প্রস্তুতি:
২৬শে জানুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার। অতএব শুক্র, শনি এবং রবি নিয়ে তিনদিনের একটি হারিয়ে যাওয়ার জায়গার সন্ধান। জায়গাটি এমন হতে হবে যেন শীতের এই মিষ্টি তিনটি ছুটির দিনের উপচে পরা ভিড়ের ছোঁয়া তাকে গ্রাস না করে। চার মাথা এক হয়ে শুরু হলো ব্রেন স্টর্মিং আর নেট ঘাঁটাঘাঁটি। উঠে এলো একটি নাম, সামসের নগর। সুন্দরবনের পটভূমিতে কালিন্দির পার ঘেঁষে ভারতবর্ষের শেষ গ্রাম, সামসের নগর। নামটা শুনেই বিদিশার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো –
“আমি জানি সামসের নগর। আমাদের বাড়ির সুলতা মাসি ওই গ্রামেরই মহিলা। ওনার পরিবারে তিন পুরুষে চার জন বাঘের পেটে গেছেন। ”
লীনা বলে উঠলো – “ছোটবেলা থেকেই জানি সুন্দরবন যেতে গেলে দক্ষিণ ২৪ পরগনা দিয়ে ঢুকতে হয়। কিন্তু শামশের নগর দেখছি উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদ হয়ে ঢুকতে হবে।”
স্নেহাংশুর ম্যাপ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির স্বভাব ছোটবেলা থেকেই। উত্তরটা ওই দিলো –
“সুন্দরবনের ব্যাপ্তি এতটাই যে বঙ্গোপসাগরের থেকে উঠে এসে দুই ২৪ পরগনা এবং বাংলাদেশ কে ছুঁয়ে রয়েছে। সামসের নগর পরে উত্তর সুন্দরবনে। আর বেশিরভাগ লোকে সুন্দরবন বলতে যা বোঝে তা হলো শুধুই দক্ষিণ ভাগটা।”
কথাটা ঠিকই। সুন্দরবন বলতেই যে নাম গুলো মাথায় আসে তা হলো সজনেখালী, সুধন্যখালী দোবাকী, বনি ক্যাম্প, নেতি ধোপানি, কলস দ্বীপ ইত্যাদি। উত্তরভাগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঝিঙ্গাখালী, বুড়ির ডাবরি, খাটুয়াঝুড়ি এবং হরিখালী। ঠিক হলো লীনার পূর্ব পরিচিত সামসের নগরের সুভাষ বিশ্বাসের ইকো স্টে তেই থাকা হবে।
পদার্পন:
ভোর ৬.১২ র হাসনাবাদ লোকাল ধরে ঘন্টা দুয়েকে পৌঁছে গেলাম হাসনাবাদ। স্টেশন থেকে সাইকেল ভ্যানে করে খেয়াঘাট মিনিট সাতেক। ভটভটিতে ১টাকা ভাড়া দিয়ে ইছামতী পার করে ওপারটা পার হাসনাবাদ।
বাজারের মধ্যে দিয়ে একটু এগোতেই বাস স্ট্যান্ড। ইছামতীর ওপর পাকা সেতুর কাজ অনেকটাই এগিয়েছে, হয়তো কিছু বছর পর আর ভটভটির প্রয়োজন হবে না। উঠে পড়লাম নেবুখালির বাসে। ঠিক এক ঘন্টা দশ মিনিটে হিঙ্গলগঞ্জ হয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম নেবুখালি। রায়মঙ্গল নদীর ঠিক পারেই বাস স্ট্যান্ড।
ভটভটিতে করে ওপারে দুলদুলি ঘাটে গিয়ে উঠলাম। সুভাষদা আগেই বলে দিয়েছিল দুলদুলি পৌঁছে ম্যাজিক বা জিও গাড়ি ধরে ওনাকে একবার ড্রাইভারের সাথে কথা বলিয়ে দিতে। তাই করলাম, ফোনের স্পিকার টা ওন করে দিয়ে। কথা শুনেই বুঝলাম সামসের নগরের সুভাষদা কে অনেকেই চেনে এখানে। ২১ টাকা জনপ্রতি ভাড়া ম্যাজিকের। সরু গ্রামের রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে ম্যাজিক। দুপাশে কোথাও থোকা থোকা সবুজের প্রাধান্য, কোথাও বা তুলে নেওয়া ধানের শুকনো ক্ষেত আবার কোথাও বা ছোট ছোট পুকুর আর মাটির বাড়ি।
জোগেশগঞ্জ ছাড়িয়ে কিছুটা এগোতেই আমাদের হাত ধরলো ডান পাশে কুরেখালি। সরু এই খাঁড়ির ওপাশেই হলুদ রঙের নেটের ফেন্সিঙে মোড়া সুন্দরী সুন্দরবন। গরান, গেঁও, কেওড়া আর সুন্দরীর ম্যানগ্রোভ জানান দিচ্ছে আমরা পৌঁছে গেছি বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে। কোনো কোনো জায়গায় খাঁড়ি ৮-৯ ফুটের বেশি চওড়া হবে না। বাঘ ও মানুষের এত ঘনিষ্ঠ সহাবসস্থান আগে কোথাও দেখিনি।
বিদিশার সুলতা দির কথাগুলোকে মিথ্যে ভাবার কোনো কারণ নেই। খাঁড়ির এপারের কাদামাটিতে মাঝেমাঝেই দেখছি এক দুটি নৌকো বাঁধা। এই নৌকোয় গ্রামবাসীরা কেউ বা যান সুন্দরবনের গভীরে মাছ ধরতে, কেউ বা মধু সংগ্রহে। কালিতলা বাজার ছাড়িয়ে একটু এগোতেই বাঁ হাতে সুভাষ দার হোম স্টে, “সুন্দরবন ইকো সেন্টার “। গেটের সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে পরিপাটি করে চুল আচড়ানো ছিপছিপে চেহারার এক নিপাট ভদ্রলোক। আমাদের সুভাষ দা!
ইকো স্টে:
সুভাষ দা গভীর আন্তরিকতার সাথে তাঁর ইকো স্টের সাজানো ঘরগুলো একেক করে আমাদের দেখালেন। একটা সরু গলি দিয়ে ঢুকে মেন গেট টা। ঢুকেই মাটির নিকোনো উঠোন।
একপাশে ৫ টি খাটের ডরমিটরি। ডর্মিটোরির খাটগুলিতে ৩ জন মানুষ এঁটে যাবে। ওপরদিকে একটি সরু করিডোর, তার একপাশে পর ৪ টি ঘর এবং অন্যপাশে বড় পুকুর। এই চারটি ঘরের দরজা খুললেই পুকুরের শোভা ঠিক সামনে।
সব কটি ঘর মিলিয়ে ৪০ জন থাকতে পারেন। একদম শেষে রয়েছে মনসা মন্দির এবং তার কিছুটা সামনে একটি গাছকে গোল করে ঘিরে ছাউনি দেওয়া সুন্দর বসার জায়গা। তার ওপরের ছাউনি থেকে কয়েকটি লণ্ঠন ঝোলানো। পুকুরের আরেক পাশে দুটি মাটির উনুন বসানো খোলা রান্নাঘর আর তার পাশে আরেকটি ঘর। এই ঘরটিতে সুভাষ দা থাকেন সপরিবারে।
তাঁর ছেলে বিপ্লব স্নাতক করছে আর্টসে। মেয়ে বিবাহিত। পরিবারের তিন সদস্যই মেতে উঠলো অতিথি আপ্যায়নে। বেলা গড়িয়ে তখন প্রায় ১.৩০টা। উঠোনে প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিল পেতে আমাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করলেন সুভাষ দা। অপূর্ব রান্নার হাত বৌদির। আমাদের খাইয়ে সুভাষ দা একটু বেরোলেন তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে কোনো এক অনুষ্ঠানে। বলে গেলেন উনি ৩.৩০ র মধ্যে চলে আসবেন তারপর আমাদের নিয়ে ঘুরতে বেরোবেন। আমরা গিয়ে বসলাম পুকুর পাড়ের সেই গোল বসার জায়গাটিতে। বিদিশার নতুন Nikon P900 টা নিয়ে কিছুটা এক্সপেরিমেন্ট, পুকুর পাড়ের মিঠে হাওয়া খেতে খেতে জমিয়ে আড্ডা আর ট্যুর প্ল্যানিং করতে করতে দিব্বি কেটে গেল ঘন্টা দুয়েক।
সুভাষ দা তাঁর কথামত যথাসময় হাজির। তৈরী হয়ে ৪টার কাছাকাছি আমরা মোটর চালিত সাইকেল ভ্যানে চেপে বেরিয়ে পড়লাম সুভাষ দার সাথে।
শেষ বিন্দু:
আসার সময় যে পথে এসেছিলাম, এখন তার উল্টোদিকে এগোলাম। ডান হাতে কুরেখালী। বাঁ দিকে কিছুটা দূরে দূরে মাটির কয়েকটি ঘর। ভাবলেও গায়ে শিহরণ হয় কয়েক বছর আগে অবধিও কুরেখালীর ওপাশের ফেন্সিং টা ছিল না। দক্ষিনরায়ের অবাধ বিচরণ ওপাশের ঘন বনাঞ্চলে আর এই খাঁড়ি যা সরু, তাতে তেনাদের সাঁতরে আসারও প্রয়োজন পড়বেনা, একটি লাফই যথেষ্ট এপারে আসার জন্য! কম মানুষ এই গ্রামে বাঘের শিকার হননি সেই সময় বছরের পর বছর। কিছুটা এগিয়ে একটি জায়গায় সুভাষ দা আমাদের নিয়ে নামলেন একটি জায়গায়। কুরেখালী এখানে অনেকটাই শুকনো। বাঁদরের স্বর্গ রাজ্য এই জায়গাটা। অজস্র বাঁদর ফেন্সিং ডিঙ্গিয়ে এদিকে এসে আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে দিয়েছে। এই জায়গাটির নাম পাখি বন।
আবার এগোতে লাগলাম। একসময় কুরেখালী খাঁড়িটিকে আর দেখতে পেলাম না। সুভাষ দা বললো সেটি গিয়ে মিশেছে কালিন্দী নদীতে। যত এগোচ্ছি জনবসতি কমছে, পরিবর্তে সঙ্গী হয়েছে শুকনো ধানক্ষেত আর ছোট ছোট জলাশয়।
হঠাৎ সামনে এলো ঝাউগাছ মোরা একটি করিডোর। ঠিক যেন একটি টানেল। এই ঝাউ ঘেরা টানেল অতিক্রম করতেই কোনাকুনি ভাবে চোখে পড়লো BSF এর ক্যাম্প।
পিচ রাস্তা যেখানে শেষ সুভাষ দা সেইখানে ভ্যানটা দাঁড় করালো। ইঁট বাঁধানো রাস্তা একটি গেছে বাঁ দিকে, অন্যটি ডান দিকে। আমরা বাঁ দিকটা দিয়ে হাঁটলাম। কিছুটা এগোতেই পেয়ে গেলাম সীমা সুরক্ষা বলের ক্যাম্প আর উল্টোদিকে কালিন্দী নদী। কালিন্দীর ওপারটাই বাংলাদেশ। এই জায়গাটাকেই বলে জিরো পয়েন্ট। ভারতবর্ষের একটি শেষ বিন্দু। গ্রামের লোকজনের এদিকটায় আসা নিষেধ।
ফোটো তোলা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ব। ফিরে এলাম ভ্যানের কাছে। এবার ভ্যান এগোতে লাগলো ডান দিকের ইট বাঁধানো রাস্তাটা দিয়ে। এই রাস্তাটি গিয়ে শেষ হয়েছে সুূর্য ঘাটে। কালিন্দীর রূপ এখানে অসামান্য। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওপারের ঘন সবুজে মোড়া বাংলাদেশের সুন্দরবন।
চলার পথে কালিন্দী আশ্রয় দিয়েছে বেশ কিছু ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জকে। তার কোনটা হয়তো বাংলাদেশের, কোনটা ভারতবর্ষের। এ এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। একটা নৌকো নিয়ে নেমে পড়লেই তো হলো। ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াবো দুই দেশের ওই দ্বীপপুঞ্জগুলোতে। ভুলেও ওই অভিসন্ধি করতে যাবেন না, যেকোনো সময় ঝাঁঝরা হয়ে যেতে পারেন সীমা সুরক্ষাবলের এ.কে ৪৭ এর গুলিতে। এছাড়াও এই জলপথ জলদস্যুদের অধ্যূষিত অঞ্চল ছিল এক সময়। আজও যে একেবারে নেই, তা নয়। তবে এখন তাদের মূল লক্ষ্য মাছ এবং কাঁকড়া ধরা নৌকো গুলো লুট করা। বেলাশেষের সূর্য এখন পাটে যাওয়ার অপেক্ষায়। সেই লালচে আভায় ডুবে থাকতে থাকতে হঠাৎ পেছেনে সুভাষ দা ছাড়া আরও একজনের উপস্থিতি টের পেলাম।
“ইনি বিশ্বরূপ মন্ডল” – আলাপ করিয়ে দিলেন সুভাষ দা। ” এক সময় এই এলাকায় বাঘ শিকারী ছিলেন। এখন উনি সুন্দরবন সংরক্ষণের সাথে যুক্ত।”
৩০ এর উপর বাঘ মেরেছেন বিশ্বরূপ বাবু। জেলও খেটেছেন সেই কারণে। তবে তার বাঘ মারাটা ছিল প্রয়োজনে, চোরাকারবারের জন্য নয়। কয়েক বছর আগেও এই অঞ্চলে বাঘের আনাগোনা গ্রামের ভেতর মাঝসাঝেই হতো। আত্মরক্ষার জন্য বন্দুক হাতে তুলে নিতে হয়েছিল তাকে। কালিন্দী বেয়ে বাংলাদেশে ঢুকে যাওয়ায় একবার ওই দেশেও কিছুদিন কারাবন্দী থাকতে হয়েছিলো। আজ সে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। SOIL নামে একটি NGO চালান। এবছর মার্চ মাসে কোলকাতায় তাঁর তৈরী সুন্দরবন নিয়ে একটি তথ্যচিত্র মুক্তি পেতে চলেছে। ভদ্রলোকের ব্যবহার খুব ভালো। গোধূলির শেষ আলোটা থাকা অবধি ওনার সাথে গল্প করতে করতে কেটে গেল। হোম স্টে তে ফিরে দেখি বিশ্বাস ঘরণী মাটির উনুনে গরম তেলের কড়াইয়ে সবে বেগুনি ছাড়ছেন। লীনাও হাত লাগলো তাঁর সাথে।
মুড়ি আর তেলেভাজার সঙ্গতে সুভাষ দার সাথে পরের দিনের ট্যুর প্ল্যানিং টা সেরে ফেললাম। আমরা চারজনই ইতিমধ্যে জায়গাটিকে নিজেদের ঘর ভাবতে শুরু করে দিয়েছি। উনারাও আমাদের তাদের পরিবারের একজন ভেবে ফেলেছেন। আগামীকাল দিনের বেলাটা পুরোটাই আমরা জলের ওপরে কাটাবো, সুভাষ দা আমাদের জন্য লাক্সারি লঞ্চ ঠিক করে রেখেছেন। দুপুরে একবার সুভাষ দা কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলেন গ্রামে এসে কি খেলে তৃপ্তি পাবো আমরা। তাতে আমি হাঁসের ডিম , লীনা কাঁকড়া আর বাকি দুজন দেশী মুরগির মাংসের আবদার রেখেছিলো। রাত্রে খাবার টেবিল এ এসে দেখি আমাদের চারজনের আবদারের যথাযথ মর্যাদা দিয়েছেন ভদ্রলোক। সত্যি এ যেন আমাদেরই আত্মীয়ের বাড়ি!
ঝিঙ্গাখালী:
সকাল সকাল উঠে চারজনে তৈরী হয়ে নিলাম। অদ্ভুত একটা উত্তেজনা আমাদের চোখে মুখে। আরেকটু পরেই আমরা রওনা দেবো বন্য সুন্দরবনের গভীরে। ঝিঙ্গাখালী, বুড়ির ডাবরি আর সব শেষে হরিখালী…এই তিনটি বীট আমাদের লক্ষ্য। এর মধ্যে বুড়ির ডাবরি থেকে বাকিটা কোর এরিয়ার মধ্যে পরে তাই বনদপ্তরের গাইড বাধ্যতামূলক। বৌদি ভোরবেলা উঠে রান্নার কাজে লেগে গেছিলেন আমাদের লাঞ্চ প্যাক তৈরী করতে। লুচি তরকারি জলখাবার খেয়ে চলে এলাম কালিতলা বাজারের জেটিতে। যাত্রার জন্য তৈরী হচ্ছে আমাদের ডাবল সিলিন্ডার এর লাক্সারি লঞ্চ – “খাদিজা”।
উপরের ভাগটার সামনের দিকে গদি পাতা একটি খাট। নিচের ভাগের কেবিন গুলোতেও বিছানা করা আছে। ধোয়াধুয়ি সম্পন্ন হতেই আমরা সুভাষ দার সাথে উঠে পড়লাম খাদিজায়। শুরু হলো যাত্রা। কুরেখালী খাঁড়ি ছাড়িয়ে আমরা পড়লাম রায়মঙ্গলে।
অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম ঝিঙ্গাখালি বীট এ। ঝিঙ্গাখালির ঘাটে তখন তিনটি লঞ্চ আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা MV Sarbajaya ছোট ছোট নৌকোয় তার ট্যুরিস্টদের ঝিঙ্গাখালির ঘাটে পাঠাচ্ছে। দেখে আমাদের চারজনেরই বিরক্তির একশেষ….দক্ষিণ ছেড়ে উত্তর সুন্দরবনে এসেও সেই ভিড়ের থেকে রেহাই নেই! জায়গা না থাকায় অন্য লঞ্চের গায়েই আমাদের খাদিজা ভিড়ল।
টপকে সেই লঞ্চের ভেতর দিয়ে আমরা ঘাটে উঠলাম। সুভাষ দা ঢুকেই চলে গেল বীট অফিসে সবার পারমিশন করাতে। বনদপ্তরের পারমিশন এই ঝিঙ্গাখালি থেকেই হয়। ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়লো বনবিবির মন্দির।
বনবিবির মন্দিরের একটি বিশেষত্ব হলো হিন্দু মুসলিম দুই ধর্মেরই সমন্বয় এই মন্দিরে এবং তার মূর্তিতে। চারটি মূর্তি – দুখে, জঙ্গলী, গাজীবাবা এবং দক্ষিণ রায়। ভেতরটা বাগান দিয়ে সাজানো আর তার মাঝখানে ওয়াচ টাওযার। ওয়াচ টাওযারে উঠে পেছনদিকের লোহার জালের বাইরে মিষ্টি জলের পুকুরটা নজরে পরে।
অরণ্যের বন্য প্রানীরা এই পুকুরে জল খেতে আসে কখনো খুব ভোরবেলায় অথবা কখনো রাত্রে। পুরো চত্বরটা উঁচু লোহার জাল দিয়ে ঘেরা। চিড়িয়াখানায় পশুরা খাচায়, আর এখানে মানুষ খাঁচায়…পশুদের অবাধ বিচরণ খাঁচার বাইরে। তবে কথা বলে বুঝলাম তাদের আনাগোনা সেই সময় যখন বীট অফিস ট্যুরিস্টদের জন্য বন্ধ থাকে।
যাঁরা এসেছেন তাঁদের বন্যপ্রাণ দেখার থেকে সেলফি তোলার দিকেই বেশি নজর। ঝিঙ্গাখালি বীট টা যেন একটি পার্কে পরিণত হয়েছে। সুন্দরবনে এসে পার্কে বসে সেলফি তোলার কোনো বাসনা আমাদের কারুরই নেই, অতএব বেরিয়ে পড়লাম পরবর্তী গন্তব্যর উদ্দেশ্যে।
বুড়ির ডাবরি:
ঝিঙ্গাখালি থেকে আমাদের সঙ্গী হলেন বছর তিরিশের বনদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত গাইড, রণবীর বাউলিয়া। রণবীর হেমনগরের বাসিন্দা, সুন্দরবনের বন্যজীবনের সাথেই তার বড় হয়ে ওঠা।
মিনিট ২০ চলার পর আমরা রায়মঙ্গল ছেড়ে ঝিলা নদী ধরলাম। সুন্দরবনের সম্বন্ধে অনেক তথ্য আর ঘটনা শুনতে শুনতে আমরা এগোতে থাকলাম বুড়ির ডাবরির দিকে। প্রায় ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এই সুন্দরবন। এরমধ্যে ৪২৬৪ বর্গ কিমি পশ্চিমবঙ্গে, বাকিটা বাংলাদেশে।
ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতিতে শেষ যে বাঘসুমারী হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে, তাতে বাঘের সংখ্যা ৮৬। তবে এই সংখ্যা কতটা নির্ভুল সে সম্পর্কে সংশয় আছে খোদ বনদপ্তরেরও। ক্যামেরা তো লাগানো অনেক দূরে দূরে। সব বাঘ যে সেই ক্যামেরাতে ধরা দেবে এটা ভাবা বোকামি। আর তাছাড়া, বাঘেদের তো আর বর্ডার ক্রস করতে ভিসা বা পাসপোর্ট লাগেনা। কখন সে পশ্চিমবঙ্গে আর কখন বাংলাদেশে তা ক্যামেরাতে ধরা সম্ভব নয়। বসিরহাট রেঞ্জ এ ৫টি বীট অফিস – ঝিঙ্গাখালী, বুড়ির ডাবরি, খাটুয়াঝুড়ি, হরিখালী এবং বাগনা। “সুন্দরবন বাইওসফিয়ার” শব্দটা আমরা অনেকেই শুনেছি। অরণ্য মানে কিন্তু শুধুই বন্য প্রাণী নয়। তার সাথে আছে উদ্ভিদ জীবন এবং সেই জায়গার স্থানীয় মানুষরা।
