১:
লক্ষ্মীকান্তপুর নেমে ঘড়িতে দেখলাম সকাল ৯.০৫। মনে তখনও আশা হয়তো রামগঙ্গার ১০.৩০ এর লঞ্চ টা ধরে নিতে পারবো যদিও সুধাংশু দা বলেছিলো বাসে লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে রামগঙ্গা প্রায় ২ ঘন্টার রাস্তা। হুড়মুড় করে স্টেশনের বাইরে এসে খোঁজ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম বাস স্ট্যান্ডে। সেই অর্থে স্ট্যান্ড বলে কিছু নেই। ডাউন এর বাসগুলো এসে একটা বটগাছের সামনে দাঁড়িয়ে লোক তুলে আবার বেরিয়ে যায়। আশায় মরে চাষা। প্রায় আধ ঘন্টা মোবাইল ঘাঁটা, চা, সিগারেট..ইত্যাদির পরও বাসের ব দেখলাম না। অগত্যা আবার সুধাংশু দার শরণাপন্ন হলাম, নাহলে হয়তো এরপরের ১.১০ এর লঞ্চ টাও ফসকাবো। অবশেষে সুধাংশু দার সুপরামর্শ অনুযায়ী টাটা ম্যাজিক এর মতন একটি ” সার্ভিস গাড়িতে” চড়ে বসলাম। ১ ঘন্টায় মিলন মোড়, ভাড়া ১৪ টাকা জনপিছু। সেখান থেকে সুহৃদয় ড্রাইভারটি আরেকটি ম্যাজিক ধরিয়ে দিলো। মিলন মোড় থেকে প্রায় ৫০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম রামগঙ্গা ফেরিঘাট ১৪ টাকায়।
২:
রামগঙ্গা ঘাটটি পাথর প্রতিমা পঞ্চায়েতের অন্তর্ভুক্ত। এইখানে বলে রাখি G প্লট পৌঁছানোর দুটো উপায় রামগঙ্গা থেকে। লঞ্চ এ চাঁদমারী ঘাট প্রায় সোয়া একঘন্টা এবং তারপর ভ্যানা বা ইঞ্জিন ভ্যান এ ৪০ মিনিটের রাস্তা রামকৃষ্ণ আশ্রম। অথবা ২.৩০ ঘন্টা লঞ্চ এ করে সীতারামপুর ঘাট এবং সেখান থেকে মিনিট পনেরো ভ্যানো চড়ে আশ্রম। ভোর ৫ টায় বেরিয়েও ঠিক ৫ মিনিটের জন্য নাকের ডগা থেকে সকাল ৫.৫৫ র লক্ষ্মীকান্তপুর টা ফসকে, ৭.১৫ র টা ধরেছি। ৮ ঘন্টা হলো বাড়ি থেকে যাত্রা শুরু করেছি, এখনও গন্তব্য বহু দূর। তাই আর ২.৩০ ঘন্টার নৌকো বিহারের রসদ নেই শরীরে। চাঁদমারী ঘাটে নেমেই যাবো, ফোনে জানিয়ে দিলাম সুধাংশুদা কে। লঞ্চটির নিচে বসার জায়গা আছে আর ওপরে ছাদেও। তবে ছাদে কোনো সামিয়ানা নেই। সেখানেই গুছিয়ে বসলাম।
চাঁদমারী অব্ধি ভাড়া ১০ টাকা। সাইকেল থেকে শুরু করে বিভিন্ন রোজকার প্রয়োজনীয় পণ্য বস্তা বোঝাই করে সাজানো ছাদে। এই ব দ্বীপ অঞ্চলের গ্রামগুলোর লোকেদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো এভাবেই নৌকোয় আসে। ক্যামেরা টা হাতে নিয়েই বসেছিলাম। লঞ্চ ছাড়তেই দুপাশে দৃশ্যমান হলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন ছোট বড় দ্বীপ। কোনটা Lothian Island, কোনটা L-Block, কোনটা সুন্দরবন।
