Parmadan Forest
পরমানন্দের পারমাদন
১:
ভোর ৬.১৫ তে যখন বনগাঁ স্টেশনে নামলাম, তখনও আমার দাঁতে দাঁতকপাটি বন্ধ হয়নি। ২৪ এ নভেম্বর, ২০১৫। কলকাতার শীত যতই ক্ষীণ হোক না কেন, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের ভোরের শীতের কামড় যে এতটা তীক্ষ্ণ হবে সেটা আগে বুঝিনি। উল্টোডাঙ্গা থেকে ভোর ৪.২২ এর বনগাঁ লোকাল সেদিন ছিল বেশ ফাঁকা। জানালা গুলো নামিয়ে দিয়েও আমার হালকা পুলোভার টা কোনোভাবেই তার কাজ টা ঠিকমতো করে উঠতে পারছিল না। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া কামরার দরজা দিয়ে ঢুকে ঘুরপাক খেয়ে আমাকেই যেন আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরছিল।
সঙ্গের ব্যাকপ্যাক টা বুকে আঁকড়ে ধরেও ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে কোনোরকমে বনগাঁ এসে নামি। ভোরের আলো তখনও স্বমহিমায় ফোটেনি। প্লাটফর্মের আলোগুলো তখনও নেভেনি। শরীর টা এই মুহূর্তে ধাতস্থ করতে যা দরকার, তা হলো গরম চা। স্টেশনের বাইরে আসতেই চোখে পড়লো এক চিলতে চায়ের দোকান। দুই ভাঁড় চা খেয়ে তবে যেন বুকে বল পেলাম। ১১ টার আগে পারমাদন পৌঁছে লাভ নেই, হাতে এখন অঢেল সময়। চা ওয়ালার হাঁকাহাকি তে একটি রিকশা এগিয়ে আসে। তার সাথে কথা বলে একটা রুট প্ল্যানিং করে নিলাম, আগামী ২- ২.৫ ঘন্টা কাটানোর জন্য।
২:
সদ্য ঘুমভাঙা বনগাঁর রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম পেট্রাপোল বর্ডারের দিকে। বড় সুন্দর এই রাস্তাটি। রাস্তার দুধারে বড় বড় গাছ পুরো রাস্তাটাকে মায়াবী করে তুলেছে পাতার ছাউনি দিয়ে। ভোরের ক্রমশ প্রকাশ্য নরম আলো সেই পাতার ছাউনি ভেদ করে পুরো রাস্তাটার ওপর যেন নিপুন হাতে নানারকম নকশা দেয়া আলপনা এঁকে চলেছে।
ফাঁকা রাস্তা। ইচ্ছে মত ছবি তুলতে তুলতে আর রিকশাওয়ালার সাথে গল্প করতে করতে পেট্রাপোল পৌঁছে গেলাম ৭.১০ এ। বর্ডারের গেট অব্দি যাওয়ার আগে ডান দিকের একটা রাস্তা ধরে আগে গেলাম চালু না হওয়া পেট্রাপোল স্টেশন। খুব মিষ্টি একটি স্টেশন। দেখে মনে হয়, এখুনি ট্রেন আসবে আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি ঢুকে যাবো ওপার বাংলার বেনাপোলে। ছোট্ট স্টেশনটিতে দাঁড়িয়ে কল্পনা করতে দারুন লাগে…কবে যে চালু হবে এই রুট!
রিকশা ঘুরিয়ে এবার চলে এলাম বর্ডারে। গেট এর এপাশে ভারতের পতাকা, ওপাশে বাংলাদেশের। দুই দেশেরই সীমা সুরক্ষাবল উপস্থিত। খুব গুরুত্বপূর্ণ বর্ডার এই পেট্রাপোল- বেনাপোল। শুনলাম প্রতিদিন বিকেলে বিউগল বাজিয়ে দুই দেশের জওয়ান রা একসাথে মার্চপাস্ট ও করেন। অত সকালেও দেখলাম বেশ লম্বা লাইন ইমমিগ্রেশনের। কয়েকটি ছবি নিয়ে ফিরে চললাম বনগাঁ বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে।
