১:
“Continue on the National Highway 19 for 79 km”….ড্যাশবোর্ডে মোবাইল হোল্ডার এ রাখা মোবাইল থেকে আওয়াজ টা ভেসে আসতেই মনে মনে বেশ উৎফুল্ল হলাম। সকাল ৭টায় বেরোলেও, বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে নিবেদিতা সেতু টপকে বালি ছাড়াতে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেছিলো জ্যাম এর জন্য। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে পরে স্পীডোমেটের ৮০-৯০ এ রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে NH 19 এরই একটি অংশ।এখন গুগল মাতার আশ্বাসে সেটাই ১১০-১২০ তে। কোলকাতা থেকে বরন্তি প্রায় ২৫০ কিমি ড্রাইভ। মাঝে শক্তিগড় থেকে ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে আবার রওনা দিলাম। NH 19 বা Delhi Road এর মসৃন ড্রাইভের দরুন বরন্তি, লেক হিল রিসোর্টে পৌঁছে গেলাম প্রায় ১১.৩০ নাগাদ। বুকিং কোলকাতা থেকেই করে রেখেছিলাম ( PK Ghosh – 9432296178 ) Rs.850/- ট্যারিফ হিসেবে। ম্যানেজার বীরবল যে কটেজটি একেবারে লেকের দিকে মুখ করা, সেই কটেজ টিই দিলেন আমাকে। আসার পথেই বুঝেছিলাম, এটিই একমাত্র রিসোর্ট যেটি একবারে লেকের ধারে।
তারওপর বীরবলের দয়ায় এমন একটা ঘর, যার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার সামনে এখন শুধুই মুরাডি লেকের নিশ্চল জল এবং তার পেছনে ছবিতে বহু পরিচিত সেই ত্রিকোণ পাহাড়।প্লাস্টিকের চেয়ার টা টেনে বারান্দায় বসে সেই সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে ডুবে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ।
২:
বর্ষার শেষ দিক হলেও গরম ভালোই। তবে সকালের দিকে বৃষ্টি হওয়াতে, এসি না থাকলেও বিশেষ অসুবিধে হচ্ছে না। রোদ বৃষ্টির কাটাকুটি খেলা শেষ হতে প্রায় ৪টা বেজে গেল। গাড়ি নিয়ে সোজা চলে এলাম মুরাডি বাঁধের ওপর মেঠো রাস্তায়।
মুরাডি লেকটিকে বেড় দিয়ে এই রাস্তা মিশে গেছে মুরাডি পাহাড়ে। মেঘেদের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সূর্য তার সমস্ত রঙের ভান্ডার আর রং তুলি নিয়ে প্রস্তুত।
আজ যেন সে পন করেছে সেই চিরাচরিত প্রতিবিম্ব সমেত ত্রিকোণ পাহাড়ের একঘেয়েমি কাটিয়ে উঠে ক্যানভাসে অন্য রং নিয়ে খেলার। ট্যুরিস্টদের ভিড়ভাট্টা থেকে একটু দূরে গিয়ে মুরাডির পারে বসে গেলাম ট্রাইপড নিয়ে সেই রঙের খেলার সাক্ষী হয়ে থাকতে। নীল ক্যানভাসে বিকেলের সোনালী রং ঢেলে শুরু হলো জলরঙের সেই খেলা।
প্রকৃত শিল্পী যেমন তুলিতে রঙের প্রথম ছোঁয়া টা নিয়ে হারিয়ে যায় তার আপন সৃষ্টিতে, ঠিক তেমনই প্রকৃতি আজ তার সমস্ত রঙের ভান্ডার একের পর এক উজাড় করে দিলো নীল ক্যানভাসে।
হারিয়ে ফেললাম নিজেকে তার এই শৈল্পিক সৃষ্টি খেলায়। কখন যে সে ক্যানভাসে তুলির শেষ টানটা দিয়ে আজকের মত তার বাসায় ফিরে গেল, টেরই পেলাম না। রেখে গেল শুধু তার রেশ এক নীলচে আভায়। কটেজ এ ফিরে আসার কিছুক্ষন পরেই এসে গেল মুড়ি আর তেলেভাজা। এটি এনাদের মাথাপিছু দিনপ্রতি Rs.350/- টাকার খাবার প্যাকেজ এর মধ্যেই পরে। রাতের বরন্তি এখন অন্য রূপে।
দূরের পাহাড়ের পাদদেশে ঝকমক করছে এক আলোর রেখা। সেই আলোর তেজে রেঙে আছে আকাশ। খালি চোখে না হলেও, বাল্ব মোডে ক্যামেরার চোখে ঠিকই ধরা পড়লো সেই আভা।
৩:
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি জানালার ঠিক বাইরেই, ঝলমলে রৌদ্রে এক মুখ হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে একটি হলুদ জবা। আশপাশে সঙ্গ দিচ্ছে তার দু তিনটি গোলাপী বান্ধবী।
জলখাবার খেয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথ প্রদর্শক গুগল মাতা। মুরাডি পাহাড় আজ স্বমহিমায় নিজের প্রতিবিম্ব নিয়ে তার চিরাচরিত রূপে।
মুরাডি ড্যাম এর ওপরের রাস্তাটি অতিক্রম করে ডানদিকের মেঠো রাস্তা ধরলাম। মহুলবন রিসোর্টের উল্টোদিকে পাহাড়ের পাদদেশে তখন কাশের ছোঁয়া।
আদিবাসী গ্রামের মধ্যে দিয়ে আমায় নিয়ে চললো গুগল মাতা। ইতিমধ্যে আকাশ ভারী হয়ে এসে হালকা বৃষ্টি শুরু হলো। কর্দমাক্ত সরু লালমাটির রাস্তার পাশে পানিফলের চাষ। একটি ঘিঞ্জি বাজারের মধ্যে দিয়ে কোনোরকমে গাড়ি গড়িয়ে অবশেষে মুরাডি স্টেশনকে পাশ কাটিয়ে পাকা রাস্তা ধরলাম। দুপাশের বিস্তৃত সবুজ গালিচা আর সামনে সুবিস্তৃত বিরিঞ্চিনাথ পাহাড়ের হাতছানি। হাইওয়ে ধরে কিছুটা এগোতেই বাঁ হাতে বিরিঞ্চিনাথ পাহাড়ে যাওয়ার রাস্তাটা পেয়ে গেলাম। রাস্তাটির মুখেই আছে একটি স্টিল ফ্যাক্টরি।
ভারী ট্রাকগুলো লাল ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলেছে পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ের পাদদেশে গাড়ি রেখে সিঁড়ি বেয়ে মন্দির অব্দি উঠে এলাম। মন্দিরটি বেশ অদ্ভুত, যেন একটি গুহার মধ্যে রাখা শিব লিঙ্গটি। পেছনের দিকে ঝর্নার জল এসে পড়ছে পাহাড় বেয়ে। বিরিঞ্চিনাথ পাহাড়ের ওপর থেকে আশপাশের দৃশ্য বেশ মনোহর।
৪:
বড় রাস্তায় এসে এবার গাড়ি ছোটালাম গড় পঞ্চকোটের উদ্দেশ্যে। কিছুটা হাইওয়ে দিয়ে গিয়ে একটি সরু রাস্তা নিলাম। দুপাশের ঘন সবুজ আর গ্রামের মধ্যে দিয়ে রাস্তাটি বড়ই সুন্দর। সবুজের ওপর সাদায় লেখা ” পিন্দারে পলাশের বন, পালাব পালাব মন” বোর্ডটি জানান দেয় সরকারের নেক নজর এদিকে বেশ ভালোই পড়েছে।
পলাশবনের ফাঁক দিয়ে উকিঁ মারছে এক বিশাল জলাসয়। দূরে দেখা যাচ্ছে নীলচে পাহাড়ের রেখা। আঁকাবাঁকা পথ ধরে আদিবাসী গ্রামের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে গেলাম গড় পঞ্চকোট।
চিরাচরিত ছবিতে খুঁজে পাওয়া পুরোনো মন্দিরটি আজ এখানে নতুনের মোড়কে গড়ে উঠেছে। পাঞ্চেত পাহাড়ের পাদদেশে আজও সাক্ষী হয়ে আছে সেই ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের গড়ের কিছু ভগ্নাংশ। মাটির নিচে গুম হয়ে যাওয়া কিছু স্থাপত্য মুখ তুলে আজও যেন বলতে চায় বর্গীদের আক্রমণের কাহিনী।
ইতিহাস আর প্রকৃতির এক অটুট মেলবন্ধন এই গড় পঞ্চকোট। আকাশে এখন কালো মেঘের ঘনঘটা। আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে পড়লাম কাশিপুর রাজবাড়ির পথে। কাশিপুর রাজবাড়ি যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় ২.১৫। একমাত্র দুর্গাপুজোর দিনগুলো এই রাজবাড়ি জনসাধারণের জন্য খোলা থাকে। বাইরে থেকেই কিছু ছবি নিয়ে রওনা দিলাম জয়চন্ডী পাহাড়ের উদ্দেশ্যে।
৫:
যত এগোচ্ছি জয়চন্ডীর দিকে বৃষ্টির দাপট ততই বাড়ছে। মনে সংশয় আদৌ জয়চণ্ডী ভালো করে দেখতে পাবো কিনা। প্রায় আধঘন্টা ড্রাইভ করার পরে একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল। সামনেই একটি জলাশয়, দূরের জয়চণ্ডী পাহাড়ের প্রতিবিম্ব তার ওপর পড়েছে। বৃষ্টি স্নাত পাহাড় যেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সবুজে ভরিয়ে তুলে সেজে উঠছে।
কিছুটা এগিয়েই বাঁ দিকের একটা রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম একেবারে জয়চণ্ডী পাহাড়ের পাদদেশে। বৃষ্টির দাপটে পাহাড়ের ওপরে আর ওঠা হলো না। নিচ থেকেই ক্যামেরা বন্দী করলাম সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশের উদয়ন পন্ডিতের এই আস্থানটিকে।
মুরাডি লেকের ধারে যখন ফিরলাম, তখন বিকেল ৪.৩০ টা। অবশেষে বৃষ্টি ধরলো। পড়ন্ত বেলায় অস্তগামী সূর্যের সোনালী আলোয় আজ বরোন্তিকে অন্য রূপে পেলাম।
৬:
পরদিন সকালে জলখাবার খেয়ে তৈরী হয়ে একেবারে চেক আউট করে বেরিয়ে পড়লাম। আজ ফেরার পালা। তবে ফিরতি যাত্রা শুরু করবো সেই বিকেলে। তার আগে হাতে অঢেল সময়। ১১.৩০ টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম পাঞ্চেত ড্যাম। দৈর্ঘ্যে বেশ লম্বা এই বাঁধ, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দেখা যায় না। ড্যাম এর লক গেটে আছড়ে পড়ছে দামোদর নদ আর সামনেই পাঞ্চেত পাহাড়। পাঞ্চেত পাহাড়েরই অপর দিকে গড় পঞ্চকোট।
পাহাড়ে ঘেরা পাঞ্চেত ড্যাম এর মাঝ বরাবর একটি রাস্তা নেমে গেছে মুবারক আনসারীর স্নেক পার্কের দিকে। জঙ্গলের লাগোয়া একটুকরো জায়গা নিয়ে বানানো এই স্নেক পার্ক। মুবারক আনসারীর সর্প প্রেম বহুদিনের।
আশপাশের এবং বহু দূরের জেলা গুলো থেকেও ফোন চলে আসে মুবারকের কাছে যখনই কোথাও সাপ দেখা যায়। মুবারক সেটিকে যত্ন করে এনে তাঁর কাছে রাখে। বিষাক্ত এবং বিষ হীন, বিভিন্ন রকম সাপের সাথে মুবারক পরিচয় করালো একেবারে হাতে নিয়ে। এত কাছ থেকে খোলা সাপ দেখার সৌভাগ্য এর আগে আমার হয়নি। এবার রওনা দিলাম বেগুনিয়া মন্দিরের উদ্দেশ্যে। বরাকর নদী পার হওয়ার সময় চোখে পড়লো নদীর ভয়াবহতার সাক্ষ্য, পুরোনো একটি ব্রিজের চাই গুলো আজও ভেঙ্গে পরে আছে বহমান নদীর পাশে। কাশের বনে ছেয়ে আছে নদীর পার।
আসানসোলের একটি ছোটখাটো কয়লা খনি ভিত্তিক শহর এই বরাকর। মূলত কয়লা খনির কর্মচারীদের বাসস্থান। ঘিঞ্জি একটা বাজারের পাশ দিয়ে গিয়ে একটি বড় মাঠ। আর তাতেই বেগুনিয়া মন্দিরের চারটে স্থাপত্য। হঠাৎ দেখলে মনে হয় ওড়িশার কোনো মন্দিরময় গ্রামে এসে উপস্থিত হয়েছি। নিখুঁত তার ভাস্কর্য। গণেশ, কালী, দূর্গা আর সিদ্ধেশ্বরীর অবস্থান এই চারটি মন্দিরে।
৭:
মিনিট কুড়ি ড্রাইভ করে ২.৩০ নাগাদ পৌঁছে গেলাম কল্যানেশ্বরী মন্দির। ৫০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস এই মন্দিরে। কথিত আছে বহু আগে এখানে নরবলি পর্যন্ত হতো। শক্তি রূপে আরাধ্যা দেবী কল্যানেশ্বরী খুবই জাগ্রত হিসেবে খ্যাত।
মন্দিরটি বরাকর নদীর কোনো এক শাখার পারেই অবস্থিত। তবে সামনে থেকে বোঝা মুশকিল। মন্দিরের আশপাশটা একটু ঘুরে দেখতে দেখতে পেছনের দিকে গিয়ে দেখা পেলাম বরাকর নদীর সেই শাখার। অসামান্য রূপ তার। তেমন তার গর্জন। যেন এক আগ্রাসী পাহাড়ী নদী আমার সামনে।
বোঝার উপায় নেই আমি এখন সমতলে দাঁড়িয়ে। বরাকর এর শাখা এখানে পাথুরে জঙ্গল এর বুক চিরে বেরিয়ে আসা এক দামাল নদী। মুগ্ধ হলাম এই রূপে।
৮:
কল্যানেশ্বরী মন্দির থেকে বেরিয়েই সামনে কিছু ছোট ছোট ভাতের হোটেল। লাঞ্চটা এখানেই সেরে রওনা দিলাম মাইথন ড্যামের দিকে। ঝাড়খণ্ডে প্রতিটি ড্যাম এর যেন এক আলাদা নিজস্ব রূপ। কোনোটার সাথে কোনোটার মিল নেই। বেলা গড়িয়ে এখন ৩.৩০ টা। মেঘলা আকাশ। পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খণ্ড দুটি রাজ্য থেকেই প্রচুর ট্যুরিস্ট এর জনসমাগম মাইথন লেকের ধারে। ডাল লেকের শিকারার মতো রং বেরঙের নৌকো গুলো ট্যুরিস্ট নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে লেকের জলে। চারপাশের পাহাড় শ্রেণীর মাঝে বড় মনোরম পরিবেশ মাইথন লেকের।
একটু দূরে চোখে পরে Spoon Island, উল্টানো চামচাকৃতির একটি ছোট্ট দ্বীপ। দিব্যি সময় কেটে গেল সুবিশাল এই হ্রদের জলে রঙীন নৌকাগুলোর আনাগোনা দেখতে দেখতে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই রওনা দিলাম কোলকাতার পথে। পুরুলিয়ার দোরগোড়ায় প্রথম ছোঁয়া মনটা উথাল পাথাল করে দিলো। হাইওয়ে তে পরে এটাই মনে হলো, এই আসা শেষ আসা নয়…এতো সবে শুরু।
Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.