পশ্চিমবঙ্গের শেষ দক্ষিণ প্রান্ত এই ব দ্বীপ বা delta region. আর তারই মধ্যে একটি বিন্দু হলো G-Plot। চাঁদমারীর আগে আরও তিনটি ঘাটে লঞ্চ ভিড়ল, এক দুটি লোক ওঠানামা করলো। দুধারে ডাঙ্গার পর্যাপ্ত সবুজের আহ্বান, ম্যানগ্রোভ এর নির্যাস আর সরল গ্রামের মানুষ গুলোর প্রশান্ত মুখ দেখতে দেখতে অবশেষে পৌঁছে গেলাম চাঁদমারী ঘাট।
৩:
২৫০/- টাকায় রফা করে উঠে বসলাম একটি ভ্যানোতে। Public Transportation বলতে এখানে একমাত্র এই ভ্যানো। পুরো দ্বীপটায় আর কোনো ৩ চাকা বা চার চাকার বাহন নেই। সরু রাস্তা কোথাও বা কংক্রিটের কোথাও বা ইঁট দিয়ে বাঁধানো। দুপাশে কচি কলাপাতার মত সবুজের সাথে ইতিউতি মিশে আছে কাসুয়ারিনা। মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে ছোট ছোট পুকুরে ফুটে থাকা শালুক আর তাকে ঘিরে কয়েক ঘর বসতি। খাঁড়ির জল ঢুকেই পরিপূর্ন রাখে এই পুকুরগুলোকে।
জায়গাটির ভৌগোলিক অবস্থান টা মাথায় একবার ঝলক দিতেই রোমাঞ্চে গায়ে কাঁটা দিলো। এই মুহূর্তে আমি এক দ্বীপে। এমন এক দ্বীপ যার সাথে বাহির দুনিয়ার যোগাযোগ শুধুমাত্র ভটভটিতে। এমন এক দ্বীপ যার পারগুলো প্রতিবছর একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে বঙ্গপ সাগরের বুকে। এমন এক দ্বীপ যাকে ঘিরে আছে দক্ষিণরায় অধ্যুষিত সুন্দরবনের গভীর অরণ্য। মিনিট চল্লিশেকে পৌঁছে গেলাম জি-প্লট রামকৃষ্ণ মিশন গেস্ট হাউসে। সুধাংশু দা অধীর আগ্রহে গেটেই অপেক্ষা করছিলেন। অনেকটা জমি নিয়ে আশ্রম।
গেট দিয়ে ঢুকে বাঁহাতে একটি একতলা স্কুলঘর বা পাঠশালা। সাথে লাগোয়া একটি ঘর, মিশনের নিজস্ব অতিথিরা এলে এইখানে থাকেন। পাশেই উপাসনা ঘর। এর ঠিক পাশেই রান্নাঘর সমেত দালান যেটিকে ক্যান্টিন হিসেবে দিব্যি মানিয়েছে। ক্যান্টিন এর গায়ে লাগোয়া দোতলা বাড়ি…আমার মতন বাইরের অতিথিদের এই বিল্ডিং এই থাকার ব্যবস্থা করা হয়। পেছনদিকে পুকুর। চারিদিকে গাছগাছালি আর সুন্দর বাগান দিয়ে সাজানো আশ্রমটি। দেখলেই যেন সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। সুধাংশু দা ভীষণ মিশুকে একটি মানুষ। এতটাই আপন করে নিলেন আমাকে, যেন বহুদিনের চেনা। বেলা গড়িয়ে তখন প্রায় ৩টে। আমি আসার আগেই সুধাংশুদা নিজে হাতে পুকুরের মাছ ধরেছেন। ক্যান্টিনে গিয়ে আগে তাঁর বউএর হাতের বিশুদ্ধ বাঙালি রান্না মাছ ভাত খেয়ে তবে নিজের ঘরে ঢুকলাম। দোতলার একটি ঘর বরাদ্দ হয়েছে আমার জন্য। ঘর বলতে খুবই সাধারণ মানের একটি মাথা গোঁজার জায়গা। সিইলিং এ বিয়ে বাড়ির প্যান্ডেলের মত সামিয়ানা। তার থেকে ঝুলছে একটি লোহার রড যার আগায় লাগানো সেই অটোতে লাগানোর পুচকি একটি প্লাস্টিকের পাখা।