ফেরার রাস্তায় দেখলাম অনুকূল ঠাকুরের সৎসঙ্গ আশ্রম, গৌড়ীয় মঠ এবং বিখ্যাত ইতিহাসবিদ, রাখালচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এর বাড়ি। বাড়িটিতে ঢোকার মুখে পেল্লায় টিক উড এর কালো দরজাটি নজর কাড়লো। বাড়ির এক দিকটায় একঘর লোকের বসবাস, তবে তাঁরা বন্দোপাধ্যায় পারিবারের কেউ নন। যাইহোক, রিকশা ঠিক সময়ে আমায় বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দিলো।
৩:
৯২ নং বাসটি ছাড়বে ঠিক ৯.৪০ এ। হাতে এখনও মিনিট ২০ সময় আছে তাই বাস স্ট্যান্ডের উল্টোদিকের দোকান থেকে গরম কচুরী আর ছোলার ডাল দিয়ে পেটটা ভরিয়ে নিলাম।
বনগাঁ-হেলেঞ্চা-দত্তফুলিয়া রুটের এই বাস যখন আমায় নলডুগাড়ি নামালো, তখন ঘড়িতে ১০.৪৫। একটি সাইকেল ভ্যানে করে ১০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম বিভূতিভূষণ অভয়ারণ্যের Bibhutibhushan Wildlife Sanctuary or Parmadan Forest প্রধান ফটকে।
WBFDC থেকে অনলাইনে আগেই বুক করা ছিল। গেটে স্লিপ দেখাতেই কেয়ারটেকার বাংলো তে নিয়ে এলো। চারপাশটা দেখে মন ভরে গেল। ভোর রাত থেকে এত কষ্ট করে আসা স্বার্থক মনে হলো। আমার রুম টা দোতলায়। বারান্দা থেকে সামনে তাকালে ঘন সবুজ জঙ্গল। সরু একফালি রাস্তা জঙ্গলের গভীরে চলে গেছে।
হরিণদের সুরক্ষার জন্য জঙ্গলের একটা ভাগ উচুঁ কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া থাকলেও, অরণ্যের মোহ থেকে আপনি বন্চিত হবেন না। ৯২ হেক্টর বিস্তৃত এই অভয়ারণ্য ইছামতী নদীর পার ঘেঁষে অবস্থিত। ঘরগুলি পুরোনো আদলের। লাল মেঝে আর পুরোনো দেওয়াল গুলো যেন যেন অরণ্যের স্যাতস্যাতে ভাব টাকে ঘর অব্দি নিয়ে এসেছে। ঝাঁ চকচকে ac রুম এই পরিবেশে সত্যি মানানসই হতো না। রোদ থাকতে থাকতেই, প্রায় ৩টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম অরণ্য ভ্রমণে। অর্জুন, শিশু, শিমুল, শিশির গাছের ফাঁক দিয়ে কোথাও বা রোদ উকিঁ মারছে, কোথাও বা ঘন কালো ছায়া। এই দিনের বেলাতেও ঝিঁঝি পোকার ডাক এই অরণ্যকে যেন আরো রহস্যময় করে তুলেছে।
দিনের আলো পুরোপুরি ভেতরে না আসায়, অরণ্যের বেশিরভাগ টাই ছায়ানিবির আর স্যাঁতস্যাঁতে। কিছুটা গভীরে ঢুকতেই এক পাল হরিনের দেখা পেলাম। একদল গ্রামের মহিলা মাথায় ভাঙা কিছু গাছের ডাল সংগ্রহ করে বেলাশেষে বাড়ি ফিরছেন। শীতের বিকেল। ৫টার মধ্যে আলো ফিকে হয়ে এলো।
সেদিনের মতো অরণ্যকে বিদায় জানিয়ে লজের পথে পা বাড়ালাম। হঠাৎ এক বিকট আওয়াজে আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। প্রচন্ড কর্কশ আর প্রচন্ড জোড়ে সেই আওয়াজ। একবার নয়, পরপর। ওই নিস্তব্ধ মায়াবী পরিবেশে, বড়ই বেমানান এই আওয়াজ টা। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বুঝলাম এটা কোনো পাখির ডাক। আওয়াজ টা হয়েই যাচ্ছে। অনুসরন করে এগিয়ে গিয়ে দেখি একটি মিনি zoo। আর সেখানেই বেশ কিছু পাখির মধ্যে রানীর মত বিরাজ করছে একটি macau। ওই কর্কশ আওয়াজের সাথে তার কোন মিল নেই। এত রকম রঙের এত সুন্দর একটি পাখি। আর তার গলায় কিনা এরকম পিলে চমকে দেওয়া আওয়াজ!
৪:
ভোরের মিঠে আলোয় অরণ্যের রূপ দেখবো বলে পরের দিন সকালে উঠে বেরিয়ে পড়লাম। ঘন পাতার আচ্ছাদনের ফাঁক ফোকর দিয়ে সকালের আলোর রশ্মি অরণ্যকে যেন এক স্বপ্নপুরীর রূপ দিয়েছে।
শীতের সকালে এই মিঠে রোদ গায়ে মেখে অরণ্য পথে এগিয়ে চলতে বেশ লাগছিলো। একেকটি মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দি করতে করতে চলে এলাম নদীর পারে। তবে এদিকে বেড়া থাকাতে নদীর ধার বরাবর হাঁটা সম্ভব হলো না। কেয়ারটেকার এর থেকে সন্ধান নিয়ে অভয়ারণ্যের পাশের একটি ছোট্ট গ্রামে গেলাম। সেখানে খোঁজ করতেই পেয়ে গেলাম অনন্ত মাঝিকে। অনন্ত মাঝির নিজের নৌকো। তিনি সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন আমায় নিয়ে ইছামতীর বুকে নৌকা বিহারের জন্য। ঠিক করলাম,মধ্যাহ্নভোজের পর আমি নদীর পারে চলে আসবো। সেখানেই আমার জন্য অপেক্ষা করবেন অনন্ত মাঝি।
৫:
ঠিক সময়মতো পৌঁছে গেলাম নদীর ঘাটে। সূর্য্য এখন মধ্যগগনে। অনন্ত মাঝি মাথায় গামছা জড়িয়ে বৈঠা নিয়ে আমায় দেখে একগাল হাসি।
উঠে পড়লাম নৌকোয়। ইছামতীর বুকে ভাসিয়ে দিলাম নিজেকে অনন্ত মাঝির হাত ধরে। নৌকো এখন পাড় ছেড়ে মাঝ নদীতে। নদীর দুধারে বড় বড় গাছ গুলো একেবারে জলের ওপর নুইয়ে পড়েছে, যেন কুর্নিশ জানাচ্ছে অতিথি কে। দুধারে শুধু সবুজ আর সবুজ। এমনকি জলের রং ও যেন সবুজ এখানে।
এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে ইছামতী, আর তার সাথে আমিও। অলসভাবে বৈঠা নিয়ে দাঁড় বইছে অনন্ত মাঝি। কোথাও বা নদী সরু, কোথাও বা চওড়া। কোথাও বা পাড়ের কাছে জাল দিয়ে বেড়া তৈরী করছে কোনো জেলে, কোথাও বা একলা মাঝি তাঁর নৌকো নিয়ে ভেসে চলেছে কিসের যেন খোঁজে।
কথায় কথায় জানতে পারলাম অনন্ত মাঝির বয়স ৯০ ছুঁই ছুঁই। তবে এটা তাঁর শরীরের কাঠামো দেখে কোনোভাবেই মনে হয় না। জোয়ান বয়সে অনন্ত মাঝি বাবার সাথে নৌকাতেই ইছামতীর জলপথে দু দুবার চলে গেছিলেন বাংলাদেশ। গল্প করতে করতে পৌঁছে গেলাম নীল কুঠির ঘাটে। ওই পারটা মঙ্গলগঞ্জ। এখানেই নীলকুঠী। বহু আগে এটি ছিল কোনো এক জমিদার বাড়ি। পরে ব্রিটিশ আমলে নীলকর সাহেবরা এটিকে করে দেয় নীলকুঠী। নৌকো ঘাটে লাগিয়ে ঢুকে পড়লাম কুঠীতে। ভগ্নদশা এই কুঠীর প্রতিটি ইঁট যেন আজও ফিসফিস করে বলে চলেছে নীল চাষীদের ওপর নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচারের গল্প।
ফিরে এলাম নৌকোয়। এগিয়ে চললাম ইছামতীর বুকে ভাসতে ভাসতে আরও কিছুটা। চোখে পড়লো ডানদিকে একটি ছোট্ট গ্রাম। কয়েক ঘর মাত্র বসতি। কোথাও বা পাট শুকোচ্ছে, কোথাও বা শীতের অলস দুপুরে কোনো এক মাঝি তাঁর ঘাটে বাঁধা নৌকোয় বিশ্রাম নিচ্ছে। আবার কোথাও এক শিশু নোঙর করা নৌকো থেকে লাফ দিয়ে জলে নেমে তার দ্বিপ্রাহরিক স্নান পর্ব সারছে।
নৌকো ঘুরিয়ে এবার ফেরার পালা। মন মানে না। ইচ্ছে করছে ইছামতীর ইচ্ছায় সারা দিয়ে, অনন্ত মাঝির হাত ধরে নদীর চলার সাথে নিজেকে মিলিয়ে দিতে। কেন এমন হয়না যে এইভাবেই ভেসে ভেসে পৌঁছে যাবো ওপার বাংলায় অনন্ত মাঝির মত?
৬:
প্রায় ৩ ঘন্টা নৌকো বিহারের পর ফিরে এসে উঠলাম পারমাদন ঘাটে। অনন্ত মাঝির দৌলতে, গ্রামে গিয়ে তাঁর বৌমার হাতের চা খেলাম। ওঁদের কে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম লজে। আজ ফেরার পালা। তখন বিকেল হয় হয়। পারমাদনের সবুজ গহন অরণ্য আর ইছামতীর সবুজ স্মৃতি তখনও আমায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে যেন। নিজেকেই নিজে আবার ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, কোলকাতা ফেরার পথে পা বাড়ালাম। পারমাদন আমার মনের গভীরে, পরোমানন্দের পারমাদন হয়ে চিরতরে বাসা বেঁধে ফেললো।
Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.