সব নিয়ে এই বাইওসফিয়ার। মানুষের জীবিকার সন্ধানে যাতে বন্যজীবন বিরক্ত না হয়, তার জন্য বাইওসফিয়ার কে আবার তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে – কোর এরিয়া, বাফার এরিয়া এবং ট্রান্সইশন এরিয়া। এর মধ্যে কোর এরিয়া তে স্থানীয় মানুষের প্রবেশ নিষেধ, বন্যজীবন দেখার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি এখানে।
বুড়ির ডাবরি এবং হরিখালী পড়েছে কোর এরিয়াতে। কোর এরিয়াকে ঘিরে থাকে বাফার জোন। মধু সংগ্রহ, মাছ ধরা, কাঁকড়া ধরা চলে এই বাফার জোনেই। মরিচঝাঁপি, আরবাসী..এই দ্বীপ গুলো পড়েছে বাফার জোনে।
একদম বাইরের দিকে ট্রান্সইশন জোন যেখানে মানুষের জনবসতি এবং চাষ আবাদের জমি। বাগনা বীট অফিসটি এই ট্রান্সইশন জোনে। বুড়ির ডাবরি যাওয়ার পথটি বাফার জোনে পড়লেও, বুড়ির ডাবরি এবং হরিখালীর অরণ্যভাগটাকে কোর এরিয়া বলেই গণ্য করা হয় কারণ দক্ষিণরায়ের আনাগোনা সবথেকে বেশি এই দুটি জায়গায়। ছোট বড় খাঁড়ি দিয়ে আমরা এগোতে থাকলাম। পাখি বলতে চোখে পড়লো kingfisher এবং plover।
“একটি প্রাপ্তবয়স্ক বাঘ রায়মঙ্গল বা ঝিলা সাঁতরে পার হতে পারে অনায়াসেই।” –
রণবীরের এই কথায় আমরা সকলেই একটু নড়েচড়ে বসলাম। অনতিদূরে দেখা যাচ্ছে ১২৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট মরিচঝাঁপি দ্বীপ। পশ্চিবঙ্গের ইতিহাসে মরিচঝাঁপি নামটা আজও লজ্জা দেয় আমাদের সভ্য সমাজকে। পার্টিশনের পরে বাংলাদেশের নিচু জাতের হিন্দুরা পশ্চিমবঙ্গে অন্য কোথাও আশ্রয় না পেয়ে চেয়েছিল সরকারের সাহায্য ছাড়াই এই মরিচঝাঁপিতে নিজেদের মতো করে বাঁচতে। প্রায় ৪০,০০০ মানুষ। মেনে নেয়নি সরকার, অজুহাত দেওয়া হলো সুন্দরবনের বায়ো ডাইভারসিটি নষ্ট হবে এদের দ্বারা। উপরন্তু তাঁদের ওপর শুরু হলো অকথ্য অত্যাচার। রাতের অন্ধকারে পোড়ানো হলো তাদের বাসস্থান। মহিলাদের ধর্ষণ আর পুরুষদের মেরে কেটে অর্পন করা হলো বাঘের আর কুমিরের খাদ্য হিসেবে। অবশেষে তাঁরা পালাতে বাধ্য হলেন দণ্ডকারন্য তে।
মরিচঝাঁপির কাছেই আরেকটি ছোট দ্বীপ, আরবেসি, আয়তন ১৫১ বর্গ কিমি। কাঠ কুড়োতে এসেছিলেন স্থানীয় এক দম্পতি। ডালগুলো কাটার পর দা দিয়ে পাতা ছাটছিলেন যাতে নিয়ে যেতে সুবিধে হয়। পেছন থেকে অতর্কিত তার ওপর ঝাঁপিয়ে পরে বাঘ এবং নিমেষের মধ্যে তাঁকে টেনে নিয়ে যায় জঙ্গলের গভীরে। হাতের থেকে তাঁর দা ছিটকে গিয়ে বেঁধে সামনের গাছে। প্রতিনিয়ত বিপদকে হাতেহাত ধরে নিয়ে চলার নামই হলো সুন্দরবন।
“বুনো শুয়োর। বুনো শুয়োর।”
– লঞ্চের ক্যাপ্টেনের অকস্মাৎ এই আওয়াজে আমরা ঘুরে তাকাতে কিছুই ঠাওর করতে পারলাম না। দেখার চোখ তখনও আমাদের তৈরী হয়নি। রণবীর রীতিমত তর্জনী নিক্ষেপ করে আমাদের দেখতে চেষ্টা করেও বিফল হলো। দেখলাম শুধু ওয়াইল্ড বোরের খুঁড়ে রেখে যাওয়া পলি মাটি।
” এতটা এলাম, কিছুই তো দেখতে পেলাম না। অন্ততপক্ষে হরিণ না দেখালে আমি কিন্তু নৌকো থেকে নামবো না।” – লীনা একরকম হুমকিই দিলো।
” ম্যাডাম। হরিণটা দেখানোর দায়িত্ব আমি নিলাম। ঠিক সময় দেখাবো আপনাদের। আর আমার মন বলছে হয়তো কুমীরও দেখতে পাবো।” – রণবীর আস্বস্ত করলো আমাদের।
প্রায় ১২.১৫ টা নাগাদ আমরা নামলাম বুড়ির ডাবরি বীট এ। এখানে আর সেই ঝিঙ্গাখালির ভিড়টা নেই। ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়তেই চোখে পড়লো লাল কাঁকড়া নিচের পলিমাটিতে। চোখ গুলো দুটো ছোট এন্টেনার ওপর বসানো। একটাই দাঁড়াশ। ফিডলার ক্র্যাব এদের নাম।
এখানেও যথারীতি আমরা খাঁচায় বন্দী হলাম। জায়গাটা ঝিঙ্গাখালির থেকে বড়। একেবারে মানগ্রোভের মাঝখান দিয়ে একটা canopy walk এর ব্যবস্থা আছে। মাটির থেকে ফুট চারেক উঁচুতে সিমেন্টের পাটাতন। দুধারে উঁচু লোহার জাল দিয়ে ঘেরা।
দু পা এগোতেই আমাদের থামিয়ে দিয়ে জালের ভেতরে তিন ফুট দূরের মাটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো রণবীর। এই তো সে! চোখে চোখে কথা হলো রণবীরের সাথে। একেবারে টাটকা তাজা পাগ মার্ক। রণবীর পর্যবেক্ষণ করে বললো এই পায়ের ছাপ আজ সকালের। তাকে দেখতে না পাই, প্রমান কিন্তু পেয়ে গেলাম যে তারা আছে….আমাদের ঘিরে।
Canopy টা পুরো চক্কর মারতে বুঝলাম অনেকগুলো জায়গাতেই তার বা তাদের আগমন ঘটেছে আজ সকালে। ওয়াচ টাওয়ারের পাশেই একটা জায়গায় ফলকে লেখা বুড়ির ডাবরি নিয়ে একটি কবিতা। সুভাষ দা আগেই বলেছিলেন বুড়ির ডাবরি নিয়ে একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাবেন। এই ফলকের পাশে দাঁড়িয়ে খুব সুন্দর আবৃত্তি করে শোনালেন কবিতাটা।
খুব বেশি আর আমরা এখানে দেরী করলাম না। রণবীরের সাথে সাথে আমরাও আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে এইটা বুঝেছিলাম যে বন্যপ্রাণ পেলে আমরা চলার পথেই পাবো, এই বীট গুলোতে অন্তত এই সময় নয়।
বন্য সুন্দরবন:
বেলা গড়িয়ে প্রায় দুপুর ১টা। পারি দিলাম হরিখালীর পথে। একটু যেন আশাহত আমরা চারজনে। এতটা জলপথ পাড়ি দিয়ে এলাম অথচ সেই অর্থে বন্যপ্রাণীর দর্শন এখনও পেলাম না। আমাদের মনোভাব বুঝতে পেরে রণবীর বাজ পাখির দৃষ্টিতে ম্যানগ্রোভ গুলো স্ক্যান করা শুরু করে দিয়েছে।
“এইখান থেকে হরিখালী প্রায় আরও ২ ঘন্টার পথ। ছোট খাঁড়ি কয়েকটা পাবো পথে। সেখানে কিছুনা কিছু ঠিক পাবো।” – রণবীর আবার আস্বস্ত করলো আমাদের।
সুভাষ দা ততক্ষনে আমাদের মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করে ফেলে আমাদের ডেকে নিলেন। খাওয়া প্রায় শেষের দিকে।
“দাদা, হরিণ।” – রণবীরের আওয়াজে আমি আর স্নেহাংশু একলাফে খাওয়া ছেড়ে উঠে, হাত ধুয়ে ক্যামেরায় চোখ লাগলাম। দেখি ম্যানগ্রোভ এর আড়াল থেকে উকিঁ মারছে এক জোড়া বাহারী লম্বা সিং। লঞ্চটি আরেকটু সামনে গড়াতেই দৃশ্যমান হলো আরও তিনটি চিতল হরিণ।
তিন ঘন্টা অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে সবুজ অরণ্যে চোখ রেখে বন্য প্রাণের দেখা মেলা…সে এক অন্য মাত্রার তৃপ্তি। নতুন আবিষ্কারের যে আনন্দ, এও যেন অনেকটা সেরকম। বাকি খাবারটা শেষ করে যে যার জায়গা নিয়ে বসে গেলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দেখি স্নেহাংশু লোয়ার ডেকে, লীনা আপার ডেকের সামনের গদিতে আর বিদিশা পেছনদিকের একটি চেয়ারে দিব্বি ঘুম লাগিয়েছে। তন্দ্রা যে আমারও আসছিলনা তা নয়, তবে কিসের যেন নেশায় দুচোখের পাতা তখনও এক হয়নি। রণবীর ছিল ক্যাপ্টেনের সাথে কেবিনে। আমি একেবারে সামনের দিকে চেয়ারে বসে। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম ওরা দুজন উত্তর-পশ্চিম দিকে তাকিয়ে কিছু একটা নিয়ে আলোচনায় মত্ত।
“স্যার একটু বাইনোকুলার টা দিন তো।” – রণবীর কখন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পাইনি।
বাইনোকুলারে কিছুক্ষণ চোখ রেখে রণবীর যন্ত্রটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বোলো – “দেখুন তো চরের ওপর ওটা কী।”
দেখলাম বটে কিন্তু বহু দূরে একটি সাদা রঙের গাছের গুড়ি ছাড়া আর কিছু ঠাওর করতে পারলাম না। আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য রণবীর আমার ৭০-৩০০ লেন্সটা ফুল জুম্ করে দেখলো।
“হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছি। ওটা কুমির। ভালো করে দেখুন স্যার।” – বলে রণবীর ক্যামেরাটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। অনেক্ষন পর্যবেক্ষণ করে এবার আমিও ওই সাদা গাছের গুঁড়িটার মধ্যে একটি আকার খুঁজে পেলাম। কুমীরই বটে! শুকনো পলিমাটির প্রলেপে কুমিরটি সাদাটে লাগছে ঝকঝকে রৌদ্রে। লঞ্চ ঘুরিয়ে আমরা এগোতে থাকলাম সেইদিকে। ইতিমধ্যে সুভাষ দা নিজে দায়িত্ব নিয়ে বাকি তিনজনকে ডেকে তুলেছেন। চরের থেকে ৪০ ফুট মতন দূরত্বে পৌঁছে আমাদের চারজনেরই মুখ হাঁ।
“Oh my God! এতটা বড় !” – এই কথাটা প্রায় বার দশেক আওড়ে ফেললো লীনা।
সত্যি। কুমীর যে আগে দেখিনি তাতো নয়। তবে এমন বিশালাকায় দানবিক কুমীর মনে হয় না দেখেছি। লেজ টা অল্প গুটিয়ে চোখ বুঝে পরে আছে। আমাদের দিকে তার যেন কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই! লেজ টা গোটানো বলেই দূর থেকে পুরো আকারটা ঠাওর করতে পাচ্ছিলাম না। ক্যাপ্টেন সহ তার সাঙ্গপাঙ্গরাও দেখলাম মোবাইলে কুমিরটির ফোটো তোলা শুরু করে দিয়েছে। তাঁদের হাবভাবেও বুঝলাম এত বড় কুমীর তাঁদের নজরেও সচরাচর পড়েনা। হঠাৎ সবার খেয়াল হলো, চরম উত্তেজনায় স্নেহাংশু কখন যেন লঞ্চের একেবারে সামনের ভাগটায় শুয়ে পরে ফোটো তুলছে। পাড়ের কাছে জল কম হওয়ায় কুমীর আর স্নেহাংশু প্রায় সমান লেভেলে। ক্যাপ্টেন বেশ বিরক্ত হয়ে ওকে তৎক্ষণাৎ ওখান থেকে উঠে আসতে বললো। ৩০-৪০ ফুট দূরত্ব একটা প্রাপ্ত বয়স্ক কুমীর বিদ্যুৎ গতিতে অতিক্রম করে ধেয়ে আসতে পারে যেকোন সময়।
প্রাণ ভরে ছবি নিয়ে এগিয়ে চললাম হরিখালীর দিকে। মাঝে পেলাম কাটোয়াঝুড়ি বীট অফিস। এই বীট অফিসটি বনদপ্তর এবং সীমা সুরক্ষাবল দুজনেরই অধীনে, তাই ট্যুরিস্টদের এখানে নামানো হয়না।
কিছুটা যেতে না যেতেই ডান হাতে ম্যানগ্রোভ এর মাঝে একটা ফাঁকা জায়গা নজরে এলো। এতক্ষনে আমাদেরও চোখ তৈরী হয়ে গেছে। এক ঝলক দেখেই বুঝলাম ৫-৬ টি চিতল খেলে বেড়াচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে ওই ফাঁকা জায়গায়। দূর থেকেই ফোটো তুললাম। রণবীরের মতামত, ওদের বিরক্ত না করলে আমরা ফেরার সময় একই জায়গায় হয়তো আবার পাবো কারণ হরিখালী আমরা প্রায় পৌঁছেই গেছি।
হরিখালী:
হরিখালী বীট টা বেশ ফাঁকা। আমরাই একমাত্র ট্যুরিস্ট তখন। পেল্লায় এক ওয়াচ টাওয়ারের নির্মাণের কাজ প্রায় শেষের দিকে, এখনো উদ্বোধন হয়নি। বনবিবির মন্দির এখানেও পেলাম।
পেছনদিকে কিছুটা ফাঁকা জায়গার পর গভীর জঙ্গল। বাঘের পায়ের ছাপ এখানেও পেলাম। মন আমাদের পড়ে আছে সেই হরিনের দল আর কুমীরটির দিকে। তাই এখানে আর বেশিক্ষণ না থেকে বেরিয়ে পড়লাম ফিরতি পথে। রণবীরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সত্যি প্রশংসনীয়। ঠিক একই জায়গায় আবার দেখা পেলাম হরিনগুলির, এইবার সংযোজন একটি হরিণ শাবকেরও।
কুমীরটিকেও ঠিক যে জায়গায় ছেড়ে এসেছিলাম, সেখানেই পেলাম আবার তবে এইবার আরও কাছে গিয়ে ক্লোস আপ নিতে বুঝলাম বাবাজি কিন্তু চোখ খুলে আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। ভেবেছিলাম ওর জলে ফেরত যাওয়ার দৃশ্যটা লেন্স বন্দী করবো। সেই সৌভাগ্য আর হোলো না কারণ একচুলও নড়লেন না তিনি।
রওনা দিলাম ফেরার পথে, এবার একটু শর্ট কাট রুটে। শুশুকের ডিগবাজি আর পড়ন্ত বেলায় রায়মঙ্গলের রূপ দেখতে দেখতে আমরা এগোচ্ছি। চোখে মুখে ঠান্ডা হওয়ার স্পর্শ। জ্যাকেট টা গায়ে চাপিয়ে ৭০-৩০০ পালটে ১৮-১০৫ নিয়ে আবির রাঙা রায়মঙ্গলকে ক্যামেরা বন্দী করছি।
হঠাৎ দেখি পূবের আকাশের রক্তিম ক্যানভাস জুড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট ছোট পাখির দল তাদের বাসায় ফেরার আনন্দে আকাশ বাতাস মাতিয়ে তুলেছে।
আকাশের বুকে যেন কেউ সুবিশাল একটি নক্সা করা ওড়না এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এক নিজস্য এক ছন্দে দুলিয়ে চলেছে। দলে ওরা শত সহস্র। এত ক্ষুদ্র আর এত দ্রুত তারা, আমার ক্যামেরা হার মানলো। শুধুই প্রাণ ভরে অনুভব করলাম সেই দৃশ্য। কালীতলা বাজারের জেটিতে উঠে ভ্যানোতে করে ইকো স্টে ফেরার রাস্তা ধরলাম। বাজার এলাকাটি ছাড়াতেই অন্ধকার রাস্তা, সম্বল শুধু অর্ধচন্দ্রর ফিকে আলো। সকালের সেই উচ্ছল গ্রামটি এখন ঝিমন্ত। ইকো স্টেতে ফিরে সন্ধ্যার “স্ন্যাকস” দেখে আমরা হতবাক। বিশ্বাস গিন্নির নিজের হাতে বানানো পাটিসাপটা, মুড়ি আর চা, এত একেবারেই অপ্রত্যাশিত! রাত্রে যথারীতি দেশী মুরগির মাংসের ঝোল ভাত খেয়ে আমরা যে যার ঘরে গিয়ে দেহ রাখলাম।
কান্ট্রি বোট:
আজ তৃতীয় দিন। আমাদের ঘরে ফেরার পালা। সবারই মন একটু যেন ভারাক্রান্ত। বিশ্বাস পরিবারের আতিথেয়তায় আর অন্তরিকতায় বুঁদ হয়ে বেশ কাটলো দুটো দিন তাদের পরিবারেরই সদস্য হয়ে। সুভাষ দা আগেই বলে দিয়েছিলেন আজ দুপুর লাঞ্চ না খাইয়ে আমাদের ছাড়বেন না।
“তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিন। আজ আপনাদের কান্ট্রি বোট এ করে ঘোড়াবো।” – সুভাষ দা আস্তিন থেকে শেষ দিনের চমক টা বের করলেন।
তৈরী ছিলাম না আমরা, বেরোতে একটু দেরীই হলো। আজ আমাদের সঙ্গী বিপ্লব। ইকো স্টের একেবারে পেছনদিকটায় যেখানে গোল বসার জায়গা, সেদিকে একটা বেড়ার গেট। গেট খুললেই ধূ ধূ করছে শুকনো ধান ক্ষেত।
ধান ক্ষেত ধরে আমরা হাঁটতে থাকলাম। মিনিট দশেক হেঁটে কয়েক ঘর মাটির বাড়ি পেরিয়ে পিচের রাস্তা। রাস্তার ওপারে খড়ের তৈরী বনবিবির মন্দির একেবারে কুরেখালীর গায়ে।
তার পাশের কাদামাটিতে একটি ছোট নৌকো। জোয়ারের জল অনেকটাই নিচে নেমে গেছে। অতএব সবাই হাঁটুর ওপর অবধি প্যান্ট গুটিয়ে কাদায় পা দিলাম। পা একেবারে হাঁটুর ঠিক নিচ অবধি নরম কাদায় ঢুকে গেল। স্নেহাংশু লেগে পড়লো বিপ্লবের সাথে নৌকোটিকে কাদা থেকে টেনে জলে নামানোর জন্য। একেক করে আমরা সবাই এক হাঁটু কাদা ভেঙে নৌকোয় গিয়ে উঠলাম। আড়াআড়ি ভাবে ৪ টি পাটাতন সরু নৌকোটিতে। একেকটি পাটাতনে ভালোভাবে এক জনই বসতে পারবে এতটাই সরু।
চারজনে স্থিতু হতে বাইচা ধরলো বিপ্লব। সরু খাঁড়ি দিয়ে দুলকি চালে আমরা এগোতে থাকলাম। আমাদের এক পাশে ফেন্সিং দিয়ে ঘেরা সুন্দরবন, গরান আর কেওড়ার শ্বাসমূল গুলো কাদামাটি থেকে মাথা উঁচিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। অন্য দিকে গাছের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে উকিঁ মারছে সামসের নগরের গ্রাম্য জীবন।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক আমরা খাঁড়িতে ভেসে বেড়ালাম। এক অভিনব অভিজ্ঞতা। পথে দেখা হোলো plover, black capped kingfisher,blue kingfisher, horse shoe crab আর pond heron এর সাথে।
জল ক্রমাগত কমছে। বেশ কিছু জায়গায় জলের নিচের মাটি দেখা যাচ্ছে। আর এগোনো ঠিক হবে না, নৌকো আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। যাত্রা শুরু করেছিলাম যেখান থেকে সেখানেই ফিরে এলাম। জল আরও নেমে যাওয়ায় কাদামাটির ভাগটা আরও বেশি এখন। চটি, ক্যামেরা হাতে নিয়েই হাঁটা লাগলাম কর্দমাক্ত অবস্থায়। মাটির বাড়িগুলো পাশ কাটিয়ে এগোতেই লীনার মন চলে গেল শিমের ক্ষেতে। মালিকের অনুমতি নিয়ে দিব্যি কয়েকটা টাটকা শিম পেড়ে নিলো টপাটপ। ক্ষেতের ওলকপিও নেওয়া হলো।
বিদায় বেলায়:
ইকো স্টে তে ফিরে পুকুরের জলেই কাদামুক্ত হলাম। খাওয়াদাওয়া সেরে বেরোতে বেরোতে প্রায় ৩টে বাজলো। লীনার আবদারে সুভাষ দা নিজের বাগানের থেকে এক গোছা পুঁইশাক একটি ব্যাগে ভরে দিলেন। বিদায় নেওয়ার পালা উপস্থিত। মনে এক ইচ্ছা নিয়ে ফিরলাম আমরা চারজনই। একবার এসে যেন মন ভরলো না। ঘন বর্ষায় সুন্দরবনকে দেখার প্রলোভনটা মনের মধ্যে অগোচরেই দানা বাঁধতে শুরু করেছে। জীবিকার সন্ধানে নৌকো নিয়ে এই গ্রামের যে মানুষগুলো টানা ৩-৪ দিনের জন্য সুন্দরবনের গভীরে কোনো এক খাঁড়িতে মাছ ধরার জন্য নৌকাতেই অস্থায়ী আস্তানা করেন, পারবো কি কোনোদিনও তাদের সাথে সেই নৌকোয় থাকতে? সেই যে দম্পতি যারা গেছিলেন আরবাসীর গভীর জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে, পারবো কি কোনোদিন ওনাদের সাথে যেতে? মধূ সংগ্রহের জন্য যে মানুষগুলো যেকোন সময় দক্ষিণরায়ের সম্মুখীন হতে পারে, পারবো কি কোনোদিনও তাদের সাথে মাথার পেছনে মুখোশ লাগিয়ে এই অরণ্যের শিরা উপশিরায় বিচরণ করতে? হয়তো না! আর তাই যে সুন্দরবন আমাদের কাছে বিলাসিতা, সেই অরণয়ই এই মানুষগুলোর কাছে জীবিকা!
© Arijit Kar
Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.
Please accept my sincere appreciation, I will treasure your lovelaced travelscape.
Your humble Fan. Kabir.
It’s my pleasure sir 💐
Thank you so much
আমাদেরও একবার এপথে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্হা কোরো
হ্যাঁ দিদি, ইচ্ছা আছে