১:
তখন প্রায় সকাল দশটা। রিক্সাওয়ালার সাথে দেশের ও দশের গল্প করতে করতে এগোতে থাকলাম। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ হলেও, এদিকটায় শীতের কামড় তখনও সেভাবে দাঁত বসায়নি। গন্তব্য WBTDC র ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি ট্যুরিজম প্রজেক্ট। কিছুটা এগিয়ে দেখলাম বাঁ দিকের ফালি রাস্তা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা নির্জন মন্দির। বেশ ফাঁকা আশপাশ। রিকশা ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করায় বললো ওটাই মহা শ্মশান ওখানকার। রিকশা বাঁ দিকে ঘুরিয়ে গেলাম মন্দিরে। লাগোয়া শ্মশান। মন্দিরের সামনেই এক বিশাল হারিকাঠ। কালী মন্দির। প্রত্যেক অমাবস্যায় নাকি এখানে পাঁঠা বলি হয় এখনো। সকালের ইস্পাত এক্সপ্রেস টা ৯.৩০ টার মধ্যেই ঝাড়গ্রাম ঢুকিয়ে দেয়। চেক ইন এর আগে হাতে প্রচুর সময়। তাই ইচ্ছে করেই বেশি ভাড়া দিয়ে রিকশা নেওয়া। স্টেশন থেকেই চোখে পড়ছিল হোর্ডিং জঙ্গল মহল উৎসবের। সাজো সাজো রব বেশ চারিদিকে। জানুয়ারী প্রথম সপ্তাহেই এই উৎসব হয় এখানে। এখন তারই অন্তিম প্রস্তুতি পরবো। আদিবাসীদের এক মহোৎসব বলতে পারেন। শুধু ঝাড়গ্রাম নয়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা..এমনকি পার্শবর্তি রাজ্য থেকেও মানুষ আসেন যোগ দিতে এই উৎসবে।
২:
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি ট্যুরিজম প্রজেক্ট যাবো শুনে রিকশাওয়ালা সোজা ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির গেট দিয়ে ঢোকালো। আমারও ধারণা ছিল এইটা ওই রাজবাড়ির চত্বরেই নিশ্চই, নাহলে অমন নামকরণ কেন হবে? কলকাতা থেকেই বেশ রোমাঞ্চিত হয়ে গেছিলাম যে এইবার খোদ রাজবাড়ির চত্বরে থাকতে পাবার সুযোগ। ভুল ভাঙলো গেট দিয়ে ঢুকেই। বুঝলাম রাজবাড়ি ট্যুরিজম প্রজেক্ট আর রাজবাড়ি এক নয়। গেটের বাইরে রাস্তার উল্টোদিকে বেশ কয়েক একর ছড়ানো একটি রিসোর্ট। সেটাই ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি ট্যুরিজম প্রজেক্ট। একদম সদ্য বানানো। তখন রীতিমতন কাজ চলছে। ভেতরে ঢুকে রিসেপশন এ আমার বুকিং স্লিপ দেখাতেই হাসিমুখে আমার কটেজ টি দেখিয়ে দিলো। এন্ট্রি করার সময় বুঝলাম, চালু হবার পরে আমি পঞ্চম গেস্ট। ঘরটায় ঢুকে মন ভরে গেল। যেন সদ্য কেনা এক নতুন ফ্ল্যাটে ঢুকছি। অনেক কিছুই আনকোরা নতুন…আমিই যেন প্রথম ঢুকলাম এই ঘরটায়। একদম নতুন বলে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা তখনও চালু হয়নি। তবে সামনেই খুব ভালো একটি রেস্টুরেন্টের সন্ধান ওরাই দিয়ে দিলো। ঠিক করলাম ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িটা একদম শেষ পাতে রাখবো, তাই সেদিন আর ছুঁলাম না। খাবার হোটেল টি এই রিসোর্টের পেছন দিকের গেট দিয়ে বেরিয়ে খুব কাছে। মধ্যাহ্নভোজ সেরে ফেরার সময় আমি পেছনদিকের গেট দিয়ে না ঢুকে রিসোর্ট বরাবর রাস্তা দিয়ে সামনের গেটের দিকে এগোলাম। তখনই আবিষ্কার করলাম কেন “রাজবাড়ি” শব্দটি এনারা রিসোর্টের নামের মধ্যে ঢুকিয়েছেন। আসলে পুরো জায়গাটাই রাজবাড়ির চত্বর। কিছু ধ্বংসাবশেষ এখনো চোখে পরে এই পেছনদিকের রাস্তাটি দিয়ে হাঁটলে।
৩:
দুপুরে একটা অটো ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম ক্যামেরা নিয়ে। শীতের দুপুরটা রিসোর্টে বসে নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। প্রথমেই গেলাম WBFDC র প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র তে। Interpretation Center টা বন্ধ থাকলেও, compound টা ঘুরে দেখলাম। আদিবাসী চলচিত্র চোখে পড়ে চারিদিকে। মাটির পুতুল আর আদিবাসী কুঁড়ে ঘর সাজানো রয়েছে।
এরপর গেলাম আমলাচটি ভেষজ উদ্যান। গুচ্ছের খানেক medicinal plants এ ভরা এই বাগান।
কনকদূর্গা মন্দিরের বেশ হাঁকডাক আছে। প্রায় ৩.৩০ নাগাদ এসে পৌঁছলাম এই কনকদূর্গা মন্দিরে। মাদলের আওয়াজ আর তার তালে তালে আদিবাসী সুর আমায় টেনে নিয়ে গেল মন্দিরের লাগোয়া এক ফাঁকা জমিতে। সাঁওতাল গান, সাঁওতাল নৃত্য এবং মাদলের গম্ভীর দামামা। এই তিনে মিলে আমার পা আটকে দিল। এতক্ষনে যেন লেন্স টা সার্থকতা পেলো। বিভোর হয়ে ওই আদিবাসী সুরে মন টাকে মিলিয়ে দিলাম। কনকদুর্গার নতুন মন্দিরের পেছন দিকটায় আদি মন্দির আজও বর্তমান। আদি মন্দিরের কপাট বন্ধ আর তাতে মস্ত বড় এক তালা। তা সত্ত্বেও রাজকীয়তা আজও যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে সেই বন্ধ কপাট থেকে। দরজা টার দিকে তাকিয়ে মনে হলো যেন অনেক জমে থাকা ইতিহাস রুদ্ধ হয়ে আছে ওই দুয়ারের ওপারে!
অটো ওয়ালা এসে মনে করিয়ে দিলো যে শীতের বেলা। চট করে সন্ধ্যে নামবে, এখনো একটা জায়গা যাওয়া বাকি। কনকদূর্গা মন্দিরটি ডুলুং নদীর পারে।
এই ডুলুং নদীর ব্রিজ পার করেই ১.৫ কিমি রাস্তা এগিয়ে এসে পৌঁছলাম চিলকিগড় রাজবাড়ি। বিকেল তখন প্রায় ৪ টা। শীতের বিকেল। সূর্য তখন দিনের শেষ আলো নিয়ে অস্ত যাওয়ার পথে। রাজবাড়িতে ঢোকা যায়না।তবে রাজবাড়ি চত্বর টা অনেকটা বিস্তৃত। বেশ কিছু ছড়ানো ছেটানো মন্দির সেই চত্বরে।
রিসোর্ট ফেরার পথে উপরি পাওনা হলো অটো ওয়ালার দৌলতে। এক সাঁওতাল গ্রামের ভেতর দিয়ে আমরা এগোতে থাকলাম। শীতের বিকেলের ওই হালকা মিঠে আলোর সাথে খুব মানানসই গ্রামের মাটির বাড়ি গুলো। মাটির কুঁড়ে ঘরের সামনেই নিকোনো উঠোন। গুটিকয়েক মুরগী খুটে খুটে কি যেন খেয়েই চলেছে সেই উঠানে। কোথাও বা সাঁওতাল মহিলারা একে অপরের পেছনে বসে চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। কোথাও বা মহিলারা বসে সারাদিনের ক্লান্তির পর এক অলস বিকেল উপভোগ করছেন। কত কম চাওয়া পাওয়া এনাদের। কত শান্তি এনাদের চোখে মুখে।
মনে পরে গেল আমার ৪-৫ বছর বয়সের কথা। আমাদের কৈখালীর ভাড়া বাড়ির উঠোনের কথা। উঠোনে বসে আমার তাকিয়ে থাকা বড়দের ক্রিকেট খেলার দিকে…পাশে বসে মায়ের উল বোনা…আর ঠাকুমার ঘন্টা খানেক ধরে বিকেলের চুল পরিপাটি করে আচড়ানো….থাক সে কথা। রিসোর্টে ঢোকার আগেই রাজবাড়ির গেটের সামনে দেখি সেই আদিবাসী নৃত্য দল। ততক্ষনে অন্ধকার হয়ে গেছে। জঙ্গলমহল উৎসবের প্রমোতে ব্যস্ত তখনও তারা। রিসোর্টের বেশ কিছু গেস্ট রাও ওনাদের নাচের তালে তাল মেলালেন। ছবি তোলার ফাঁকেই আমি একটু এগিয়ে গিয়ে আমি পরের দিনের ট্রিপের জন্য একটি গাড়ি ঠিক করে নিলাম। আদিবাসী সুর জঙ্গলমহলের বেলপাহাড়ি… কাঁকড়াঝোড়…এসবের স্বপ্নে আমায় হারিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো সেদিনের মতো।
৪:
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি থেকে বেলপাহাড়ি প্রায় ৪৬ কিমি। সেখান থেকে কাঁকড়াঝোড় আরো ৪১ কিমি। লম্বা পথ। আর তার ওপর জঙ্গলমহল। কয়েক বছর আগেও এই জায়গা গুলোকে মাওবাদী অধ্যুষিত বলা হতো। এমনকি কলকাতা থেকে যাওয়ার আগে অনেকেই আমায় ভয় দেখিয়েছিল। তবে ঝাড়গ্রাম পৌঁছে লোকজনের সাথে কথা বলে বুঝেছিলাম যে এখন আর কোনো ভয় পাওয়ার কারণ নেই। তবে আগের দিন গাড়ি ঠিক করার সময়তেই ড্রাইভার বলে দিয়েছিল সে সন্ধ্যের মধ্যেই ফিরে আসতে চায়। তাই আজ বেশ সকাল সকালই বেরিয়ে পড়লাম। বাহন মারুতি অম্নি।
৫:
প্রায় দেড় ঘন্টা লেগে গেল বেলপাহাড়ি ঢুকতে। হাই ওয়ে ছেড়ে গ্রামের মেঠো পথ ধরে গাড়ি এগিয়ে চললো। সমান্তরাল রাস্তা ছেড়ে এবার গাড়ি কিছুটা নেমে এলো। সবুজের গালিচা বিছানো যেন এক pleatue. সামনেই ঘাঘড়া নদী এবং পাথরের ওপর দিয়ে তার বয়ে চলাতে সৃষ্টি হয়েছে ঘাঘড়া জলপ্রপাত। চোখ জুড়িয়ে গেল। পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে অনেকটা দূর চলে গেলাম। পায়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ঘাঘড়া। টলটলে পরিষ্কারর জল। আকাশের নীলে যেন নীল হয়ে আছে সেই জল। একেকটা পাথর যেন একেকটি ভাস্কর্য এখানে। নিপুন হাতে কোনো এক কারিগর যেন ঢেউ খেলিয়ে রেখেছে পাথর গুলো দিয়ে।
ঘাঘড়া থেকে ৩.৩ কিমি দূরত্বে তারাফেনি নদী এবং তারাফেনি বাঁধ। লাল মাটির রাস্তা গ্রামের ভেতর দিয়ে। তারাফেনি বাঁধের ওপর থেকে চোখে পড়লো নদীতে মাছ ধরার এক অভিনব পদ্ধতি। গাড়ির টায়ারের টিউব টাকেই ভেলা বানিয়ে নিয়েছে। তার ওপরেই ভেসে ভেসে মাছ ধরা জাল দিয়ে।
এরপর গাড়ি ছুটে চললো কাঁকড়াঝোড়ের উদ্দেশ্যে। ৩৭ কিমি পথ তারাফেনি থেকে। শাল পিয়ালের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। মাঝে কয়েকটা সাঁওতাল গ্রাম। তারই একটা গ্রামে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার সাহেব আর আমি চা খেলাম। সাঁওতাল দোকানের সাঁওতাল চুল্লির চা খেয়ে আবার পথ চলা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম কাঁকড়াঝোড়। রাস্তার দুধারে জঙ্গল, খুব যে ঘন তা নয়। তবে গভীরে তাকালে…কোথায় যেন হারিয়ে যায় দৃষ্টি, হারিয়ে যায় মন। এখান থেকে খুব কাছে ঘাটশিলা। আশপাশের সাঁওতাল বাড়ি ঘর, মানুষ জন আর তাদের জীবন যাপন চাক্ষুস দেখলাম।
ওঁদের থেকেই জানলাম ফেরার পথে Ketki Spring বলে একটি জলাশয় পাবো। কেতকী হয়ে ফেরার পথে কিছুটা এগোতেই বাঁ হাতে পরে একটি সুবিশাল মাঠ। ড্রাইভারের মুখে শুনলাম এই সেই মাঠ যেখানে কিষান জি কে হত্যা করা হয়েছিল। মাওবাদী দের অনেক কীর্তিকলাপ আমার ড্রাইভারের চাক্ষুস দেখা। সেগুলোর গল্প শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম গুড়রাসিনি পাহাড়। এদিকে ড্রাইভার সাহেবও তাড়াহুড়ো করতে শুরু করে দিয়েছে কারণ বেলা তখন ৩টা । উনি অন্ধকার নামার আগে যেভাবেই হোক বেলপাহাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছেন বুঝলাম। যাইহোক, চটপট করে উঠো পড়লাম গুড়রাসিনির মাথায়। ওপরের শিব মন্দির থেকে নিচের দৃশ্য বেশ মনোরম। পাহাড়ের পাদদেশে সত্যানন্দ মহারাজের আশ্রম। বেশ শান্ত পরিবেশ…যেমন মন্দিরে তেমনি আশ্রমে।
পাহাড় থেকে নেমে এগোলাম খন্দরানী লেক এর উদ্দেশ্যে। প্রায় ৪টা নাগাদ এসে পৌঁছলাম খন্দরানী। সুবিশাল এই লেক। লেক টাকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে আছে ছোট ছোট টিলা। পড়ন্ত আলোয় এক মোহময়ী পরিবেশ সেই লেক এ। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করলাম চাঁদের আলোয় খন্দরানী কে একবার দেখা যাবে কি না। তার উত্তরে বেশ ধমকের সুরেই উনি বললেন, শুধু উনি কেন? রাত্রে কোনো ড্রাইভারই গাড়ি নিয়ে এসে এখানে দাঁড়াবে না চুরি ছিনতাই এর ভয়ে। অগত্যা খন্দরানীকে বিদায় জানিয়ে চলে এলাম রিসোর্টে।
৬:
পরেরদিন সকালে জলখাবার খেয়েই গুটি গুটি পায়ে চললাম সাবিত্রী মন্দির। রিসোর্টের পেছনের গেট দিয়ে বেরোলে, খুব কাছেই। মূর্তিটি এখানে যেন ছিন্নমস্তা রূপে ।
ফেরার পথে ঢুকে পড়লাম ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে। অনেকটা জায়গা জুড়ে এই রাজবাড়ি। আজও এই রাজবাড়ি বাসযোগ্য। এবং কয়েক ঘর লোক বাসও করেন এই রাজবাড়িতে। সুন্দর ভাবে সাজানো রাজবাড়ির বাগান। ভেতরেই আছে কুল মন্দির। তাতে আজও পুজো হয়। তবে রাজবাড়ির মূল বিল্ডিং টায় ঢোকা নিষিদ্ধ। ভেতরে একটি কৃত্তিম ঝর্ণাও আছে। রাজকীয়তার নিদর্শন আজও বর্তমান এখানে। রিসোর্টে ফিরে গুছিয়ে নিয়ে এবার ফেরার পালা। হাতে তখনও অনেক সময় আমার ট্রেন আসার আগে তাই একটি টোটো নিয়ে চলে এলাম ঝাড়গ্রাম মিনি জু তে। স্টেশনের কাছেই এই জু। জঙ্গলমহলের জংলী নেশা নিয়ে ফেরার ট্রেনে চেপে বসলাম।
Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.