দাস প্রভৃতি অগ্নি জুগের বিপ্লবীদের অনুশীলন ভুমি ছিল বিপ্লবী সুরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের এই “রক্ষিত বাটী” র ব্যায়ামাগার। রক্ষিত বাড়ির এই ব্যায়ামাগার গুপ্ত সমিতির বিপ্লবীদের কাছে মাতৃসদন নামে পরিচিতি লাভ করেছিলো।

Tamluk Rakshit Bati History

History Of Rakshit Bati

Rakshit Bati at Tamluk

Rakshit Bati

  

৬ঃ

রক্ষিত বাটী থেকে একটি রাস্তা সোজা চলে গেছে রূপনারায়ণ নদের পারে। মিনিট ২০র রাস্তা। ইতিহাস থেকে বেড়িয়ে চলে এলাম সেই রূপনারায়ণের পারে। প্রকৃতি আর ইতিহাসের মেল্বন্ধনের এক উৎকৃষ্ট শহর এই তমলুক। নদে যেন এখানে হঠাৎ করে এসে মিশে গেছে সবুজ গালিচায়। হাত বাড়ালেই জলের ছোঁয়া পাওয়া যায়।

Rupnarayan River at Tamluk

Rupnarayan River

নদের পারের একটি ঝুপড়ি দোকানে বসেই দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে নিলাম উন্মুক্ত জানালা দিয়ে মৃদু মন্থর গতিতে নদের পারের গাছটার কাছে আছড়ে পরা ঢেউ গুলো দেখতে দেখতে। রূপনারায়ণ থেকে বেড়িয়ে প্রথমেই গেলাম তাম্রলিপ্ত মিউসিয়াম। বন্দরনগরী তাম্রলিপ্তর বহু পুরানো তথ্য সযত্নে সংরক্ষিত আছে এই মিউসিয়ামে। এরপর চলে এলাম শ্রীশ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু জীউ মন্দিরে।

Tamluk Mahaprabhu Jiu Temple

Mahaprabhu Jiu Temple

ভিতরের রাসমঞ্চটি নজর কাড়া। রাসমঞ্চর পাশেই আছে কবি বাসুদেব ঘোষের সমাধিস্থল। কবি বাসুদেব ঘোষ ছিলেন মহাপ্রভু গৌরাঙ্গ ভক্ত এবং অসংখ্য গৌরাঙ্গ পদাবলির রচয়িতা।

স্বাধীনতা সংগ্রামী মাতঙ্গিনী হাজরার শহীদ স্থল বানপুকুরের অবস্থান এই তমলুকেই। চলে এলাম সেখানে। এক হাতে পতাকা এবং আরেক হাতে শঙ্খ নিয়ে এই সংগ্রামী নেত্রীর মূর্তি স্থাপিত আছে জায়গাটিতে। পাশেই অশোক স্তম্ভের একটি রেপ্লিকা।

Matangini Hazra Staute at Tamluk

Matangini Hazra Statue

Martyrdom of Matangini Hazra at Tamluk

Martyrdom of Matangini

তমলুক সরকার তাঁর শ্রদ্ধারঘে একটি পার্ক স্থাপিত করেছেন এই মূর্তি ঘিরে। ১৯৪২ এর ২৯ সেপ্টেম্বর বিকেল বেলায় আলিনান থেকে প্রায় ৫০০০ মানুষের নিরস্ত্র মিছিল নিয়ে সরকারি অফিস দখলের অভিযানে বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দিয়ে ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে বিদ্ধ হয়েছিলেন মা মাতঙ্গিনী, বানপুকুরের এই স্থানে।

এরপর চলে এলাম তমলুক রাজবাড়িতে। প্রশস্ত একটি মাঠের ওপর দাঁড়িয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। ঘোড়াশালের ঠিক বাইরে খুঁটিতে বাঁধা একটি কালো ঘোড়াকে দেখে চমকে উঠলাম।

Tamluk Rajbari Stable

Horse in front of Tamluk Rajbari

ইতিহাস যেন উথলে উঠে বর্তমানে এসে মিশেছে এই ঘোড়াটির হাত ধরে। গথিক আর্চে গ্রিক-রোমান আর্কিটেকচার আর মুঘল ঘরানার মিলমিশ। পলেস্তরা, রঙ কোনও কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই। জরাজীর্ণ এই রাজবাড়ি আজ শুধুই কয়েকটি খিলান আর থাম। সেগুলোও জংলা গাছের নাগপাশে বন্দী। চারদিকে ইট, পাথরের কঙ্কাল। আর ইতিহাসের হাহাকার। একদা রাজদম্ভ ও প্রাচুর্যে মোড়া রাজবাড়ি আজ শুধুই অভিমানী এক কাঠামো মাত্র।

Tamluk Rajbari Stable

Horse in front of Tamluk Rajbari

আজকের তমলুক শহর ছিল প্রাচীনের তাম্রলিপ্ত। পুরাণে মহাভারতের নবম অধ্যায় বা ভীষ্ম পর্বে উল্লেখ আছে এই তাম্রলিপ্তের। এরপর স্বাধিনতার সময়ে বন্দর, নাগরিক সভ্যতা এবং সমৃদ্ধির জনপদ ছিল এই তাম্রলিপ্ত। প্রাচীন জনপদ। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। পুবে রূপনারায়ণ। পশ্চিমে সুবর্ণরেখা। রূপনারায়ণে মিশেছে সিলাই আর দ্বারকেশ্বরের গতি। তিনদিক ঘেরা জলপথ বেয়ে তাম্রলিপ্ত বন্দরে থামত বণিকের তরী।

এই তাম্রলিপ্তকে বলা হত মধ্যদেশ। বঙ্গ ও কলিঙ্গের মাঝখানে অবস্থান বলে ডাকা হত মধ্যদেশ। অনেকেই হয়তো জানেন না প্রাচীন রেশম পথেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল এই বন্দর নগরী। কথিত আছে ১৯৩৮ সাল শেষবার দুর্গা পুজো হয়েছিল এই বাড়িতে। এরপর থেকে এই ধ্বংসস্তূপ নিষ্প্রদীপই রয়ে গেছে। অথচ পাশেই পারিবারিক ঠাকুরদালান। নিত্য পুজো হয় রাধা মাধবের।

ময়ূরধ্বজ, তাম্রধ্বজের গৃহ দেবতা। মন্দিরটি পরিপাটি। কথিত আছে পাণ্ডবদের অশ্বমেধের ঘোড়া আটকানো হয়েছিল এইখানে। হালফিলালে অবশ্য ASI অবশ্য দায়িত্ব নিয়ে এই রাজবাড়ির অবশিষ্ট স্থাপত্য সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে। রাজবাড়ির এই প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে সত্যিই হারিয়ে যেতে হয় ঐতিহাসিক এই নগরীতে।

প্রতিটি ইট যেন কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলতে চায় হাজার হাজার বছর ধরে জমে থাকা কতো কথা…কত ইতিহাস। পড়ন্ত বেলার ফিকে আলোয় সেই ইতিহাসে আচ্ছন্ন হয়ে কোলকাতার পথে গাড়ি বাড়ালাম। তমলুক থেকে ফিরে আসার পরেও আজও যেন আজকের আমি হারিয়ে যাই মাঝে মাঝেই আনমনে সেই নিবিড় ইতিহাসের অজানা অলিতে গলিতে।।

©Arijit Kar

3 2 votes
Article Rating

I am eager to know your views on this post. Please leave a reply

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
error: Content is protected !!
%d bloggers like this: