Skip to content
Home » রহস্যময় গড় জঙ্গল আর দেউল

রহস্যময় গড় জঙ্গল আর দেউল

Share this in your social media

 

১:

ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি বর্ধমানের এক ভর দুপুরবেলা মানে প্যাচপ্যাচে গরম না হলেও, রোদের তাপ যথেষ্ট প্রখর। তার ওপর নিজে একা হাতে কোলকাতা থেকে ১৬৫ কিমি ড্রাইভ করে আসা। তাই ঠিকই করে রেখেছিলাম একটু রোদ পড়লেই বেরুবো। সেইমতো বিকেল ৪.৩০ টা নাগাদ Wagon R টা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গী আমার ক্যামেরা। দেউল পার্কের পেছনের গেট টা দিয়ে বেরোলেই গড় জঙ্গলের রাস্তা।

_DSC9580

_DSC9537.jpg

২:

লাল মোরামের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম গাড়ি নিয়ে। দুপাশে শালের ঘন জঙ্গল। পথে দেখলাম এক মহিলা মাথায় শাল পাতার বোঝা নিয়ে হাঁটছেন। কিছু দূর গিয়েই দেখলাম ডানদিকে দিক নির্দেশ দেওয়া আছে মন্দিরের। কিছুদূর এগিয়ে একটা T shape cut আছে। এইটা থেকে বাঁ দিকে মন্দিরের পথ। প্রথমে পড়লো শ্যামরূপ এর মন্দির। বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে।বেশ শান্ত পরিবেশ চারিদিক। গাছের নিবিড় ঘন ছায়া চারিদিকে। পড়ন্ত বিকেলে মোহময় পরিবেশ। বিগ্রহ দর্শন করে আশপাশের পরিবেশ টা একটু আপনমনে মন্থন করলাম। একটা বহু পুরোনো শুকিয়ে যাওয়া পাথকুয়া আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। এইখানেই একসময় ছিল রাজা ইছাই ঘোষের গড়। তাই নাম গড় জঙ্গল। আজ অবশ্য কয়েকটা মাটির ঢিবি ছাড়া সেই গড়ের আর কোনো অস্তিত্ব নেই। ইছাই ঘোষের আরাধ্য দেবী ছিল এই শ্যামরূপা । চন্ডী রূপে পূজা হয় এই দেবীর। কথিত আছে ১৬শ/ ১৭শ শতকের এই মন্দির। এরপর আবার গাড়ি নিয়ে এগোলাম জঙ্গলের পথে। আরো ৭-৮ মিনিট ড্রাইভ করার পর পৌঁছে গেলাম গড় জঙ্গলের বহু পুরোনো শিব মন্দিরে। গড় জঙ্গলের মূল আকর্ষণ আমার কাছে জঙ্গলের রাস্তা টা। ধূসর লাল মোরামের রাস্তা। দুপাশে তখন শুকনো শাল-অর্জুন-শিরিষ এর গা ছমছমে জঙ্গল। আলো ততক্ষনে অনেক কমে এসেছে। কোনো পাবলিক যানবাহন এই রাস্তায় আসে না। নিজের গাড়ি ছাড়া আর কোনো ভরসা নেই। বিদ্যুতের প্রবেশ এখনো হয়নি জঙ্গলে। অতএব অন্ধকার নামলে আমার গাড়ির হেডলাইট ই একমাত্র অবলম্বন পথ চিনে চলার। যাইহোক। ঠিক করলাম শিব মন্দিরে বেশিক্ষন সময় নেব না। কারণ তখন already আলো অতি ক্ষীণ হয়ে এসেছে।

৩:

ভাবলে হবে কি। ভাবি এক। হয় আরেক। শিব মন্দির চত্বরে ঢুকে অনুভব করলাম এইটা সাধারণ কোনো শিব মন্দির নয়। জায়গাটির পরতে পরতে যেন রহস্যের গন্ধ। ইতি উতি ঘুরে বেড়াচ্ছে সাধুরা। পরনে তাদের লাল টকটকে বসন। কপালের লাল সিঁদুরের লম্বা টিকা চকচক করছে ওই আধো অন্ধকারেও। প্রত্যেকেরই চোখগুলো যেন মনে হল দ্যুতিময়। দূর্গা পূজা এখানে রোজ হয়। সন্ধ্যা আরতি রোজ হয়। তারই আয়োজনে ব্যস্ত সব সাধুরা। দেবী দুর্গার দর্শন আমিও পেলাম। একজন বয়স্ক সাধুকে জিজ্ঞেস করে জানলাম আর ঘন্টাখানেক এর মধ্যেই সন্ধ্যা আরতি শুরু হবে। দূর্গা পুজোর সময় নাকি এই জায়গায় জনসমাগম এত বেড়ে যায়, জঙ্গলে গাড়ির যানজট ছাড়ানো মুশকিল হয়ে যায়। দূর দূরান্ত থেকে লোক আসে তখন। দূর্গা মন্দিরের সামনেই যজ্ঞের সাজ সরঞ্জাম। সেই আয়োজন এতটাই বড়, দেখে মনে হবে আসতো একটি মানুষকেও ওই যজ্ঞের কাঠামো তে আরাম করে আহুতি দিয়ে দেওয়া যাবে। সবই কেমন যেন রহস্যময়। আলো আরো ক্ষীণ হচ্ছে। আমি চট করে আশপাশের জায়গাগুলো দেখে নিলাম। পুরোনো শিব মন্দির ভেঙে নতুন ভাবে তৈরী হচ্ছে। সেই অর্ধেক হওয়া শিব মন্দিরের ফাঁক দিয়ে সূর্যের অস্ত যাওয়া টা দেখতে এবং লেন্সে ধরে রাখতে বেশ লাগলো। একটু এগিয়েই দেখলাম সাধুদের থাকার জায়গা। একটু এগিয়ে উঁকি দিতেই হলো বিপত্তি।

৪:

একটি ঘরে দেখি খাটের ওপর এক রক্তিম বসনা সাধু বসে। বয়স মনে হয়না চল্লিশ উর্ধ। তার পাশেই গেরুয়া বসন পরিহিতা এক নারী। সম্ভবত সাধুর পা টিপে দিচ্ছিল। আরেকজন নারী…ইনি বয়স্কা, খাটের পাশে মাটিতে বসে কেমন যেন ঝিমিয়ে আছেন। এই দেখা কয়েক ঝলকের। সেই সাধুর হুঙ্কারে সম্বিৎ ফিরে পেলাম…” বাইরে বাইরে। এখানে নয়।” ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডার এ চোখ রাখার সাহস বা প্রবৃত্তি কোনোটাই হলো না আর। সেই ঘরের উঠোন থেকে ছুটেই বেরিয়ে এলাম একরকম। ঢোকা অব্দি যে রহস্যময় আবহাওয়া অনুভব করেছিলাম তা এখন তুঙ্গে। বেরিয়ে আশপাশের কিছু ছবি তুলছি। হঠাৎ দেখি সেই ঘরের বয়স্কা মহিলা বেরিয়ে মন্দিরের দিকে হাঁটছে। ওনার পেছন পেছন কিছুটা গিয়ে ডাকলাম ওনাকে। পেছন ফিরে বললেন “কি চাই তোর? থাকিস না এখানে বেশিক্ষন। চলে যা। আঁধার হচ্ছে। ভালো নয় এ জায়গা। দূর্গা পূজার সময় আসিস, ভালো লাগবে।” ততক্ষনে আমার মনে ভয় নামক বস্তুটি দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ওনাকে শুধু জিজ্ঞেস করলাম..”আপনি এইখানে কতদিন আছেন?” বললেন ” আমি গুয়াহাটি তে থাকি। কেউ নেই আমার। এরা আমাকে নিয়ে এসেছে এক বছর হতে চললো। তুই আর থাকিস না এখানে, চলে যা।” এইবারে খেয়াল করলাম মহিলার মুখটা, দেখেই বোঝা যায় north-east এর ছাপ। ওনার শেষ কথা ” আমার পেছন পেছন আসিস না আর”। বলে উনি হাঁটা লাগলেন মন্দিরের দিকে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষন ওখানেই দাঁড়িয়ে গত আধ ঘন্টার ঘটনাপ্রবাহ হজম করার চেষ্টা করলাম। সন্ধ্যা আরতির কথা প্রথমে শোনাতে মনে বেশ ইচ্ছে জেগেছিল সেটা দেখে তবে যাবো। এই মুহূর্তে সেই ইচ্ছে কিন্তু একেবারেই ফিকে হয়ে এসেছে! দূর্গা মন্দিরের কাছে যেতেই দেখি প্রথম যে বয়স্ক সাধুর সাথে কথা হয়েছিল, তিনি বলে উঠলেন “বাবা আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুটঘুটি ও অন্ধকার হয়ে যাবে। সন্ধ্যার পর এই জঙ্গলের রাস্তা ভালো নয়। তুই তো টুরিস্ট। চোর ডাকাতের উপদ্রব আজও আছে এই জঙ্গলে। গ্রামের লোকেদের ওরা কিছু করার সাহস পায়না ঠিকই। কিন্তু বাইরের লোকেদের ওরা ছাড়ে না। তুই আর সময় নষ্ট করিস না এখানে।” বাইরের অন্ধকারের সাথে ভয়ের অন্ধকার ততক্ষনে আমাকে পুরো পেয়ে বসেছে। সোজা গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলাম।

