Massanjore Dam
নির্জন মাসাঞ্জর
১:
হুল এক্সপ্রেস ঘড়ির কাঁটা ধরে সকাল ৬.৪৫ এ ছাড়লো ঠিকই, তবে সিউড়ি পৌঁছালো আধ ঘন্টা দেরিতে। সিউড়ি স্টেশন থেকে বেরিয়ে রিকশা নিলাম বাস স্ট্যান্ড এর উদ্দেশ্যে। সিউড়ি থেকে মাসাঞ্জর Massanjore Dam ৩৮ কিমি রাস্তা। বাস স্ট্যান্ড পৌঁছে দুমকার বাসে টিকিট কেটে উঠে পড়লাম। বাস ছাড়লো যথাসময়। পথে পড়লো তিলপাড়া ব্যারাজ। কিছুটা যাওয়ার পরেই আশপাশের দৃশ্যাবলী বদলে গেল। কোথাও বা মাইলের পর মাইল ক্ষেত, কোথাও বা দু ধারে সোনাঝুড়ির জঙ্গল। সহযাত্রীদের চোখেমুখে ও ভাষায় একটা আদিবাসী ছোঁয়া। মাসাঞ্জর জায়গাটি ঝাড়খণ্ডের দুমকা ডিস্টিক্টের অন্তর্ভুক্ত। পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খণ্ডের সীমান্ত এলাকায় দুই রাজ্যের ভাষা, পোশাক আশাক, সংস্কার, জীবনধারণ সব যেন মিলে মিশে একেবারেই এক আলাদা নতুন জীবনধারায় পরিণত হয়েছে। Fusion বলা যেতে পারে। ধীরে ধীরে সেই Fusion এ তাল মিলিয়ে গাড়ির নম্বর গুলো – WB এর সাথে যুক্ত হলো JH। প্রায় একঘন্টা লাগলো মাসাঞ্জর পৌঁছতে। বাস স্টপ টা ড্যামের গেটের একদম কাছে। বাসস্টপ পৌঁছনোর কিছুটা আগে থেকেই খেয়াল করেছিলাম, সমান্তরাল রাস্তা ছাড়িয়ে বাস মালভূমি ধরেছে । বাসস্টপ থেকে শুরু হচ্ছে পাহাড়ি রাস্তার চড়াই। আমি অবশ্য ওখানে না নেমে আরেকটু এগিয়ে নামলাম কন্ডাকটর এর কথায়। ইয়ুথ হোস্টেল টা নাকি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে।
২:
নেমে বুঝলাম ভুল জায়গায় নেমেছি। Irrigation Department এর বাংলো যাবো ভেবে ভুল জায়গায় নামিয়েছে কন্ডাকটর মহাশয়। স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ইয়ুথ হোস্টেল যেতে গেলে চড়াই ভেঙে আরো ওপরে উঠতে হবে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, যারা ড্যামের সব থেকে কাছে থাকতে চান, তাদের জন্য Irrigation এর বাংলোটাই সবচেয়ে সুবিধের হবে। আমার বাঁ দিকে খাদের ধারের গাছগাছালির ভেতর থেকে উকিঁ মারছে রোদের আলোয় ঝিকমিক করা মাসাঞ্জরের সুবিশাল হ্রদ। ডান হাতে পাহাড়ের পাথুরে দেওয়াল গুলো ঘন সবুজে মোড়া। ওপরের দিকে ঘন জঙ্গল। বেশ কিছুটা হেঁটে উঠে বাঁ দিকে ছোট একটি পাহাড়ের মাথায় দেখলাম সাদা আর নীলে উকিঁ মারছে একটি থাকার জায়গা।

Road to Massanjore Youth Hostel

Blue building is the Massanjore Youth Hostel
বড় রাস্তা থেকে একটি সরু রাস্তা বাঁ দিকে চলে গেছে সোজা সেই পাহাড়ের মাথায়। সেখানেই এই বাংলোটি। আন্দাজ করতে অসুবিধে হলো না যে ওটাই আমার গন্তব্য। ইয়ুথ হোস্টেলের গেট দিয়ে ঢুকে আশপাশ টা দেখে মন ভরে গেল। উচুঁ পাথুরে ঢিবির ওপর এই বাংলো। খুব সুন্দর একেকটি কটেজ। পেছনের দিকটায় সুবৃস্তিত হ্রদ। আর চারিধারে সবুজ জঙ্গলে মোড়া। ছোট ছোট পাহাড়গুলোর কোলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু আদিবাসী গ্রাম।

Forest surrounding Massanjore Youth Hostel
কিন্তু একী? রিসেপশনের খোঁজ করতে গিয়ে দেখি সবদিকে সব দরজা বন্ধ। জনমানব শূন্য একটি বাংলো। কোনো ফোন নম্বর ও নেই যে কেয়ারটেকার এর খোঁজ করবো। মনে মনে বেশ রাগই হলো। কিছুক্ষণ পর আমার হাঁকাহাকিতে গেট খুলে টি শার্ট এবং হাঁটু অব্দি গোটানো লুঙ্গি পরিহিত একটি আদিবাসী যুবক গেট খুলে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। লোকটি কেয়ারটেকার হিসেবে পরিচয় দিতে আস্বস্ত হলাম। নাম তার শ্যামলাল। আমিই একমাত্র বোর্ডার হওয়াতে আমার পছন্দসই ঘর টা বেছে নেওয়ার সুযোগ পেলাম। একেবারে ধারের কটেজ টা আমি নিলাম। পেছনের জানালা দিয়ে হ্রদের কিছুটা দৃশ্যমান। আরেকদিকের জানালা দিয়ে পাহাড় আর জঙ্গল। শ্যামলাল প্রথমেই বলে দিল খাওয়ার অর্ডার টা তখুনি দিতে হবে কারণ ওনাকে দূরের বাজার থেকে আনতে হবে। বাংলোর নিজস্ব কোনো ডাইনিং নেই এবং বেরিয়েও আশপাশে কোনো দোকান নেই। এই বাংলোর সম্পূর্ণ দেখভালের ভার এই শ্যামলাল এর ওপরেই। আমার হাতে চাবি দিয়ে শ্যামলাল বেরিয়ে গেল খাবারের জোগাড়ে।
৩:
ঘড়িতে তখন বাজে প্রায় ২টো। ভোর ৫.৩০ টায় বেরিয়ে অবশেষে দুপুর দুটোয় থিতু হলাম। স্নান করে আসতেই যেন সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে মুছে গেল। কোলকাতায় টানা বৃষ্টি হলেও এই তল্লাটে বর্ষার নামগন্ধ নেই। ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ্দুর বাইরে। খাওয়া দাওয়ার পর রোদটা একটু পড়া অব্দি অপেক্ষা করে বিকেল ৪.৩০ নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম ড্যামের উদ্দেশ্যে। বাংলোতে আসার সময় আশপাশ টা ভালো করে দেখিনি। এখন বেরিয়েই দেখি হ্রদের পারে যাওয়ার একটি রাস্তা। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। পাড় থেকে দুর্দান্ত ভিউ হ্রদের। কোথা থেকে একগুচ্ছ কালো মেঘ সূর্যকে আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করছে। দ্বিগুন প্রতাপে সূর্যদেব আলোর রশ্মির তলোয়ার দিয়ে সেই মেঘের বুক চিরে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে।

Lake beside Massanjore Youth Hostel
হ্রদের প্রায় মাঝ বরাবর অব্দি চলে গেছে সরু একটি ব্রিজ পায়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য। তবে ব্রীজের শুরুতেই দেখলাম কাঁটাতার দিয়ে রাস্তা আটকানো আছে। পড়ন্ত বেলার আলোয় কিছু ছবি তুলে এবার হুড়মুড় করে হাঁটা লাগলাম বড় রাস্তার দিকে। সূর্যাস্তের যে আর বেশি দেরী নেই, তার আগে আমায় ড্যাম এ পৌঁছাতেই হবে। বড় রাস্তার কাছে পৌঁছনোর আগেই দেখি একটি বড় অটো গোঁ গোঁ করে এদিকেই ছুটে আসছে। সৌভাগ্যবশত আমার চিৎকার তার কানে পৌঁছতে, দাঁড়িয়ে গেল। গিয়ে দেখি এ তো মালবাহী অটো বা টেম্পো। ১০ টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে অনুরোধ করাতে বললো ড্যামের কাছে নামিয়ে দেবে। ড্যামের আগেই একটি ক্যানাল এর সামনে নেমে পড়লাম। সরু এই ক্যানাল টির দুদিকে কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো। ড্যামের দিক থেকে ক্যানাল টি শুরু হয়ে রাস্তার ওপারে চলে গেছে বহু দূরে। ছোট ছোট গাছ গুলো ক্যানাল এর ওপর নুইয়ে পরে এক আলো আঁধারি সৃষ্টি করেছে।

Canal from Massanjore Dam
তীর তীর করে বয়ে চলেছে পরিষ্কার জল। দেখে মনে হলো সেচ দপ্তরের উদ্যোগে মূল ড্যামের থেকে কোনো এক শাখা টেনে এই কৃত্রিম ক্যানাল টি বানানো হয়েছে দূরের চাষের ক্ষেত গুলোকে জল সরবরাহ করার জন্য।
৪:
বাসে করে আসার সময় দেখেছিলাম মাসাঞ্জর বাসস্টপ থেকে আরেকটি রাস্তা একটু নিচ দিয়ে চলে গেছে hydel power স্টেশনের দিকে। হাঁটা লাগলাম সেই রাস্তা বরাবর। Power স্টেশনে ঢোকার কোনো অনুমতি নেই। Power Station এর গেট এর কাছেই রয়েছে ড্যামের একটি ভিত্তি স্তম্ভ।

Massanjore Hydel Power Station entrance
তাতে লেখা Canada Dam। হ্যাঁ। মাসাঞ্জর ড্যাম টি ক্যানাডার ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা নির্মিত বলে এই ড্যাম কে ক্যানাডা ড্যাম ও বলা হয়। এই ভিত্তি স্তম্ভ তে আসার আগেই, বাঁ হাতে একটি রাস্তা চলে গেছে ময়ূরাক্ষী নদী অব্দি। এইবার সেই রাস্তাটি দিয়ে এগোতে থাকলাম। ডান হাতে বিশাল খোলা ময়দান, পিকনিক করার ব্যবস্থা করা আছে এই জায়গায়। রাস্তার দুপাশে অজস্র চড়াই পাখির ঝাঁক। সামনে দূরে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর।

Road towards Massanjore dam through some village huts
এই ঘরটি ছাড়িয়ে মোরামের রাস্তা এগিয়ে গেছে একেবারে নদী অব্দি। পায়ে পায়ে চলে এলাম ময়ূরাক্ষীর পারে। এদিক দিয়ে অবশ্য নদীতে নামা বিপজ্জনক, খাড়াই কংক্রিট এর পার। বাঁ দিকে যতদূর চোখ যায় দেখলাম এঁকেবেঁকে ময়ূরাক্ষীর বয়ে চলা।

Mayurakshi river

Mayurakshi river from the dam
ডান দিকে কে যেন নদীটিকে কংক্রিটের লম্বা বাক্স ফেলে আটকে দিয়েছে, সেই বাক্সের কয়েকটা জায়গা থেকে পেট ফুঁড়ে জল এসে পড়ছে নদীতে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। এই বাক্সই হলো ব্যারাজ। আর তার পেটে কয়েকটি লক গেট। সূর্য তখন পাটে যাবার সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। অতএব আর দেরি নয়। হন্তদন্ত হয়ে হাঁটা লাগলাম ড্যামের প্রধান ফটকের দিকে।

Bridge of the Massanjore Dam connecting to Jharkhand on the other side
ড্যামের ওপর দিয়ে চওড়া রাস্তা ময়ূরাক্ষীর বুক চিরে গিয়ে মিশেছে ওপারের পাহাড় গুলোতে। এপার টা ঝাড়খণ্ডে পড়লেও, ওপার টা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ। সুবিশাল হ্রদ টিকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে আছে একের পর এক পাহাড়। ওই পাহাড়গুলোর কোনো একটার ওপরেই যেন সূর্যের নিজস্ব আস্তানা। সারাদিনের কাজের শেষে এখন যেন তার ওই নিজস্ব আস্তানাটিতে ফেরার দিকেই মন। একটু একটু করে নেমে আসছেন তিনি তার আস্তানায়। প্রতিটি মুহূর্তে একেকটি নতুন রঙের সৃষ্টি হচ্ছে আকাশ ভরে। আকাশে হালকা মেঘ থাকাতে আরো যেন জমে উঠেছে এই রঙের খেলা। দিগন্ত বিস্তৃত ক্যানভাস এ তুলির টানে কখনো হলদে, কখনো বেগুনি, কখনো নীল আবার কখনো গাঢ় লালের প্রলেপ। ইচ্ছেমতন নিজের মনের সাতটি রং তুলিতে নিয়ে যা খুশি তাই করে যাচ্ছে কোনো এক লাগামছাড়া, আত্মভোলা, নিত্যানন্দ শিল্পী। নাম না জানা এই অলীক শিল্পীর সাথে তাল মিলিয়ে মেঘের আড়াল থেকে লুকোচুরি খেলে চলেছে সূর্য। এই মহাজাগতিক রঙের খেলায় থেমে থাকেনি হৃদের জলও। ক্যানভাস এর রঙের সাথে পাল্লা দিয়ে সেও এঁকে চলেছে তাঁর জলছবি, ধার করা রঙগুলো নিয়ে। রঙের এই উৎসবের মাঝেই কখন যে সূর্য পাহাড়ের ফাঁকে তার আস্তানায় চলে গেল, টেরই পেলাম না।

Sunset at Massanjore dam lake

Massanjore Lake just after sunset
ড্যাম এ আসার লজের পাশে সেই জায়গাটাতে ব্লু হওয়ার এর একটা ছবি মনে মনে এঁকে রেখেছিলাম, তাই আর দেরী না করে লজের দিকে পা বাড়ালাম। এবারেও যথারীতি আমি ট্রাইপড ক্যারি করিনি, অগত্যা তাই সেই সরু ব্রিজটার কংক্রিট এর রেলিং এরই সাহায্য নিলাম ১৫ সেকেন্ডের এক্সপোজারের জন্য। ঘন্টা খানেক আগে এই সেতুটির যে রূপ ছিল, তা এখন বদলে গিয়ে পরিণত হয়েছে এক মায়াবী পরিবেশে। দূরে দেখা যাচ্ছে আরেকটি সাঁকো হ্রদের মাঝ বরাবর অব্দি এসে শেষ হয়েছে। তারও পেছনে ফুটে উঠেছে দূরের পাহাড় শ্রেণী। বিশ্ব চরাচর যেন এক নীলচে আভায় ভেসে গেছে।

Massanjore Dam at blue hour
হ্রদের শান্ত স্নিগ্ধ জলে সেই নীল, আমাকে নিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল নীল নির্জনে।
৫:
আজ দ্বিতীয় দিন। বুকিং করা আছে বক্রেস্বর ইয়ুথ হোস্টেল। শ্যামলাল কে বিদায় জানিয়ে সকাল ৮.৩০ তে বেরিয়ে পড়লাম। বড় রাস্তায় এসে একটু এগোলেই দুপাশে ছোট ছোট কিছু আদিবাসী গ্রাম চোখে পরে। বাস না আসা অব্দি একটি গ্রামে ঢুকে কিছু ছবি নিলাম।

Children playing in the waters

Farmers going to their work

Child at tribal village at Massanjore

Primitive equipment used to grind rice at tribal village

Tribal village at Massanjore
দুমকা থেকে সিউড়ি যাওয়ার বাসটি ফাঁকাই ছিল। ১০.১৫ টা নাগাদ সিউড়ি নেমে চা খেতে খেতে খোঁজ নিলাম ওখানকার সোনাতোর পাড়ার বহু প্রাচীন টেরাকোটার দামোদর মন্দির যাওয়ার রাস্তাটি কোনদিকে। চা ওয়ালা নিজেই উদ্যোগ নিয়ে একটি রিকশাওয়ালা কে ডেকে বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে যেতে হবে মন্দিরে। সিউড়ি বাস স্ট্যান্ডের খুবই কাছে এই মন্দির।

Sonator terracotta temple
এই মন্দিরে আজ আর কোনো বিগ্রহ নেই ঠিকই, তবে টেরাকোটার কাজ গুলো আজও অটুট। ফিরে এসে বক্রেস্বর এর বাস ধরলাম। প্রায় ১২.৩০ নাগাদ বক্রেস্বর পৌঁছলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম ইয়ুথ হোস্টেল একটু দূর আছে, মন্দির চত্বরে নয়। টোটোর টিকিটিও দেখলাম না। অগত্যা একটি মারুতি অম্নি ভাড়া করেই পৌঁছাতে হল ইয়ুথ হোস্টেল। সামনে এবং আশপাশে ধূধূ মাঠ। ড্রাইভারের মোবাইল নং টা নিয়ে রাখলাম পরের দিন ঘোরার ব্যাপারটা ফোনে কথা বলে নেব পরে। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে দেখি লজের সবকটি দরজায় তালা ঝুলছে। যেন মাসাঞ্জরের রিপিট টেলিকাস্ট। তফাৎ একটাই, এইখানে দরজার ওপর একটি কাগজে ফোন নং লেখা কেয়ারটেকার এর। যাইহোক, ফোন করায় সে কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে এসে আমায় ঘর দেখিয়ে দিলো। একটু অস্বস্তিও লাগছে মনে মনে। এত বিশাল একটি লজ, তার একতলা দোতলা নিয়ে আমিই একমাত্র অতিথি। দুপুরের খাওয়া বক্রেস্বর নেমেই সেরে নিয়েছিলাম, তাই এই বেলায় আর ওই ঝঞ্ঝাট নেই। ছেলেটিকে রাত্রের খাবার কি খাব আর কখন খাবো আগে থেকেই বলে দিলাম। আমাকে গুছিয়ে দিয়ে সে বেরিয়ে গেল, একেবারে রাত্রেই আসবে। দুপুরটা ঘরেই রেস্ট নিয়ে কাটালাম কারণ পরেরদিন আমার হাতে যথেষ্ট সময়। রাত্রে সেই ড্রাইভারের সাথে কথা বলে তাকে কনফার্ম করে দিলাম পরের দিন সকাল ৯টায় বেরুবো।
৬:
পরদিন সকালে যথাসময় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বক্রেস্বর উষ্ণ প্রসবন এবং মন্দির ঘুরে ঘুরে দেখলাম। স্নান করার জন্য পুরুষ এবং মহিলাদের আলাদা ঘেরাও জায়গা আছে।

Bakreswar Hot Water Spring
তবে উষ্ণ প্রসবন শুধু এই স্নানের জায়গায় নয়, আশপাশে জলাশয় গুলোতেও এর তাপ অনুভব করা যায়। স্নানের জায়গাটি ছাড়িয়ে মন্দিরের দিকে যাওয়ার সময় দুটি ছোট জলাশয়য় দেখলাম ওপরে লোহার জাল দিয়ে ঘেরা। রীতিমত ধোঁয়া উঠছে জল থেকে। প্রচুর পরিমানে হীলিয়াম্ গ্যাসের উদ্ভব হয় এই জল থেকে প্রাকৃতিক নিয়মেই। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই হীলিয়াম্ কালেক্ট করে সিলিন্ডার এ ভরে বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়।

Helium getting produced from the hot water spring of Bakreswar

Crematorium attached to Bakreswar temple

Shiva at Bakreswar temple

Inside of Bakreswar Temple

Bakreswar 51 peeth temple
৫১ পিঠের একটি হলো এই মন্দিরটি। মন্দির থেকে বেরিয়ে কাছেই শ্মশান। মন্দির দর্শন সেরে গাড়ি নিয়ে চললাম ১১ কিমি দূরে দুবরাজপুর এ অবস্থিত মামা ভাগ্নে পাহাড়ের দিকে। পথে বক্রেস্বর নদীর ওপর একটি কালভার্ট এ দাঁড়িয়ে কিছু ছবি নিলাম।

Bakreswar River
মামা ভাগ্নে পাহাড়ের দিকে হাঁটার সময় প্রথমে পড়ল পাহাড়েশ্বর মন্দির। এই মন্দিরে বিগ্রহ বলতে পাহাড়ের একটি খন্ড বা ঢিবি। সুন্দর করে মার্বেল দিয়ে বাঁধানো এই খন্ডের চারিদিক। ইনিই পাহাড়েশ্বর। ধবধবে সাদা এই মন্দির, ওপরটা লম্বা চোঙা আকৃতির।

Stone shrine projecting out at Pahareswar Temple

Pahareswar Temple
কখন যে রোদ উধাও হয়ে গিয়ে বাইরেটা ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে, মন্দিরের ভেতর থেকে টেরই পাইনি। দেখতে দেখতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। অগত্যা বৃষ্টি থামা অব্দি মন্দিরের ভেতরেই আশ্রয় নিলাম। কিছুক্ষন পর বৃষ্টি থামলেও, আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা রয়েই গেল। এতে অবশ্য আখেরে লাভই হলো আমার। সদ্য বৃষ্টি স্নাত সবুজের রূপ আর পাহাড়ের পেছনে কালো মেঘের বাকড্রপ , বৃষ্টির দৌলতে এই দুটো আমার উপরি পাওনা। মন্দিরের পাশ দিয়েই পাথুরে সিঁড়ি উঠে গেছে মামা ভাগ্নে পাহাড়ের দিকে।

Trek route to Mama Bhagne hill
বীরভূমের এই অংশে এরকম পাথুরে পাহাড় আর তাও আবার শহরের মধ্যেই, ভাবতেও বেশ অবাক লাগে। সিঁড়ি বেয়ে বেশ কিছুটা উঠে মাম ভাগ্নের রূপ দেখে মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে গেলাম। চারপাশে বিশালাকার পাথর, একটির মাথায় আরেকটি। প্রতিটি পাথরের অবস্থান এবং আকার যেন একেকটি ভাস্কর্য। চোখ আটকে গেলো এর মধ্যে সবথেকে লম্বা পাথরটায়। লম্বা পাথরটির মাথায় একটি ছোট পাথর এমনভাবে বসানো, পুরো অবয়ব টা দেখে মনে হচ্ছে কোনো এক মহা মানব বুক চিতিয়ে সটান দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। সবুজে মোরা বসন তার। কালো মেঘের আস্তরণ ভেঙে যেন সোজা পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে এই অতি মানব!!

Kali temple at Mama Bhagne hill

Mama Bhagne hill
সময়ের অভাবে আর বেশি এগোলাম না। পাথরের ওপর কালী মন্দিরটি দেখে নেমে এলাম নিচে। এইবার চললাম হেতমপুর রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে। রাজবাড়ি পৌঁছে অবশ্য একটু বিষন্নই হলাম, কারণ রাজবাড়ি এখন একটি কলেজ এ পরিণত হয়েছে। যা দেখার বাইরে থেকেই দেখতে হলো।

Hetampur Rajbari ( now transformed to school )
তবু আজ রবিবার এবং কলেজ বন্ধ, তাই এই সুযোগটি পেলাম, নাহলে হয়তো গেট থেকেই বিদায় নিতে হত। ড্রাইভার সাহেব আমাকে দুবরাজপুর স্টেশন এই নামালেন হুল এক্সপ্রেস ধরার জন্য। দুদিনের সফর টাকে ফ্ল্যাশব্যাকে রেওইন্ড করতে করতে ফিরে চললাম বাড়ির পথে।
© Arijit Kar

Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.