খেলনা পাখা বললেও ভুল হবে না। ওই রডেই ঝুলছে মোটর আর সুইচ। খাটের ওপর থেকে পাখাটার দূরত্ব হবে ৩ ফুট মতন, মানে শুলে ঠিক মাথার ওপর ওটি ঘুরবে। বেশ অভিনব বন্দোবস্ত। সবই সোলারে। বাথরুম নিচে এবং জল সামনের টিউব কল থেকে টেনে আনতে হবে। অবশ্য, সুধাংশু দা সেসব ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছিলেন।
৪:
বেলাশেষের মিঠে আলোটাকে গায়ে মেখে সূর্যের সাগরের বুকে বিলীন হয়ে যাওয়াটাকে উপলব্ধি করার জন্য আর বেশি দেরী না করে বেরিয়ে পড়লাম। দ্বীপের দক্ষিণ ভাগে সবদিকেই তো বঙ্গপ সাগর। গ্রামের ভেতর দিয়ে সরু ইঁট বাঁধানো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। যত এগোচ্ছি ম্যানগ্রোভ এর আধিপত্য নজরে আসছে। শাপলা পুকুরের নিটোল জলে তখন শেষ বেলার সোনালী রোদের ঝিকিমিকি।
পথের দুধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি মাটির ঘর আর তার নিকোনো উঠোনে মহিলাদের অলস বিকেলের আড্ডা। কোথাও বা আমার ক্যামেরা দেখে ছুট্টে পালিয়ে যাওয়া চপল শৈশব, আবার কোথাও গাছের ডালে বসে কিশোরীদের আমায় দেখে হাসাহাসি।
হাঁটার পথে কম করে ৬ জন গ্রামবাসী আমায় এতক্ষনে খুব অন্তরিকিতার সাথে জিজ্ঞেস করে নিয়েছেন ” বাবু, কোথা থেকে আসা হলো? কার বাড়িতে এলেন?” পুরো দ্বীপটাই যেন এক পরিবার এখানে। নতুন ফসলের অপেক্ষায় থাকা জল ভরা ধানী জমি এখন তার সোনালী মুখমণ্ডলে লালচে আবীর মাখতে শুরু করেছে।
একটু জোরেই পা চালালাম এবার। মিনিট পাঁচেক আরো হেঁটেই পৌঁছে গেলাম দ্বীপের শেষ প্রান্তে। উন্মুক্ত বঙ্গোপসাগর আমার সামনে। বোল্ডার এর ওপর দিয়ে সমুদ্র তটে নামলাম ঠিকই, তবে এদিকটায় বালুর চেয়ে কাদামাটি বেশি থাকাতে এগোলাম না বেশিদূর। একটু আগে দেখে আসা আবীর খেলা এখন রূপ নিয়েছে ফাগুন উৎসবে।
অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভায় ডুবে রয়েছে উন্মুক্ত আকাশ আর অনন্ত সাগর। সেই আলোয় ডুব দিয়ে উপলব্ধি করলাম সাগরের দিকচক্রবালে একটু একটু করে আগ্নেয় গোলকের বিলীন হয়ে যাওয়াটাকে।
যবনিকা পত্তনের পর বোল্ডার থেকে উঠে আসতেই আমি হতবাক! অস্ত যাওয়া সূর্যের ঠিক বিপরীত গগনে এ তো দেখি আরেক উপক্রম নাটিকা! কোন ফাঁকে যেন পূর্ণিমার চাঁদ একগাল হাসি নিয়ে আমার দিকেই চেয়ে আছে। ভাবখানা অনেকটা এরকম…” এমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিস কেন? থাকবি নাকি আমাদের এই দ্বীপে আমাদের সাথে?”
সত্যিই আমারও যেন তাই মনে হলো। এই চন্দ্র, সূর্য, গ্রামের ওই সরল মানুষগুলো আর সবুজের প্রাচুর্য….এরা সবাই যেন একই পরিবারের সদস্য। ফেরার পথে পা বাড়ালাম। একই পথ, একই গ্রাম, একই জলাশয়। শুধু সোনালী রং টা পাল্টে গিয়ে হয়ে গেছে রুপালি। জ্যোৎস্নার আলো ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। থমকে গেলাম একটি পুকুরের পাশে এসে। পুকুরটির পাশের কয়েকটি তালগাছের মাথার ওপর জ্বল জ্বল করছে রূপালী চাঁদ আর তার প্রতিবিম্ব পুকুরটির জলে।
সে এমন এক মুহূর্ত যা ভাষায় বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই। বাকরুদ্ধ হয়ে দেখলাম কিছুক্ষন। আমার বদ অভ্যাসের বসে যথারীতি এবারেও ট্রাইপড আনিনি। খুব রাগ হলো নিজের ওপর কারণ একমাত্র আমিই জানি কি মিস করে গেলাম! যাইহোক, পুকুরটির এপাশে রাস্তার দিকে দেখলাম একটি মাটির ঘর আর তার আবার বারান্দার মত একটি মাটির দেওয়াল। গৃহকর্তা বাইরেই ছিলেন এবং আমার কীর্তিকলাপ দেখছিলেন। তাঁর ওই বারান্দার দেওয়ালে ক্যামেরা রাখার অনুমতিও পেয়ে গেলাম। লাভ বিশেষ হলো না কারণ angle টা পেলাম না ঠিক। এরপর গৃহকর্তাকে সংক্ষেপে বোঝালাম আমার কিরকম উচুঁ জায়গা চাই যাতে ক্যামেরাটা রেখে লো শাটার স্পীডে কিছু ছবি তুলতে পারি। ব্যাপারটা বুঝে উনি নিজেই উৎসাহ নিয়ে কোথা থেকে একটি চেয়ার জোগাড় করে এনে রাস্তার মাজখানে রেখে বললেন চেষ্টা করতে। অবাক হয়ে গেলাম মানুষটির আন্তরিকতায়।
যদিও ছবির angle টির বিশেষ সুবিধে আমি করতে পারলাম না। মিশনে ফিরে মুড়ি, মিশনের বাগানের বেগুন গাছের থেকে তোলা বেগুন দিয়ে বেগুনি, মিশনের বাগানের হেলেঞ্চা শাকের বড়া আর চায়ের সঙ্গতে জমিয়ে আড্ডা হলো সুধাংশু দার সাথে। সৌভাগ্যবশত মিশনের প্রতিষ্টাতা মহাশয়ও উপস্থিত ছিলেন। উনি মেদিনীপুরের মানুষ। বহুবছর আগে শিক্ষককতার সূত্রে তিনি এই গ্রামের একটি স্কুলে আসেন। সেই থেকে তিনি ভালোবেসে ফেলেন গ্রামটিকে এবং গ্রামটির মানুষগুলোকে। সেই অনুপ্রেরণা এবং পাশাপাশি রামকৃষ্ণ দেবের ভক্তির টানে তিনি এই মিশনের প্রতিষ্ঠা করেন। অনেক্ষন কেটে গেল গল্প শুনতে শুনতে। সুধাংশু দা পরদিন ভোর ৪টায় বেরিয়ে চলে যাবেন পাথর প্রতিমায় কোনো একটা মিটিংয়ে, ওনার সাথে কাল আর দেখা হবে না। দুপুরে খাওয়ার সময় সুধাংশুদা স্বাদরে জিজ্ঞেস করেছিল ” দাদা রাত্রে কি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে বলুন।” উত্তরে আবদার করেছিলাম যদি দেশী হাঁসের ডিম পাওয়া যায়। রাত ৯টা নাগাদ অতীব সুস্বাদু সেই দেশি হাঁসের ডিমের ডালনা দিয়ে নৈশভোজ সেরে সুধাংশুদা কে বিদায় জানিয়ে সেইদিনের মতো অবসর নিলাম।
৫:
পরদিন সকালে চা জলখাবার সেরে বেরিয়ে পড়লাম। কাল যে পথে গেছিলাম তার বাঁদিকের রাস্তাটা দিয়ে হাঁটা লাগালাম।
সকালের ঝকঝকে রৌদ্রে দুপাশের সবুজটাকে নবরূপে পেলাম। ৭০-৩০০ mm লেন্সটাই আজ ক্যামেরায় লাগিয়ে বেড়িয়েছি কারণ পাখি দেখাই আজ মূল উদ্দেশ্য। একে একে পথের দুপাশেই পেয়ে গেলাম Green Bee Eater, Common Kingfisher, White breasted kingfisher এবং বেশ কিছু বক।
মিনিট দশেক হাঁটতেই পৌঁছে গেলাম সাগর পারে। দূর থেকেই দেখা যায় বনদপ্তর নির্মিত একটি কংক্রিটের ছাতা ওয়ালা বসার জায়গা এবং তার সাথে লাগোয়া ৫০ মিটার মত লম্বা কংক্রিটের ডায়াস যা জলের মধ্যে গিয়ে মিশেছে।
এই ডায়াস এর একেবারে শেষ সীমানায় চলে গেলাম। আমার সামনে এবং দুই ধারে আছড়ে পড়ছে একের পর এক ঢেউ। বাঁ পাশে অর্ধ গোলাকার সমুদ্রতট সাদা বালির যাকে ঘিরে আছে গভীর কাসুয়ারিনার বন।
একটি অসামান্য দৃশ্যপট। সাগরের মাঝে দূরে দেখা যাচ্ছে কোনো এক ছোট্ট দ্বীপ। আমি ছাড়া আর একটিও ট্যুরিস্ট সেখানে নেই। জনমানব বলতে একদল বাচ্ছা তখন জলকেলি করে বেড়াচ্ছে সমুদ্র তটে।
ওদের থেকে পথনির্দেশ নিয়ে এবার পা বাড়ালাম জঙ্গলের দিকে। যতদূর চোখ যাচ্ছে, সমুদ্রের পার বরাবর ঘন কাসুয়ারিনার জঙ্গল। গাছের ফাঁকে ফাঁকে কোথাও ছোট ছোট নৌকো বাঁধা। কোথাও আবার জঙ্গলের ফাঁকে একচিলতে খালি জায়গায় শুকোচ্ছে মাছ ধরার জাল আর তার ঠিক পেছনেই ছোট্ট একটি অর্ধ তৈরী নৌকো।
জঙ্গলের অপর প্রান্তে একই সাথে চলেছে একটি কাঁচা রাস্তা। রাস্তার ওপারে ধানক্ষেত আর তার ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটি মাটির ঘর। অরণ্যের নির্যাস টা নেবার জন্য প্রায় দেড় কিমি হাঁটলাম। কিছুটা দূরে দূরে চোখে পড়লো বনদপ্তর নির্মিত ছোট ছোট বসার জায়গা। বোঝা যায় তাঁদের নজর পড়েছে সদ্য, এই জায়গাটির ওপর।
কিভাবে যে ঘড়ির কাঁটা ১১টায় পৌঁছে গেল, টেরই পেলাম না। ফেরার পথে ঢুঁ মারলাম এক গ্রামীন মন্দিরে। মন্দিরের পাশেই আছে উচ্চ বিদ্যালয়। সেদিন ছিল শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর জন্মদিন। মিশনে ঢুকে দেখি তাঁর স্বরণে প্রতিষ্ঠাতা মহাশয় এবং তাঁর এক সাকরেদ একঘর বাচ্ছাদের নিয়ে কিছু দেশাত্মবোধক গানের আসর বসিয়েছেন।
চটজলদি খাওয়া সেরে তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম সীতারামপুর ঘাটের উদ্দেশ্যে। অন্য একটি ভ্যানোকে সুধাংশু দা। আগেই বলে রেখেছিলেন কারণ লঞ্চ ১টায় ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। সীতারামপুর ঘাটের বেশ কিছু আগে থেকেই চোখে পরে সারী সারী অরধনির্মিত নৌকো বা মাছধরা ট্রলার। হ্যাঁ দ্বীপের ভেতরেই এই নৌকো বানানোর কারখানা।
৬:
সীতারামপুর ঘাট থেকে যথাসময়েই নৌকো ছাড়লো আমায় এবং আর ৪-৫ জন যাত্রী নিয়ে। স্থানীয় দের কথায় এই ঘাট শতদল নদীর ওপর যেটা গিয়ে সাগরে মিশেছে। আবার চাঁদমারি ঘাট টি পরে নিতুভাঙা নদীর ওপর। ফেরার পথের এই লঞ্চটি অনেকটাই ফাঁকা।
আমি লঞ্চ এর ছাদে উঠে নিজের পছন্দ মত একটি জায়গা নিয়ে বসে গেলাম। এই সফর ২.৩০ ঘন্টার। জলপথের দুধারে ডাঙায় ম্যানগ্রোভ এর ছড়াছড়ি। বেশ কয়েক জায়গায় দেখলাম কাদামাটিতে ট্রলার গুলো বেঁধে রাখা হয়েছে।
জলে নীলচে আভা। তার সাথে সবুজের সমারোহের মাঝে লাল লাল ট্রলার গুলো যেন ছবির মত লাগছে। একের পর এক দ্বীপপুঞ্জ পার হয়ে আমরা এগোতে থাকলাম। চাঁদমারী ঘাট পৌঁছনোর আগে পেলাম আরও তিনটি ঘাট। তার মধ্যে একটিকে অবশ্য ঘাট না বলাই ভালো। এক গ্রামবাসী হাতে জুতো নিয়ে এক হাঁটু কাদায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে আমাদের লঞ্চ টিকে ইশারা করলেন। যতটা কাছে যাওয়া সম্ভব আমরা এগিয়ে গিয়ে ওনাকে কর্দমাক্ত অবস্থাতেই উঠিয়ে নিলাম। দূরে পাড়ে দাঁড়িয়ে তাঁকে বিদায় জানালো তার পরিবার। এই হলো “ঘাট”।
বুঝলাম ব্যাপারটা অনেকটা আমাদের কোলকাতার প্রাইভেট বাসের মতন আর কি, আপনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত টা তুললেই হলো…সে স্টপেজ হোক বা নাই বা হোক। সহৃদয় চালক ঠিক দাঁড়িয়ে গিয়ে আপনাকে তুলে নেবে। তফাৎ শুধু একটাই…ওটা ডাঙ্গা আর এটা জল! তথাকথিত “পাকা” ঘাটগুলো যে কতটা পাকা, তা ওগুলোর ক্ষয়ে যাওয়া থাম আর অর্ধ ভঙ্গুর অবস্থা থেকেই বোঝা যায়। দুধারের দ্বীপগুলো পাখিদের স্বর্গরাজ্য। Lesser whistling duck এর মতো পরিযায়ী পাখি থেকে শুরু করে স্থায়ী বাসিন্দা বিভিন্ন প্রকার Kingfisher এবং Plover চোখে পড়লো।