 

৫:

1st gear এ গাড়ি টা ওখান থেকে বের করে যখন 2nd gear এ নিলাম , বেশ স্বস্তি লাগছিলো। তখনো বুঝিনি যে আমার এই স্বস্তি ক্ষণস্থায়ী হবে। আরো অনেক রহস্য অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য। ততক্ষনে পুরো অন্ধকার। আসার সময় ঘড়ি দেখে রেখেছিলাম যে দেউল পার্কের পেছনের গেট থেকে এই মন্দির ২০ মিনিট maximum। আমার গাড়ির হেডলাইট ছাড়া রাস্তায় আর কোনো আলোর সংস্থান নেই। দুপাশের গাছ আর অন্ধকার যেন দৈত্যের মতন গ্রাস করতে আসছে আমাকে। গাড়ি 30 থেকে 40 এর মধ্যেই রাখতে হচ্ছে। রাস্তা বেশ খারাপ আর অসমান। ঘন অন্ধকারে স্পিড আরো স্লো। বেশ কিছুক্ষন গাড়ি চালানোর পর আমার খেয়াল হলো যে ২০ মিনিট অনেক আগেই অতিক্রম করে গেছি। প্রায় আধ ঘন্টা হলো আমি ড্রাইভ করছি। নিজেকে আস্বস্ত করার চেষ্টা করলাম যে আসার সময় দিনের আলো ছিল তাই স্পীডে আসতে পেরেছিলাম। এখন রাত বলেই সময় বেশি লাগছে। কিন্তু এই আশ্বাস যে বৃথা সেটা বুঝলাম এইটা মনে পড়ায় যে সেই দিক নির্দেশের বোর্ড টা কিন্তু ফেরার সময় এখনো চোখেই পড়েনি। অথচ সেই বোর্ড টা থেকে মন্দির just ৫ মিনিটের রাস্তা!! তবে!!! এ কোথায় চলে এলাম আমি। কোথাও আলো বা জনমানবের লেশ মাত্র নেই!

_DSC9469.jpg

৬:

বুঝলাম জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়েছি। একটু এগিয়ে দেখলাম বাঁ দিকে সরু মোরামের একটা রাস্তা। এত সরু রাস্তা দিয়ে আমি আসিনি। গাড়ি ঘোরালাম। কিন্তু কোথাও আর সেই দিক নির্দেশের বোর্ড খুঁজে পেলাম না। গাড়ির এসির মধ্যেও রীতিমতো ঘামছি। হঠাৎ দেখি গাড়ির সামনে ফুট ১০এক দূরে দুটো চোখ জ্বল জ্বল করছে কোনো একটা কিছুর। সেটা রাস্তাটা কেটে অন্য দিকে যাওয়ার সময় হেডলইটের আলোয় বুঝলাম ওটা শিয়াল। এইবার একটু স্পীডেই চালালাম খারাপ রাস্তা উপেক্ষা করেই। বেশ কিছুটা টানা এগিয়ে দেখলাম আবার বাঁ দিকে একটা রাস্তা ঢুকেছে। ঢুকলাম। দেখি পাশেই একটা Indian Oil লেখা reservoir এর মতন। একটা ছোট্ট অফিস ঘর তার পাশে। গাড়ি দেখে দুজন লোক এগিয়ে এলো। আমার অবস্থাটা তাদের বোঝাতে বললো নেমে আসুন, অফিসে বসে একটা কাগজে এঁকে দিচ্ছি রিসোর্ট এর direction টা। আমি একটা জিনিস অনেক আগেই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম। যাই ঘটুক, আমি গাড়ি থেকে নামবো না। এক্ষেত্রে তাই আর নামলাম না। শেষমেশ একজন বললো যে উনি সাইকেল নিয়ে কিছু দূর যাবেন…সেই জায়গা থেকে রিসোর্টের রাস্তা টা সোজা পথ, কোনো টার্নিং নেই। উনি এগোলেন। আমি গাড়ি নিয়ে পেছন পেছন। উনি দেবদূতের মতো আমার সামনে। সেই মোর টায় এসে বুঝলাম এটাই এই T cut। শরীর ও মন টা যেন প্রাণ ফিরে পেলো! ওনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে এগোতে থাকলাম। কিছুদূর যেতেই যা চোখে পড়লো, তা আজও আমার গায় কাঁটা দেয়। হেডলইটের আলোয় দেখলাম স্পষ্ট এক মহিলা রাস্তার ধারে বসে। মুখ টা ঘোমটা দিয়ে ঢাকা। আজও তার ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাই না…কেন ওই নিকশ কালো অন্ধকারে কোনও মহিলা রাস্তার ধারে মুখ ঢেকে বসে থাকবে!! এক নিঃশ্বাসে সোজা রিসোর্টের গেট অব্দি এসে তবে গাড়ি থামালাম।

৭:

সেই রাত্রে ঘুম এলো দেরিতে। বিকেলের ওই টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতাগুলোকে ব্যাখ্যা দিয়ে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করলাম । কিছু পারলাম। কিছু পারলাম না। যাই হোক, সকালে উঠে চললাম জয়দেবের মন্দিরের উদ্দেশ্যে। অজয় নদীর ওপর দিয়ে লাল মাটির রাস্তাটা ধুলো উঠিয়ে ওপারে যাওয়ার সময় মনে পড়ছিল ছোটবেলা টিভিতে দেখা মহাভারতে সুগ্রীবের পাথর দিয়ে দিয়ে ব্রিজ বানিয়ে সাগরপাড়ের কথা। ওপার টা বীরভূম। অজয় বেশ চওড়া। বর্ষায় এইভাবে যাওয়া যায় না। জয়দেব ছিলেন রাজা ইছাই ঘোষের সভা কবি। পরে তিনি বৈষ্ণব হয়ে বাউলদের সূত্রপাত করেছিলেন এই কেন্দুলি তে। কেন্দুলির বাউলের মেলা দেখতে আজ প্রচুর টুরিস্ট যান। মন্দির দর্শন করে অজয় ডিঙিয়ে আবার বর্ধমান ঢুকে পড়লাম। এবার ফেরার পালা। লাঞ্চ সেরে বিদায় জানালাম রিসোর্ট কে। ফেরার পথে থামলাম ইছাই ঘোষের দেউল এর সামনে। ঐতিহাসিক এই দেউল শিখর বেশ চোখ টানে। মনে অনেক প্রশ্নের না পাওয়া উত্তর নিয়ে ফেরার পথে গাড়ি গড়ালাম। একটু পর লাল মাটির রাস্তাকে বিদায় জানিয়ে পিচ রাস্তা ধরে পেয়ে গেলাম দার্জিলিঙ মোর। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে পানাগড় ছাড়িয়ে শক্তিগড়ে এসে লাংচা নিয়ে ঘরে ফেরা।

0 0 votes
Article Rating

I am eager to know your views on this post. Please leave a reply

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
error: Content is protected !!
%d bloggers like this: