অরণ্য সুন্দরী লোধাসুলি
১:
২০০৯-১০ সাল। লোধাশূলী। জঙ্গলমহলে অন্তর্ভুক্ত এই জায়গাটির নাম তখনও প্রায়শই উঠে আসতো খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। কখনো গোটা একটি বাসের ওপর গুলির বর্ষণ করে গ্রামবাসীর অপহরণ, কখনো সি.পি.এম এর পার্টি অফিস বোমার আঘাতে উড়ে যাওয়া আবার কখনো পথ চলতি পুলিশের টহলদারী জিপ বোমার ঘায়ে উড়ে যাওয়া…মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চল বলে বদনামের ভাগিদার হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই লোধাশূলী বহু বছর ধরে। বছর দুয়েক আগে বাংরিপোসী যাওয়ার সময় এই লোধাশূলীর আদিম বন্য সৌন্দর্য দেখার পর থেকেই মনে দাগ কেটে গেছিলো জায়গাটি। একটু খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারি রাজনৈতিক তৎপরতার কারণে হোক, বা কোনো কূটনৈতিক পদক্ষেপ হোক অথবা কোনো পরীর জাদুদণ্ডের প্রলাপের ফলেই হোক…লোধাশূলী আজ শান্ত। ধারণাটির সপক্ষে আরও অকাট্য যুক্তি পেলাম যখন পশ্চিমবঙ্গ বন দফতর (WBFDC) এই বছরের জানুয়ারি মাসে খোদ লোধাশূলীর শালের জঙ্গলের মাঝে তাঁদের নিজস্ব প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্রটি উদ্বোধন করে ফেললেন। মে মাসের গরমকে উপেক্ষা করেই পাঁচজন ভবঘুরে বেড়িয়ে পড়লাম এক শনিবার সকালে।
২:
এবারেও বাহন আমার বহু ভ্রমণের সঙ্গী, আমার সাধের ওয়াগন-আর। উল্টোডাঙ্গা থেকে লীনাকে তুলে বাইপাস ধরে বাইপাস ধাবার উল্টোদিকে পৌঁছতেই দেখি বাকি তিন মূর্তিমান হন্তদন্ত হয়ে রাস্তা পার করে এগিয়ে আসছে। ঘড়িতে তখন ৭.৩০ টা। স্নেহাংশু আর বিদিশা তো আছেই। তার সাথে এবারে নতুন সদস্য কৌশিক। উচ্চতায় ৬ফুটের উর্ধে। পরনে হিপি মার্কা কালো টি শার্ট, ততোধিক কালো থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট, কালো টুপি এবং কালো চশমা। ৪০℃ তাপমাত্রাকে প্রতিহত করার জন্য আপাদমস্তক নিজেকে এমন কালোয় মুড়ে কেন যে সজ্জিত হয়ে এসেছিল কৌশিক, তা সেই মুহূর্তে ঠাওর করতে না পারলেও পরে বুঝছিলাম ছেলেটি সত্যি ব্যতিক্রমী!
মা, এজিসি ফ্লাইওভার, বিদ্যাসাগর সেতু ডিঙ্গিয়ে NH 16 ধরার পর গতিবেগ ১২০ ধরে রাখতে পারলাম বেশ কিছুটা রাস্তা। মাঝে কোলাঘাটে সেরে নিয়েছিলাম জলখাবার। সোজাসুজি লোধাশূলী না ঢুকে প্ল্যানে ছিলো কয়েকটি জায়গা ঘুরে তবে গন্তব্যে ঢুকবো। খড়্গপুর ছাড়িয়ে গড় শালবনি ক্রস করে কিছুটা এগোতেই নেভিগেটর জানান দিলো সামনেই বাঁ হাতের রাস্তাটি যেটা হাইওয়ে ছেড়ে নেমে যাচ্ছে সেটাই রোহিনী গ্রামের রাস্তা।অর্থাৎ রোহিনী রাজবাড়ি সে পথেই। “গুপ্ত মণির মন্দিরটা কাছেই হবে” – লীনার স্বগতোক্তি। অগত্যা গাড়ি দাঁড় করিয়ে আগুয়ান এক সাইকেল আরোহীর সাহায্য নিয়ে জানলাম মন্দিরটি হাইওয়ে ধরে আরও কিছুটা এগিয়ে দেন হাতে রাস্তার ওপারে পরবে। অর্থাৎ গুপ্ত মণি মন্দির দর্শন করে গাড়ি ঘুরিয়ে এনে আবার এই রোহিনীর রাস্তা ধরতে হবে।
কথামত এগোতেই ওপারে হাইওয়ের একেবারে লাগোয়া গুপ্ত মনি মন্দির পেয়ে গেলাম। আদিবাসী মন্দিরটির একপাশে ঝোলানো অজস্র ছোট ছোট পোড়া মাটির ঘোড়া এবং তার সাথে লাল তাগা। আজ ওদের কোনো পরব। সারি সারি ভক্তগণ আসছে ডালা সাজিয়ে পূজো দিতে।
৩:
দর্শন সেরে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ধরলাম রোহিনীর সেই রাস্তা। এই রাস্তা ধরেই আমরা পৌঁছবো রোহিনী রাজবাড়ি। দুপাশে শুকনো ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে নিটোল কালো পিচের রাস্তা। চোখ আটকে গেলো একটা জায়গায় এসে। একপাশে ন্যাড়া ধানি জমির পরেই কচি সবুজ ঘাসের গালিচা। রাস্তার অন্য পাশে বিঘার পর বিঘা শুকনো ধানের ক্ষেত। সবে নেমে একটু হাত পা টান টান করছি। হঠাৎ লীনার চিৎকার -” আরে করো কি? করো কি? মারধোর খাবে নাকি?” চমকে পেছন ফিরে দেখি কখন জানি কৌশিক রাস্তা থেকে নেমে আলের ওপর বসে থাকা ছাতা মাথায় দেওয়া এক বয়স্ক মহিলার একেবারে ঘাড়ের কাছে গিয়ে মোবাইল তাক করে ওনার ছবি তোলার এক বৃথা প্রচেষ্টায় লিপ্ত।
বৃথা কারণ সেই মহিলা রীতিমতন বিরক্ত হয়ে বার বার ছাতা দিয়ে নিজেকে আড়াল করেই চলেছে আর কৌশিক ততোধিক উৎসাহে মোবাইল বাগিয়ে মহিলাকে ঘিরে হামাগুড়ি দিয়েই চলেছে! উত্তম মধ্যম খাওয়ার জন্য সত্যি বিলক্ষণ পরিকল্পনা আর কি। সবার আর্ত চিৎকারে অবশেষে আমাদের ব্যতিক্রমী বীর পুরুষ নিরস্ত্র হলো। পরে খেয়াল করলাম স্নেহাংশুও ততক্ষণে মাথায় গামছা জড়িয়ে আল বেয়ে নেমে ধানক্ষেতে শুয়ে ৩০ ফুট দূর থেকে কৌশিকের এই লুকোচুরি খেলা ক্যামেরা বন্দী করছে। রাস্তার অপরদিকে তখন অন্য আরেক ছবি। সদ্য তোলা ধানের গুচ্ছ মাথায় নিয়ে চলেছে কৃষকের দল। উন্নয়নের ছোঁয়ায় ধান কাটার কল জায়গা করে নিয়েছে ধান ভাঙ্গা ঢেঁকির বদলে। সেই ধান কলের পাশেই জড় করা শুকনো ধানের বান্ডিল। পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে সেই মহাযজ্ঞে ব্যস্ত।
৪:
গ্রীষ্মের দাবদাহে এতক্ষণের কসরতে আমরা এখন গলদঘর্ম। গাড়ি বাড়ালাম রোহিনীর পথে। বেশ কিছুটা যাবার পর পিচ রাস্তা গেলো উধাও হয়ে। নতুন রাস্তা বানানোর কাজ চলছে এদিকটায়। সামনেই দেখি একটা জটলা। একটা লরি সমেত খান পাঁচেক গাড়ি রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে। খোঁজ নিয়ে জানলাম গ্রামের লোকেরা পথ অবরোধ করেছে। গ্রামে বিদ্যুৎ জল সরবরাহ করার দাবীতে। মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে বুঝলাম এই জটলা সহজে ভাঙবার নয়। সামনের একটি গাড়ি ইউ টার্ন নিতেই ওকে রোহিনীর বিকল্প পথ জিজ্ঞেস করলাম। আমাদের সৌভাগ্য সেই গাড়িটিও রোহিনীর দিকেই যাবে। পিছু নিলাম সেটার। কিছুটা আগে ছেড়ে আসা গ্রামের এক সরু রাস্তায় ঢুকলাম। প্রায় ৪ কিমি ঘুরপথে আমরা পৌঁছলাম রোহিনী রাজবাড়ি। দেখেই বোঝা যায় এই রাজবাড়ি হাল আমলে নতুন করে বানানো। ভেতরে রীতিমত বর্তমান ভাগিদারদের বাস। অতএব ভেতরে ঢুকে ঘুরে দেখার এই মুহূর্তে কোনো প্রশ্ন নেই। রওনা দিলাম পরবর্তী গন্তব্য কোদোপালের পথে।
৫:
আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এসে পড়লাম গ্রামের শেষ প্রান্তরে। সামনেই নদী। তবে নদী বলা ভুল কারণ এখন তাতে বেশিরভাগটাই শুকনো খটখটে চর। ওপারে চোখে পড়ছে কোদোপাল এগ্রো ট্যুরিজম এর গেট। সুবর্ণরেখা এবং ডুলুং নদীর সংযোগ স্থল এই কোদোপাল।
গাড়ি যাবার মতো দুটি বাঁশের সেতু করা আছে নদীর উপর। বর্ষায় এই পথের আর কোনো অস্তিত্ব থাকেনা। গাড়ি নামিয়ে দিলাম নদীর চরে। দুপাশে বিস্তৃত লাল মাটির চর। ফাঁকে ফাঁকে জানান দিচ্ছে সুবর্ণরেখা এবং ডুলুং এর উপস্থিতি। সেই অবশিষ্ট জলের রেখায় গা ভিজিয়ে নিচ্ছে মোষের দল আর উঁকি মারছে পারে বাঁধা দু একটি ছোট নৌকো।
দুরুদুরু বুকে সেতু দুটি পার করে ওপারে উঠে আবার চলার শুরু। মিনিট ৪০ লাগলো আমাদের ওখান থেকে রামেশ্বর মন্দির পৌঁছতে। গোপীবল্লভপুরের কাছাকাছি এই মন্দির অবস্থিত। স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী শ্রী রামচন্দ্র একবার এসেছিলেন সুবর্ণরেখার পাশে এবং সেখানে একটি শিবলিঙ্গ স্থাপন করেন। তার থেকেই মন্দিরের এই নামকরণ। মন্দিরের গঠনশৈলীতে ওড়িয়া স্থাপত্যের ছোঁয়া। প্রাচীন মন্দিরটি অবশ্য এখন শুধুই ভগ্নাবশেষ। অবশিষ্ট আছে অনন্য সুন্দর ভাস্কর্যে মোড়া প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা থাম গুলি। নতুন মন্দিরটির সম্মুখভাগ ঘিরে আছে এই সিংহ মুখ থামগুলো। চারিদিকে সবুজের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা একা এই মন্দিরটি খুবই দৃষ্টি নন্দন।
৬:
ঘড়ির কাঁটা এখন প্রায় বেলা ১টা ছুঁই ছুঁই। পেটে ছুঁচোর ডন আর তার সাথে দুঃসহ গরম। ক্লান্ত শরীর সকলেরই। কিন্তু বেড়ানোর আনন্দ সব ক্লান্তিকে ছাপিয়ে গিয়ে আমাদের জিয়ে রেখেছে। গাড়িতে উঠে আবার চলার শুরু। বিদিশার থেকে থেকে -“অরিজিৎ দা, এসি টা তিনে করে দেবে গো”, ছাড়া কারও গলায় আর বিশেষ কোনো আওয়াজ নেই। গাড়ি ছোটালাম তপবনের পথে। আধ ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে আমরা ঢুকলাম তপোবন অরণ্যে। একটু আগে যে ক্লান্তি তার নাগপাশে আমাদের জর্জরিত করার প্রচেষ্টায় ছিলো, এই অরণ্যে প্রবেশ করতেই এক ঝটকায় সেই নাগপাশ আলগা হয়ে দূরে কোথায় জানি উবে গেলো চিরতরে। দুপাশে অদ্ভুত এক কচি সবুজের ঘন জঙ্গল।
গাছ গুলোর উচ্চতা মাঝারি তাই চোখ ধাঁধানো সবুজের ওপর ঘন নীল আকাশের চাদরটাও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মাঝখান দিয়ে লাল মাটির মোরামের রাস্তা। এতো সবুজ, এতো লাল, এতো নীলের এমন ঝকঝকে সমন্বয় এর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে ট্রাইপড নিয়ে হেঁটে একটু এগিয়ে যেতেই টের পেলাম এই ভর দুপুরবেলাতেও কি ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা গ্রাস করে আছে চারিদিক। সেই নিস্তব্ধতা চিরে চমকে দিয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁর কর্কশ ডাক। পরের কিছু মুহূর্ত ডুবে থাকলাম ছবি তোলাতে। হঠাৎ খসখস করে একটা আওয়াজে বাকরুদ্ধ হয়ে কান খাড়া হয়ে গেলো পাঁচ জনেরই। কোনো বন্য প্রাণী নাকি? গুটি গুটি পায়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম সকলে। আমাদের পাঁচ জোড়া চোখ স্ক্যান করে চলেছে দুপাশের জঙ্গল কিসের যেন আশায়। খানিকপর আবিষ্কৃত হলো আওয়াজের উৎস। মোরামের রাস্তায় পড়ে থাকা শুকনো পাতার উপর সাইকেলের চাকার আওয়াজ। লোকটি গাড়ির সামনে এসে থেমে জিজ্ঞেস করলো -“এখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন? কোথায় যাবেন?” তপোবন বাল্মীকি আশ্রম যাবো শুনে সে রাস্তা বুঝিয়ে দিলো আর তার সাথে সতর্কবাণী – “এই জঙ্গলে এরকম ভাবে বেশিক্ষন দাঁড়াবেন না। জায়গাটা ভালো নয়।” মিনিট সাতেক ড্রাইভ করেই আমরা পৌঁছে গেলাম তপোবন মন্দির বা বাল্মীকি আশ্রমের দোরগোড়ায়।
একটি ছোট পুলের এপারে গাড়ি রেখে হেঁটেই গেলাম পুল টপকে আশ্রমে। যেমন শান্ত পরিবেশ ঠিক তেমনই অদ্ভুত এক শীতলতা তার আঁচলে ঢেকে রেখেছে আশ্রম সংলগ্ন ঘরগুলিকে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে সেই ঘন নিবিড় তরু ছায়ায়। কথিত আছে ঠিক এই জায়গাতেই দস্যু রত্নাকর তপস্যায় বসে পরিণত হয়েছিলেন ঋষি বাল্মীকিতে। এবং তপবনের এই বাল্মীকি আশ্রমে স্বয়ং দেবী সীতা তাঁর দুই পুত্র লব ও কুশ কে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন কিছুদিনের জন্য। সকাল থেকে কাঠ ফাটা রোদে গত ৭ ঘন্টার ক্লান্তি সত্যি ভুলিয়ে দিলো এই তপোবন।
৭:
আজকের মতো টোটো করার ইতি করে ধরলাম লোধাশূলীর রাস্তা। জঙ্গলের রাস্তা ছাড়িয়ে হাইওয়েতে উঠতেই আবহাওয়ার পরিবর্তন। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে। দুপাশের শালের জঙ্গলের বুক চিরে দৌড়ে চলেছে এই হাইওয়ে। বনদপ্তর এর যে টিম্বার ডিপো আছে তার ভেতরেই আমাদের গন্তব্য লোধাশূলী প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র। হাইওয়ে ছেড়ে একটা রাস্তা চলে গেছে ডান দিকে, এই রাস্তা ধরে ৪০০ মিটার মতন গেলেই ডান হাতে টিম্বার ডিপোর গেট। গার্ডকে বুকিং আছে বলতেই গাড়ি সমেত আমাদের ভেতরে পাঠিয়ে দিলো। চারপাশে শালের জঙ্গলের মাঝে একটি ফাঁকা জায়গায় বানানো হয়েছে এই পর্যটন কেন্দ্র। দোতলা বাড়িটিকে বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে নতুনত্বের ছোঁয়া তার সর্বাঙ্গে। পার্কিং শেডে গাড়ি রেখে ভেতরে ঢুকতেই অভ্যর্থনা পেলাম অল্প বয়সী ম্যানেজারের থেকে। দুটি ঘর আমাদের জন্য বরাদ্দ দোতলায়। নাম তার শাল আর পিয়াল। দুটোই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। প্রায় ৩টে বাজে তখন। স্নান সেরে শরীরটা একটু ঠান্ডা করে চলে এলাম নিচের ডাইনিং স্পেস এ।
লাঞ্চ সেরে শরীরে যেন বল পেলাম বেশ খানিকটা। ছিটেফোঁটা বৃষ্টি পরেই চলেছে থেকে থেকে। কাজ আমাদের এখন একটাই, গুছিয়ে গল্প আড্ডা আর তার সাথে এই শালবনের ঘ্রান নেওয়া মন প্রাণ ভরে। সন্ধ্যের মুখে আকাশ কালো করে বৃষ্টি এলো ঝেঁপে। ঠিক এমনটাই আমরা চেয়েছিলাম। গল্প আড্ডা গানে সন্ধ্যেটা বেশ ভালোই কেটে গেলো।
৮:
রবিবার সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ১১.৩০ টার দিকে। আজ আমাদের ঘুরণচন্ডি মনের ঘুরণ তালিকায় দুটি জায়গা – রায়বানিয়া ফোর্ট এবং কুরুমবেড়া ফোর্ট। রায়বানিয়া উড়িষ্যার বালাসোর জেলার অন্তর্ভুক্ত, লোধাশূলী থেকে গোপীবল্লভপুর হয়ে প্রায় ৭৬ কিমি রাস্তা। নেভিগেটরে দেখাচ্ছে ঘন্টা ২ লাগবে পৌঁছতে। গত রাতে বৃষ্টির পর আজ সকালে ঝলমল করছে রোদ। বর্ষা স্নাত শালের বন যেন স্নান সেরে আনকোরা নতুন কচি কলাপাতা রঙের সবুজ শাড়িটা পরে রোদে বেরিয়েছে তাঁর এলো চুল শুকোতে। দুপাশের শালবনের মাঝখান দিয়ে হাইওয়ে চলে গেছে গোপীবল্লভপুর। এতটাই নয়নমনোহর আর আকর্ষনিয় এই রাস্তা, আমরা মাঝে মধ্যেই গাড়ি থামিয়ে ফটো সেশন করে নিচ্ছি।
গোপীবল্লভপুর ছাড়িয়ে উড়িষ্যায় ঢুকে হাইওয়ে ছেড়ে আমরা এখন সরু পিচের রাস্তায়। দুপাশে শুকনো ক্ষেত আর ছোট ছোট গ্রামগুলো গাড়ির জানালার পাশ দিয়ে হুহু করে ছুটে আমাদের পেছনে চলে যাচ্ছে। “In 200 mtr turn right”- নেভিগেটর ম্যাডামের সতর্কবাণীতে গাড়ির গতি কমালাম। তবে যে রাস্তাটি তিনি ধরতে বলছেন কাছে গিয়ে দেখি ভাঙাচোরা কাঁচা মাটির রাস্তা। থমকে গিয়ে স্থানীয় কোনো মানুষের সাহায্যের অপেক্ষায় থাকলাম। পেয়েও গেলাম এক পথচলতি গ্রামবাসীকে। উড়িয়া ভাষায় তিনি যা বললেন তা আন্দাজে আমরা অনেকটা এরকম বুঝলাম যে এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাবে না। সামনে আরও এগিয়ে পিচের রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে। গাড়ি ঘুরিয়ে আবার এগোতে থাকলাম। একটি পেট্রল পাম্প ছাড়িয়ে কিছুটা এগোতেই ফোর্টের যথার্থ রাস্তাটি আবিষ্কার করে ফেললাম।
সবুজ বনানীর মাঝে অনন্য সুন্দর এই ফোর্ট। এই ফোর্টের উৎস খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে মধ্যযুগীয় কালের ইতিহাসে। একদল ইতিহাসবিদের মতে উড়িষ্যার শেষ হিন্দু রাজা, মুকুন্দদেবের আমলে বানানো হয় এই ফোর্ট। আরেক দলের মতে ১২৭৮-১৩০৬ খ্রী রাজা নরসিংহদেবের সময় প্রতিষ্ঠা হয় এই দূর্গের। কাঠামোতে ব্যবহৃত হয়েছে মাটি, ইঁট এবং পাথর। তবে বেশিরভাগটাই আজ ভগ্নাংশ।
অবশিষ্ট যা আছে ,তা হলো বিশাল চত্বর জুড়ে দুর্গের সীমানা প্রাচীর। তার মাজখানে উঁচু বেদীর ওপর এখনো অটুট জয়চন্ডীর মন্দির। আর একটি বিশালাকার পাথকুয়া। প্রাচীরের বাইরে বাঁ দিকে ২০ হাত দূরেই হালকা একটু চড়াই। ওপর থেকে ভিউ নেবার জন্য এক গ্রামবাসীর সাহায্য নিয়ে বেশ কসরৎ করে ঝোপ ঝার ডিঙ্গিয়ে আমারা ওপরে উঠলাম সেই চড়াই বেয়ে। সার্থক হলো আমাদের ওঠা।
ওপর থেকে সত্যি এক অভিনব দৃশ্য ফোর্টের এবং সবুজে ঘেরা রায়বানিয়া গ্রামের। আমরা যখন ছবি তুলতে ব্যস্ত, হঠাৎ দেখি নিচে ৩-৪ জন গ্রামের লোক চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ে আসছে এদিকে। আমাদের সাথে থাকা গ্রামবাসীর সাথে তাদের কিছু শব্দের আদান প্রদান হলো। উড়িয়া ভাষার অনেক শব্দই বাংলার কাছাকাছি। বুঝতে অসুবিধা হলো যে গ্রামের অন্য এক প্রান্তে ২৫ টি হাতির একটি দল বেরিয়েছে এখুনি আর ওই দল যাতে গ্রামে ঢুকে উৎপাত না করে তার জন্যই এনাদের উৎকণ্ঠা। আমাদেরকেও বলা হলো চড়াই থেকে নেমে আসতে কারণ বিপদের আশঙ্কা আছে। দুপুর গড়িয়ে তখন বেলা প্রায় ৪.৩০। কুরুমবেড়া ফোর্টের গেট বন্ধ হয় ৫:৩০ টায়। এখান থেকে ৩২ কিমি রাস্তা, নেভিগেটর দেখাচ্ছে ১ ঘন্টা লাগবে, অতএব টেনে চালালে হয়তো ঢুকে যাবো। হাতে একেবারে গোনাগুন্তি সময় তাই কাছ থেকে হাতির পাল দেখার লোভটাকে আপাতত সংবরণ করতেই হলো।
৯:
গাড়ি ছোটালাম কুরুমবেড়া ফোর্টের উদ্দেশ্যে। প্রায় ৫.৩০ টা নাগাদ ঢুকলাম গজ্ঞেস্বর গ্রামে। এই গ্রামেই কুরুমবেড়া ফোর্ট। ভাগ্য আজ আমাদের সহায়। কোনো বিশেষ কারণে আজ ফোর্ট বন্ধ হবে ৬টায়। ১৪৩৮-১৪৬৯ খ্রী উড়িষ্যার সূর্যবংশী রাজা গজপতি কপিলেনদ্র দেবের রাজত্বকালে তৈরী হয় কুরুমবেড়া ফোর্ট। এছাড়াও ঔরংজেবের সময়কার মোহাম্মদ তাহির এর হাতে তৈরী কিছু মুঘল স্থাপত্যেরও নিদর্শন পাওয়া যায় দূর্গের ভেতরে। ১৯২০ সাল থেকে ASI যথেষ্ট যত্নের সাথে সংরক্ষণ করে চলেছে এই ফোর্টের। ফোর্টের ভেতর এক বিশাল চত্বর,তাকে ঘিরে আছে অজস্র থাম খচিত দর-দালান।
সবুজ ঘাসের চত্বরটির মাজখানে অবস্থিত তিনটি গোলাকার গমুজ। গম্বুজের সামনে জেগে আছে একটি চৌকো বেদী। সবথেকে আকর্ষণীয় লাগলো দর-দালানের থাম গুলির অবস্থান। একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে থামের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তাকালে মনে হয় এ যেন এক মধ্যযুগীয় ভুলভুলাইয়া। পড়ন্ত বেলার আলো আঁধারিতে কত সহস্র রহস্য…কত ইতিহাসই না ফিসফিস করছে এই থামগুলোর আড়াল থেকে।
অস্তাচলে সূর্য আজকের শেষ উকিঁ মেরে বিদায় নিলো তিনটি গম্বুজের খাঁজে। তার সাথে সাথে আমরাও পরিসমাপ্ত করলাম আমাদের এবারের ঘোরার পর্ব। বাইরে বেরিয়ে চা, ঘুগনি আর ডিম সেদ্ধ খেয়ে রওনা দিলাম কোলকাতার পথে। ফেরার পথে লীনা বার পাঁচেক গেয়ে ফেললো –
“চোখের দেখাই মনের দেখা হয়,
চোখের দেখাই যদি মনে রয়
ভালোবেসে তোমরা তাকে কি বলবে, কি বলবে ?
ও বিজলী চলে যেও না, ও বিজলী চলে যেও না…..”
গানটি বাংলাদেশী ব্যান্ড জেমসের। তবে গত দুদিনে লীনাকে গানটি মুখস্ত করিয়ে দেবার কান্ডটি সম্পন্ন করেছেন সেই ব্যতিক্রমী কৌশিক মহাশয়। প্রথম থেকে শেষ অবধি সাদা মনের ছেলেটা, কালোতেই রয়ে গেলো! চোখের দেখা লোধাশূলী সত্যিই মনের দেখা হয়ে থেকে গেলো আমাদের গভীরে। আর ভালোবেসে তাকে আমরা তাকে কি বলবো? বলবো…অরণ্য সুন্দরী।
© Arijit Kar
Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.