যাত্রা তো নয়, যেন ছবির বইয়ের একের পর এক পাতা উল্টে যাওয়া। রামগঙ্গা পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গেই শেয়ার গাড়ি পেয়ে গেলাম মিলন মোড়ের। সমস্যা টা হলো মিলন মোড় পৌঁছে দেখি সার্ভিস গাড়ির কোনো দেখা নেই। রবিবার নাকি ওদের চল একটু কম। বেলা গড়িয়ে প্রায় ৫টা। বুঝলাম ৬.০৫ এর লক্ষ্মীকান্তপুর ধরা যাবে না। পরেরটা ৬.৩৮ এ যেটা শিয়ালদা ঢুকবে ৮.১৭ তে। এরমধ্যেই একটি সার্ভিস গাড়ি এলো। ভেতরে বসার কোনো জায়গা নেই, যারা উঠলো তারা হয় বেয়ে বেয়ে গাড়ির মাথায় উঠে গিয়ে বসলো আর নয়তো পেছনের বাম্পার এ দাঁড়িয়ে গেলো। এদের অবস্থা দেখে মনে মনে হাসলাম। তখনও বুঝিনি আমার জন্য কি অপেক্ষা করে আছে। পরের গাড়িটি এলো প্রায় ৫.২০ তে। একইরকম ভীড়। এইটা ছাড়লে আমার আর ৬.৩৮ পাওয়া হবেনা তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। উপায় একটাই। আর কিছু না ভেবে, সোজা উঠে পড়লাম গাড়ির মাথায়। জি-প্লট এর থেকে এখানে ঠান্ডা দ্বিগুণ সেটা টের পেলাম গাড়ি চালু হতেই। শীতের সন্ধ্যার কনকনে ঠান্ডা হাওয়া সোয়েটার ভেদ করে যেন আমার হাড়ে এসে বিঁধছে। পিঠের bagpack টা খুলে সামনের দিকে নিলাম বর্ম হিসেবে। নাঃ ঠান্ডা নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। যত ভাববো তত কুঁকড়ে যাবো। বরং নিজের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে নতুন এক সংযোজন হোক। একটু ধাতস্থ হতেই ডানদিকের আকাশে চোখ গেল। সেখানে তখন সাধারন পূর্ণিমার চাঁদের থেকে অনেকটা বড় আর উজ্জ্বল super moon| রাস্তায় আলো বলতে শুধু আমাদের গাড়িটির জোরালো হেডলাইট, দুপাশের অজানা কালোকে খান খান করে ছিন্নভিন্ন করে এগিয়ে চলেছে। রাস্তার ওপর ঝুঁকে পরা গাছগুলো থেকে মাঝে মধ্যেই কিসব পোকা যেন ছিটকে এসে মুখে এসে লাগছে হওয়ার দাপটে। ঢোলা অব্ধি গাড়ির যাতায়াত এই সময় খুবই কম এই রাস্তায়। ঢোলা তে নিচে থেকে কিছু লোক নামলেও, আমি ততক্ষণে এই রোমাঞ্চকর যাত্রার স্বাদটা পেয়ে গেছি তাই নিচে নামার আর কোনো প্রয়োজনই নেই। সেই দুপুর বারোটা থেকে যা যা ভিন্নপ্রকার যাত্রার সম্মুখীন হয়েছি তাতে লাক্ষীকান্তপুরে নেমে যেন মনে হল বাড়িই তো পৌঁছে গেলাম। ট্রেনে বসে খালি এটাই মনে হচ্ছিল কোলকাতার বুকে আধঘন্টার পথে ৩ মিনিট জ্যাম এ দাঁড়ালেই আমাদের কপালে বিরক্তির পাঁচটি রেখা পরে যায়। আর এই সুদূর দ্বীপের মানুষগুলোর কাছে এই দৈনন্দিন Quadrathlon বা Pentahlon টাই হলো জীবন রেখা। আমরা মানুষ, আর ওনারা..?
Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.
অসাধারণ বর্ণনা।
ধন্যবাদ 💐