Simultala Hill Station
শিমুলতলার আকুলতায়
১:
আমার আর কল্লোলের ভুতচর্চা অষ্টম শ্রেণী থেকে শুরু। তবে চর্চা বলতে ওই কোচিং ক্লাস থেকে হঠাৎ পাওয়া ছুটি গুলোতে সন্ধ্যেবেলায় নিমতলা শ্মশানে গিয়ে জ্বলন্ত চুল্লির ধোঁয়ায় আত্মার খোঁজ বা বাগমারী কবরস্থানের দারোয়ানের চোখ এড়িয়ে ছোট লোহার গেটটা দিয়ে গলে কোনো একটি কবরের পাশে বসে ভুতের অপেক্ষা অথবা অন্ধকার ঘরে মোম জ্বালিয়ে সাদা কাগজে অক্ষর ও সংখ্যা লিখে দুই বন্ধুতে আলতো করে পেন্সিলের মাথাটা ধরে প্ল্যানচ্যাটে বসা…এসবের মধ্যেই সীমিত ছিলো। ভুলটা করে ফেলেছিলাম পাশাপাশি প্রবীর ঘোষ মহাশয়ের “অলৌকিক নয় লৌকিক” আর আত্ম সম্মোহনের কিছু বই ঘাঁটাঘাঁটি করে। যুক্তিবাদীদের ধাক্কায় আমাদের ভেতরকার অযৌক্তি তখন মৃতপ্রায়। মাথার পোকাটা আবার নড়ে বসলো সিটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় অয়নাংশুর সংস্পর্শে এসে। কথাবার্তায় মনে হলো ছেলেটা ভুত বিশারদ। অনেক জায়গা তার ঘোরা। শিমুলতলায় ওদের একটি বাড়ি ছিলো। ১৯৯৫ সালের শিমুলতলা তখন অনেকটাই ফাঁকা ফাঁকা। ওদের বাড়ির পাশেই ছিলো রুখসুক্ষ একটি বড় মাঠ আর সেই মাঠের এক কোনে একটি অশ্বথ গাছ। কথিত ছিল বেশ কিছু গ্রামবাসী নাকি ওই গাছের ডালে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিলো। সেবছর অয়নাংশুর শিমুলতলা গিয়ে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো। তিন দিন ছিলো ওইখানে। গ্রাম থেকেই দুটি লোককে পেয়েছিল, একজন রান্নার লোক আর একজন বাজারহাট থেকে শুরু করে ঘরের অন্যান্য কাজ গুলো করে দেওয়ার জন্য। রফা হলো পরে দুজনকেই একটা থোক টাকা হাতে ধরে দেওয়া হবে। ঘটনাটা ঘটলো ওদের ফিরে আসার দিন। না রান্নার লোক না অন্যজনের কোনো পাত্তা। এদিকে অয়নাংশুর বাবার মতো সৎ লোক মেলা ভার। টাকা না দিয়ে তো আর উনি ফিরতে পারেন না। অগত্যা দূরের গ্রামে খোঁজ করা হলো। নাম আর চেহারার বিবরণ শুনে জানা গেল দু বছর আগে এই দুটি লোক ওই অশ্বথ গাছের সব থেকে উচুঁ ডালটি থেকে ঝুলে আত্মাহুতি দিয়েছেন! গল্প হোক বা ঘটনা হোক, কেন জানিনা শোনার পর থেকেই এই শিমুলতলা নামটি অবচেতন মনে গেঁথে গেল আমার। তবে বিভিন্ন পারিপার্শিক কারণে, শিমুলতলা আর আমার গিয়ে ওঠা হলো না।
২:
সেই ১৯৯৫ থেকে আজ ২৫শে নভেম্বর ২০১৭। এরমধ্যে অবচেতনায় শিমুলতলা বেশ কয়েকবার এসেছে আমার কাছে কিছু টুকরো টুকরো ছবি হয়ে। কখনো সে ধূধূ প্রান্তরে একলা দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট একটি শিব মন্দির, কখনো সে উচুঁ নিচু মালভূমিতে কয়েকটি তাল বা খেজুর গাছ, কখনো সে বড় মাঠের এক কোনায় একটি মাত্র গাছ, কখনো সে বাঙালী বাবুদের হাওয়া পরিবর্তনের জন্য বহু পুরোনো হয়ে যাওয়া গোল বারান্দা এবং বাগান ওয়ালা কোনো এক বাড়ি অথবা কখনো সে পরিত্যক্ত জীর্ণ অর্ধেক ভেঙে পড়া একটি বাড়ি। এই টুকরো টুকরো ছবিগুলোকে জোড়া লাগানোর সুযোগটা এসে গেল অফিসের তিন বন্ধুকে নিয়ে। ভোর ৪.৩০ তে বাঘ এক্সপ্রেস আমাদের চারজনকে শিমুলতলা Simultala Station নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। মায়ের দেওয়া শালটির যে এত প্রয়োজন হবে তা কোলকাতায় বসে বুঝিনি। সোয়েটার এর ওপরে শাল চাপিয়েও তখন দাঁতে দাঁত ঘষছি। প্লাটফর্মের পাশেই এক জায়গায় দেখি তিনজন বসে আগুন পোহাচ্ছে।

Outside the station
চারজনই গিয়ে নিজেদের সেঁকতে লাগলাম। ধরে যেন প্রাণ এলো। এরই মধ্যে হঠাৎ বাংলায় উড়ে আসা “আপনারা কোথায় যাবেন?” প্রশ্নটিকে লীনা কপাৎ করে ধরে আমাদের শিমুলতলা অভিযান শুরুর ফিতে টা কেটে ফেললো। প্রশ্নকর্তা অটো চালক, রাজকুমার যাদব। ইনিও আমাদেরই সঙ্গে আগুন পোহাচ্ছিলেন।
৩:
সকাল সাতটার আগে ঘর খোঁজার কোন মানে হয়না। লীনাই রাজকুমারজির সাথে কথা বলে ঠিক করলো সময়ের সদ্ব্যবহারের জন্য প্রথমে আমরা যাবো ১৭ কিমি দূরের ধারারা ফলসে। ততক্ষনে আলোও ফুটে যাবে। ধারারা দেখে আমরা যাবো ছাতি পাহাড়। ফিরে এসে আমরা ঘর খুঁজবো রাজকুমারজির সাথে। আমি, লীনা, বিদিশা পেছনের সিটে এবং বাহুবলী স্নেহাংশু নিজেই বুক চিতিয়ে সামনের সিটে। আমাদের ৪জন কে নিয়ে রাজকুমার তাঁর রথ নিয়ে স্টেশনটিকে একটি চক্কর মেরে স্টেশনের সামনের দিকে একটি চায়ের দোকানে এসে দাঁড়ালো। এক ভাঁড় চা ওই কনকনে ঠান্ডায় তখন আমাদের কাছে যেন লাইফ সেভার।

Simultala Tea Stall near station
সকলেই দু ভাঁড় করে খেয়ে রওনা দিলাম ধারারার পথে। কিছুটা এগোতেই স্টেশন চত্বরের থেকে উপচে আসা ক্ষীণ ফ্লুরোসেন্ট আলোগুলো ফিকে হতে হতে একেবারে মিলিয়ে গেলো। আর তার সাথে সাথেই দুই ভাঁড় চা থেকে পাওয়া উষ্ণতাও ফিকে হয়ে এলো। শাল আর মাফলারে আপাদমস্তক মুড়ে নেবার পরেও শরীরের যেটুকুনি অংশ বাইরে থেকে গেছে, সেটুকুনি ঠাণ্ডার কামড়ে যেন অসার হওয়ার জোগাড় আমার। নিকশ কালো অন্ধকার চিরে এগোতে থাকলাম। অটোর দুলুনি আর ঝাঁকুনি থেকে বুঝলাম আমরা গ্রামের আধা পাকা রাস্তা ধরেছি। ছলকে পড়া হেডলইটের আলোতে চোখে পড়লো প্রায় ভেঙ্গে পড়া জীর্ণ একটি বাড়ি। প্রায় একসাথেই আমাদের মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এলো “এটাই কি সেইটা?” লীনা উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেসই করে ফেললো, “আচ্ছা ইঁয়াহ পে ভুত রেহতা হ্যান?” “ভুত কাঁহা রাহেগা দিদি, আদমি রেহানে কা জাগা নেহি হ্যান।”, রাজকুমারজির খেঁকখেঁকে হাসি ভরা উত্তরটি আমাদের কারুরই ঠিক মনঃপুত হলোনা। গোঁ গোঁ করে গত আধঘন্টা ধরে ছুটে চলেছে আমাদের রথ গ্রামীন বিহার দিয়ে। একটা জায়গায় দেখলাম একটি কুঁড়ে ঘরের সামনে এক মহিলা ও একটি বাচ্ছা আগুন পোহাচ্ছে, মনে ধরলো আলো আঁধারির এই ফ্রেম টা। রাজকুমারজিকে দাঁড় করিয়ে লেন্স বন্দি করলাম দৃশ্য টা।

Woman Burning Fire beside the road
আবার চলার শুরু। আরো আধঘন্টা পরে ধীরে ধীরে আলো ফুটতে শুরু করেছে। সদ্য ঘুমভাঙ্গা শিমুলতলা সেই প্রথম আলোয় আমাদের সামনে তার দিগন্ত বিস্তৃত মালভূমি মেলে ধরে নিজের প্রাকৃতিক ভান্ডারের প্রথম পরিচয় দিলো।
৪:
হালকা কিছুটা চড়াই উঠে একটি সুবিশাল চওড়া ঢিবির ওপর অটো থামলো। রুক্ষশুষ্ক নেড়া এই প্রান্তর দুধারে গাছ দিয়ে ঘেরা, যেন কেউ সুন্দর করে শাল পিয়াল দিয়ে বেড়া বানিয়ে রেখেছে। ডানদিকের প্রান্তে একটি কংক্রিটের কাঠামো, এটি কি ছিলো তা এখন আর বোঝার কোনো উপায় নেই।

Construction Over Plateau At Dharara

Temple On Plateau at Dharara
অপর প্রান্তে একটি শিবলিঙ্গ এবং একটি মন্দির। সামনে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা জঙ্গলের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে নিচে ধারারা ফলস এ নামার রাস্তা। অটো থেকে নেমেই খেয়াল করেছিলাম কলকল করে জলের আওয়াজ এদিকটা থেকে। স্নেহাংশু দেখলাম ক্যামেরা নিয়ে বিভিন্ন angle এ মন্দিরটাকে গুলে খেতে লাগলো। আমার আর তর সইলো না। আকাশের কোনে লালচে আভা জানান দিচ্ছে সূর্যোদয়ের আর বেশি দেরী নেই। ধারারার জলে দিনের সেই প্রথম আলোকে খেলতে দেখার লোভ টা সংবরণ করতে না পেরে সটান নামতে লাগলাম জলের আওয়াজ যেদিক থেকে আসছে সেদিকে। একটু নামতেই পেয়ে গেলাম ধারারার দেখা। তবে এটিকে ফলস না বলে নদী বলাই ভালো। শিমুলতলার ধরিত্রী দিয়ে বয়ে চলা তেলবা নদী ছোটনাগপুর মালভূমির এই পাথুরে খাঁজে এসে আছড়ে পড়ে, উঁচু উঁচু সাদা, হলুদ, কালচে নীল বোল্ডার গুলোতে ধাক্কা খেতে খেতে ধারারার এই বিস্ময়কর মনমোহিনী উপত্যকার সৃষ্টি করেছে।

Simultala Dharara River and Falls

Dharara Fall just before sunrise

Simultala Dharara Fall Levelels

Simultala Dharara Crystal Clear Water
নদীতে এখন হাঁটু জল। এতটাই স্বচ্ছ সেই জল, নিচের সমস্ত নুড়ি পাথর পরিষ্কার ভাবে দৃশ্যমান। পাথরের ওপর থেকে দু তিনটি স্তরে বা ধারায় নদীটি নেমেছে। কোলকাতাতেই দেখেছি নদীর নাম শুনলেই লীনা কেমন জানি আহ্লাদে গদগদ হয়ে যায়। আর এইখানে তো জলপ্রপাতের ন্যায় আস্ত একটি নদী ওর চোখের সামনে। আর পায় কে! জুতো জোড়া দেখি একটা পাথরের ওপরে ছুড়ে দিয়ে তর তর করে ম্যাডাম জলে নেমে হাঁটা লাগালেন নদীর উৎস খুঁজতে! ইতিমধ্যে দেখি স্নেহাংশুও কোন ফাঁকে নেমে এসে ছবি তোলাতে মশগুল হয়ে আছে। বিদিশা দেখলাম একটু এগিয়ে গিয়ে লীনার ওপর নজর রাখছে। বেশ কিছুটা সময় আমরা নিজের নিজের মতো করে আষ্টেপৃষ্টে প্রকৃতির এই নয়নমনোহর সৃষ্টিকে আলিঙ্গন করলাম।
৫:
ওপরে উঠে কিছু ছবি নিয়ে আমরা অগ্রসর হলাম ছাতি পাহাড়ের পথে।

Simultala Dharara Temple Closeup
ধারারার ভালোবাসায় মজে থেকে, সকাল গড়িয়ে তখন প্রায় ৭টা। দিনের আলোতে আমার স্বপ্নের শিমুলতলার টুকরো টুকরো ছবিগুলো একটি একটি করে জোড়া লাগতে শুরু করেছে। ফেলে আসা রুক্ষ প্রান্তরে শিব মন্দির, মালভূমির চড়াই উতরাই ভেঙ্গে এগোনোর সময় এলোমেলো ভাবে অনেকটা দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খেজুর আর তাল গাছ আর শীতের রুক্ষতার সাথে তাল মিলিয়ে শুষ্ক ধূধূ প্রান্তর।

Simultala Plateau region near Dharara Fall

Sun rising over the Silmultala Palm Trees Over Plateau
“এই রোকিয়ে রোকিয়ে”, হঠাৎ লীনার আর্ত চিৎকার। পিলে চমকিয়ে তাকিয়ে দেখি উনি সামনের লালচে ফলের কোনো একটি ঝোপের দিকে “কুদরুম, ওটা কুদরুম” চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড় দিয়েছেন। শব্দটার সাথে আমরা বাকি তিনজনে তখনও পরিচিত নই বা থাকলেও মগজ হাতড়ে বেড়াচ্ছি। অতএব লীনার শরণাপন্ন হয়ে জানলাম কুদরুম ফল দিয়ে চাটনি খাওয়ার মাহাত্য! তবে শব্দ পরিচিতি না থাকলেও সবুজের প্রেক্ষাপটে কুদরুমের সিঁদুর রাঙা সৌন্দর্যকে লেন্স বন্দি করতে আমি ভুলিনি।

Simultala Kudrum Flower Closeuo

Simultala Kudrum Tree In Barren Land
মালভূমি ছেড়ে এবার আমরা গ্রামের রাস্তা ধরলাম। বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামের চালচিত্র আর বেশ কয়েক জোড়া কৌতূহল দৃষ্টির সাক্ষী থেকে পৌঁছে গেলাম ছাতি পাহাড়। উচ্চতায় ছোট টিলার মতন তবে বেস টা অনেকটা চওড়া। এক চিলতে নাম না জানা ঝোড়া বয়ে চলেছে পাহাড়ের নিচ দিয়ে আর সেই জলে ছাতির প্রতিবিম্ব।

Simultala Chhati Hill from the front

Simultala Chhati Hill with the stream of water
কিন্তু ওকি! শুকিয়ে যাওয়া এপারের কাদামাটির ওপর এ কিসের পায়ের ছাপ? ছাপ গুলো সোজা নদীতে গিয়ে মিশেছে। এত বড় আর গভীর পায়ের ছাপ শুধুমাত্র একজনেরই হতে পারে, আর হ্যাঁ…ঠিক তাই। রাজকুমার কে জিজ্ঞেস করায় মিলে গেল, হাতির পায়ের ছাপ।

Footsteps Of Elephant t Chhati Hill River Bed
৬:
গত সন্ধ্যেবেলার পর থেকে আজ সকালের চা বিস্কুট ছাড়া পেটে কিছু পড়েনি। ভোররাতের শীতের কামড়ের ঘায়ে হোক বা মালভূমি অভিযানের আনন্দে হোক এতক্ষন খিদেটা টের পাইনি বা ভুলে ছিলাম। এইবার আর না হলেই নয়। রাজকুমারজিকে বলাতে আমাদের নিয়ে এলো স্টেশনের পাশেই বাবলু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। বাবলু দা সবে তখন গরম তেলে কচুরী ছাড়ছে।

Hot Kachori At Bablu Mistanna Bhandar

Simultala Bablu Da
শালপাতা দিয়ে বানানো সুন্দর বাটিতে গরম কচুরী আর ছোলার তরকারি খেতে খেতে বিদিশার প্রশ্ন, “এর পরে আমরা ঘর খুঁজতে বেরুবো তো?” উত্তরে পাল্টা প্রশ্নটা এলো বাংলায় বাবলুদার থেকে, “আপনারা কি ঘর বুক করে নিয়েছেন?” স্নেহাংশু আগেই রাজকুমারজিকে বলে রেখেছিল তিন চারটি থাকার জায়গা আমাদের দেখতে, তার মধ্যে যেটা পছন্দ হবে আমারা সেটাতে থাকবো। “আমরা একটু পুরোনো বাড়িতে থাকবো যেখানে ভুত দেখা যেতে পারে”, বিদিশা বলে উঠলো। শুনে বাবলুদা এমন ভাব করলো যেন তার চোদ্দ পুরুষের কেউ কখনো ভুত নামক বস্তুটির কথা শোনেনি। তবে ঘর সম্বন্ধে আমাদের চাহিদা টা বুঝে বাবলুদা এবং রাজকুমারজি দুজনেই “যশোদা ভবন” এর নাম নিলো। মিনিট পাঁচেকেই রাজকুমারজির অটোতে করে হাজির হলাম যশোদা ভবনের সামনে।

Simultala To Yashoda Bhavan
উচুঁ কালো লোহার গেট থেকেই বাড়িটি দেখে আমার পছন্দ হলো। গেট থেকে দুধারে বাগানের মধ্যে দিয়ে নুড়ি পাথরের রাস্তা গিয়ে শেষ হয়েছে বাড়িটির চওড়া বারান্দার রকে। রাস্তাটির দুপাশে সার দেওয়া ঝাউ গাছ। লাল আর হলুদ রঙের বিশালাকার বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে ইয়া মোটা মোটা থামের ওপর।

Simultala Yashoda Bhavanfrom from gate

Simultala Yashoda Bhavan View

The wide veranda at Yashoda Bhavan
আমার স্বপ্নে আসা শিমুলতলার পুরোনো বাঙালি বাবুদের বাগানবাড়ির ছবিটির সাথে হুবহু মিল এই যশোদা ভবনের। রাজকুমার এর ডাকে কেয়ারটেকার বজরঙ্গী বেরিয়ে এসে আমাদের দুটি ঘর দেখালো। ৪০০ টাকা ঘর ভাড়া। ভেতরের ঘরটা লীনা আর বিদিশা কে দিয়ে আমি আর স্নেহাংশু বাইরের দিকের টা নিলাম। পাশাপাশি দুটি ঘর বাঁ অর্ধে, আবার ঠিক ওরকমই দুটো ঘর ডান অর্ধে। বিশাল উঁচু করিবরগার ছাদ। ঘরে টিভি থেকে শুরু করে ছোট সোফা এবং যাবতীয় প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সবই আছে। আমাদের ঘরের লাগোয়া একটি প্যাসেজ। সেখানেই আলাদা ভাবে স্নানঘর এবং টয়লেট। জলের কোনো সমস্যা নেই। গিজার না থাকলেও বালতিতে গরম জল চাইলেই পাওয়া যাবে। সামনের বারান্দাটা এতটাই চওড়া যে আরামসে ওখানে আরও ৪-৫ টি ঘর এঁটে যাবে। এই ঢালাও বারান্দা বাড়ির পুরো সামনের দিকটাকে ঘিরে আছে। আমাদের ঘর গুলোর পেছনদিকেও ঢালাও বারান্দা নেমেছে উঠোনে। এই বারান্দাটির এক প্রান্তে ছাদে ওঠার সিঁড়ি। উঠোন পেরিয়েই বেশ কয়েক বিঘা জমির ওপর বড় বড় গাছের মিনি অরণ্য।

Huge Pillars Of Yashoda Bhavan

Huge mango tree garden at the backyard of Yashoda Bhavan

Huge windows of Yashoda Bhavan at Simultala
সামনে পেছনে চওড়া বারান্দার জন্য ঘরগুলোর অবস্থান এমন যে জানালাগুলো সব বারান্দার দিকেই, অতএব রোদের আলো বিশেষ পৌঁছয়না ঘরের ভেতরে। সব মিলিয়ে প্রাচুর্যের সাথে আদিমতার এক দুর্ধর্ষ মেল বন্ধন বাড়িটিতে। খাওয়া দাওয়ার বন্দোবস্ত টা বাবলুদার মারফৎই করতে হলো, কারণ এখানে সেই ব্যবস্থা নেই। ফ্রেশ হয়ে ৪ জন মিলে বারান্দায় চেয়ারে এসে বসলাম। শীতের দুপুরের মেজাজে বারান্দায় উপচে আসা রোদ্দুরে শরীর ও মন এলিয়ে দিয়ে আড্ডায় মশগুল হয়ে কখন যে ঘড়ির কাঁটা ২টয় পৌঁছে গেল টেরই পেলাম না। মাঝখানে “শিমুলতলার ভুত” নিয়ে বজরঙ্গীর একটা ইন্টারভিউ ভিডিও করার চেষ্টা করলো বটে স্নেহাংশু তবে বিশেষ ফলপ্রুত হলো না। অতএব ভুতের ব্যাপারটা রাত্রের জন্যই ছেড়ে রাখলাম। ইতিমধ্যে ভাত, ডাল, পেঁয়াজ, আলুভাজা, সবজি এবং কষা মাংসের ঝোল নিয়ে উপস্থিত বাবলু দা। “যাহ! লেবু দেয়নি তো”, লীনার আর্তনাদে সারা দিয়ে স্নেহাংশু দেখি একলাফে বাগান থেকে একটি পাতি লেবু পেড়ে এনে ছুরির খোঁজ করছে। ছুরি চালাতেই স্নেহাংশুর বিমর্ষ অভিব্যক্তি, “যাহ শালা। এতো কমলালেবু!” সত্যি, এত ছোট আকারের সবুজ কমলা লেবু এর আগে দেখিনি।
৭:
শীতের বেলা ছোট। বেশি দেরী না করে বেরিয়ে পড়লাম লাট্টু পাহাড়ের পথে যাতে সূর্যাস্ত টা ফসকে না যায়। রাজকুমারজিকে আগেই বলে রেখেছিলো লীনা ৩.৩০ নাগাদ আসতে। মিনিট ১৫ চলার পরেই আবার সেই ধূধূ প্রান্তর আর কাঁচা রাস্তা শুরু। একটু দূর থেকেই চোখে পড়লো পুরোনো রাজবাড়ি। আর তার ঠিক অপর দিকে লাট্টু পাহাড়। শেষ বেলার নরম আলোয় রাঢ় বিহারের এক প্রান্তে এই হলদে বরণ রাজবাড়িটি যেন এক মায়াবী দুনিয়ার সাক্ষী। রাজবাড়িটির বিশেষত্ব হলো সামনে দিয়ে সিঁড়ি সোজা উঠে গেছে একেবারে দোতলায়। বাইরের কাঠামো টা এখনো সটান দাঁড়িয়ে থাকলেও, ভেতরটার প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই।

Simultala Fort view from one side

Simultala Fort

Inside the Simultala Fort its only the ruins
রাজবাড়ির আদি নাম নলডাঙ্গা রাজবাড়ি। রাজবাড়ির ১কিমি ব্যাসার্ধে কোনো বাড়িঘর নেই। উল্টোদিকে প্রায় ঢিল ছোড়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে লাট্টু পাহাড়। এই নির্জন উপত্যকায় যেন অনন্তকাল ধরে নিরন্তর ফিসফিসিয়ে কথা বলে চলেছে পাহাড়ের সাথে এই রাজবাড়ি। সূর্য অস্তাচলে পুরোপুরি ঢলে পড়ার আগেই আমরা পা বাড়ালাম লাট্টু পাহাড়ের দিকে। লাল মাটির পাহাড়টি তখন আরও রক্তিম সূর্যের রাঙা আভায়। মিনিট ৭একে আমি একেবারে টঙে মন্দিরের দোরগোড়ায়।

Simultala Lattu Hill

Climbing the steps of Simultala Lattu Hill

Birdseye view of Simultala from the top of Lattu Hill

Simultala Fort View from Lattu Hill Top

Sunset view of Simultala from Lattu Hill
শিমুলতলার অনেকটাই দেখা যায় ওপর থেকে। ধূধূ প্রান্তরে একলা রাজবাড়িটি পাহাড়ের ওপর থেকে দেখলে এক অদ্ভুত অনুভুতি যোগায়। ফেরার পথে রাজকুমার একটি অন্য রাস্তা ধরল। কিছুটা এগোতেই ডানহাতে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি দেখে লীনা গাড়ি দাঁড় করালো। বাড়িটি বেশ উঁচু একটা ঢিবির ওপরে। আগাছার জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে উঠে একটু কাছে গিয়ে বুঝলাম, বাড়ির একাংশ ভগ্নপ্রায় হলেও অন্য অংশটায় লোকের বসবাস আছে। পরে পরিচিতি পেলাম এই বাড়িটিই হলো “পাটনা প্যালেস”, যার আজ এই অবস্থা। ভুত আর মানুষের একই বাড়িতে সহাবস্থানের সম্ভাবনা কম, তাই নেমে এসে আবার পথ চলা। দিনের আলো একেবারে ফিকে হয়ে এসে এখন এক নীলচে আভায় ঢেকে দিয়েছে চারিপাশ। রাস্তাটাও কেমন যেন সরু হয়ে এলো এদিকে। পাশের আগাছার ঝোপ গুলোয় ঘষা খেতে খেতে এগোচ্ছি আমরা। হঠাৎ সামনে দেখি আমাদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি। দেওয়ালে সাদা আর লাল রং। হালকা সবুজ রঙের আর্চ করা দরজা জানালা। দরজাটি আজও আস্ত এবং তালা দেওয়া। অথচ জানালাগুলো বেশিরভাগই ভাঙা।

Abandoned House of Simultala While Returning from the fort
চারজনই এগিয়ে গেলাম। আগাছার ঝোপ চারিদিকে ঘিরে আছে বাড়িটিকে তবে অদ্ভুতভাবে সামনের উঠোন টা যেখান থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে দরজা অবধি, সেটি অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার। পরিষ্কার এপ্রোচ ওয়ে, তালা দেওয়া দরজা….তবে কি কারো আনাগোনা আছে এই বাড়িতে? সেকি মানুষ না অন্য কিছু। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমি দরজার কাছে গিয়ে একরকম ঠেলাঠেলিই শুরু করেছিলাম। “অরিজিৎ দা, এই ভর সন্ধ্যে বেলায় এগুলো করা ঠিক নয়। চলো আমরা বেরোই।”, হনুমান চল্লিশা হাতে নিয়ে বিদিশার কাকুতি মিনতি। জায়গাটা আমাদের কারুরই বিশেষ সুবিধের মনে হলো না। বেরিয়ে এলাম। “রামকৃষ্ণ মিশন টা দেখে তবে কিন্তু ফিরবো।” লীনার হুঙ্কারে সারা দিয়ে রাজকুমারজি গাড়ি হাঁকিয়ে যে বাড়িটির সামনে এসে থামলো, তার পাশে একটি মন্দির এবং উল্টাদিকে একটি গোয়ালে কয়েকটি গরু বাঁধা। তবে অনেক ডাকাডাকি সত্বেও কারো সারা শব্দ না পেয়ে ওটাই যে রামকৃষ্ণ মিশন কিনা তা ঠিক বোধগম্য হলো না।
৮:
যশোদা ভবনে ফিরে জমিয়ে আড্ডায় বসার আগে যে অভিজ্ঞতাটা আমার হলো, তার ব্যাখ্যা আজও পাইনি। ফ্রেশ হয়ে স্নানঘর থেকে বেরোনোর সময় ছিটকিনি খুলে দরজায় টান লাগাতেই দেখলাম দরজা খুলছে না। ওপরে তাকিয়ে দেখলাম ছিটকিনিটা লাগানোই আছে। অথচ ২সেকেন্ড আগেই নিজে হাতে ছিটকিনি টা নামিয়েছি পরিষ্কার মনে আছে। গা টা একটু কেমন যেন রীরী করে উঠলো। Illusion… hallucination…নাকি অন্য কিছু? উত্তর আজও পাইনি। বেরিয়ে বাকিদের ঘটনাটা বলাতে দেখলাম লীনা আর বিদিশা একটু ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। আর কথা না বাড়িয়ে আড্ডায় মেতে গেলাম। ইতিমধ্যে লোডশেডডিং। “অরিজিৎ দা, চলোনা রাতের অন্ধকারে শিমুলতলাকে একটু দেখে আসি।” লীনার এই কথায় সকলেই রাজি হয়ে গেলাম। বেরোতে গিয়ে দেখি বাইরের লোহার গেটে তালা পড়ে গেছে। বজরঙ্গী কে বলাতে রীতিমতন ভুরু টুরু কুঁচকে বললো, “ইস অন্ধেরে মেই বাহার ঘুমনা ঠিক নেহি রাহেগা।” “ভাইয়া হুমলগ দূর কাঁহী নেহি জায়েঙ্গে। বাস সিরফ ১০০ মিটার ডাইনে বায়ে করকে ওয়াপাস আ জায়েঙ্গে।” লীনা আশ্বস্ত করলো বজরঙ্গী কে। গেট থেকে বেরিয়ে আমরা বাঁ হাতের মেঠো রাস্তাটি ধরলাম কারণ অন্যদিকে স্টেশনের রাস্তা। কয়েক পা এগোতেই গাঢ় কালো অন্ধকার আমাদের গ্রাস করলো। বিদিশা ইতিমধ্যেই ভয় কুঁই কুঁই করতে শুরু করেছে। সামনে দু ফুট দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছেনা। নিজেরা কথা থামলেই যেন মনে হচ্ছে আমরা চারজন ছাড়াও আরো কেউ আমাদের সাথেই হাঁটছে। যাই অন্ধকার, তাই আসলে ভয়। হঠাৎ দেখি অন্ধকার চিরে একটি মোটরবাইকের জোরালো আলো সোজা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে একটু স্লো করে আরোহী দুজন আমাদের মেপে চলে গেলো। মহিলাদের সাথে নিয়ে আর রিস্ক আমি নিতে পারলাম না। ভূত থাকুক বা না থাকুক, অসামাজিক লোকেদের আনাগোনা সব জায়গাতেই আছে। একরকম জোর করেই সবাইকে টেনে নিয়ে এলাম গেটের ভেতরে। বজরঙ্গীর এক হেল্পর গেটে তালা লাগিয়ে দিলো আমরা ঢুকতেই। হেলেদুলে আমরা এগোচ্ছি ঘরের দিকে। হঠাৎ টের পেলাম গেটের কাছে একটা বাইক এসে দাঁড়ালো। আরোহী দুজনের মুখ মাফলার দিয়ে এমনভাবে ঢাকা, শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। আমরা এগিয়ে গিয়ে খোঁজ করতে বললো, “বজরঙ্গী কাঁহা হে?” “সো গেয়া হোগা।” লীনার এই উত্তরের বিশেষ তোয়াক্কা না করে লোকগুলো লোহার গেট টা ঝাকুনি দিয়ে চিৎকার করেই চললো, “বজরঙ্গী…ওয়ে বজরঙ্গী।” দলের বাকি তিন সদস্যের ভয়ার্ত চাহুনি দেখে আমি ওদের নিয়ে সোজা ঘরে চলে এলাম। কিছুক্ষণ পর বজরঙ্গীর সাথে ওই দুটো লোকের কথা কাটাকাটির আওয়াজ পেলাম। আওয়াজ টা এখন সামনের বারান্দা থেকে আসছে। স্নেহাংশু আর লীনা দেখি ততক্ষণে আমাদের দুটো ঘরের সবকটি দরজা সরেজমিনে তদন্ত করতে শুরু করে দিয়েছে, কোথাও কোনো ফাঁক আছে কিনা। বুকের ভেতর টা আমারও দুরু দুরু করলেও মনে ভরসা ছিল যে ওরা যেই হোক, ট্যুরিষ্ট দের কোনো ক্ষতি করবে না কারণ সেই মতলব থাকলে এতক্ষনে আমাদের ওপর চড়াও হয়ে যেত ওরা। খানিক্ষন পর সব শান্ত হয়ে গেলো। সারাদিনের ক্লান্তির পর, আমরাও ঢলে পড়লাম ঘুমের কোলে।
৯:
সকালে উঠে আমি, লীনা আর বিদিশা ছাদে গিয়ে রোদ পোহতে পোহাতে সেদিনের ট্যুর প্লানিং টা সেরে ফেললাম। স্নেহাংশু তখনও ওঠেনি।

At the terrace of Yashoda Bhavan in the morning
ও এলো বেশ কিছুক্ষণ পর। রাজকুমার কে ৮.৩০ থেকে ফোন করতে করতে “বাস , আ রাহা হে” ছাড়া আর কোনো ফলপ্রসু উত্তর পেলাম না। আমরা তখন রেডি হয়ে রঙ্গন ফুলের ওপর বসে থাকা প্রজাপতির মধু খাওয়া দেখছি আর ঘন ঘন ঘড়ি দেখছি। চাপ একটাই…আজ আমাদের ফেরার ট্রেন Mokama Fast Passanger বিকেল ৩:৫৯ এ, অর্থাৎ সব সেরে আমাদের ৩.৪৫ নাগাদ স্টেশনে ঢুকতেই হবে। ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে একসময় বেরিয়ে হাঁটা লাগলাম স্টেশনের পথে, ওখান থেকে অন্য কোনো অটো ঠিক করে নেবো। এই রাস্তার ওপরেই চোখে পড়লো বেশ কয়েকটি পুরোনো বাগানবাড়ি।

Old House or Baganbari at Simultala

Found this old house while walking from Yashoda Bhavan

Another old house
বেশ কিছুটা হাঁটার পর দেখি রাজকুমারজি গোঁ গোঁ করে অটো নিয়ে ছুটে আসছে। তখন প্রায় ১০টা। বিরক্তির পুরোটাই ওনার উপর উগরে দিয়ে অটোতে বসে বললাম “পেহলে বাবলু কা দুকান চলিয়ে, ভুক লাগা হে বহুত জোরসে।”
১০:
বাবলুর কাছে খবর পেলাম ঝসিডি তে লাইনের কাজ হচ্ছে, বিকেল ৪টা অব্ধি সব ট্রেন বন্ধ। অর্থাৎ কোনোভাবেই আমাদের মোকামা ৪ টায় ঢুকবে না। বাবালুর আন্দাজ ৮টার আগে ঢুকবে না। হাতে অনেকটা সময় বেরিয়ে আসায় যেমন একটু আস্বস্ত হলাম যে ঘোরাঘুরি টা নিয়ে অন্তত আর কোনো চাপ নেই, আবার তেমন বেশি রাত্রে শিমুলতলার মতো নির্জন স্টেশন মহিলাদের জন্য কতটা সেফ হবে সেটা ভেবে একটু মনে খুঁতখুঁত ও রয়ে গেল। যাইহোক, আর দেরী না করে আমরা পারি দিলাম হলদি ঝর্নার পথে। স্টেশন থেকে যশোদা ভবন যাওয়ার পথে একটি চার রাস্তার মোড় পরে, সেইটা থেকে বাঁদিক নিলাম আমরা। কিছুটা এগোতেই বাঁ হাতে এক পোড়ো বাড়ি দেখে হামলে পরে রাজকুমারজিকে থামলাম আমরা। ছোটখাটো একটি মাঠ আর তার একপ্রান্তে ভগ্নপ্রায় একটি বাগান বাড়ি। কাছে যেতেই বাড়ির মাথায় লেখা বাড়িটির নাম স্পষ্ট হলো। “জিও পাগলা”, প্রায় একসাথেই লীনা আর আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। হিন্দী হরফে লেখা ” दुलारी भवन, बनगावाँ सिमुलतला”!!!

At Dulari Bhavan, the haunted house
এই তো সেই…এইতো সেই বহু আলোচিত ইউটিউব মাতানো দুলারী ভবন যা নাকি ভারতবর্ষের অনেকগুলি “Haunted” আখ্যা পাওয়া জায়গার মধ্যে একটি। বাড়িটির সামনের বারান্দার সিঁড়ি আর পেছনের অনেকটাই ধ্বংসাবশেষ। প্রত্যেকটি ফাটল আর ধ্বংসাবশেষ থেকে বেরিয়ে রয়েছে বুনো গাছ, যেন সবুজ এক দৈত্বকায় অক্টোপাস আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে পুরো বাড়িটিকে।

Dulari Bhavan with name plate at the top
আমি আর স্নেহাংশু সিঁড়ির ধ্বংসাবশেষ উপক্রম করে ওঠার সময়ই টের পেলাম বিদিশা ততক্ষনে হনুমান চল্লিশা বের করে আওড়াতে শুরু করেছে। সামনের দিকের দরজাটি তালা বন্ধ। তবে বারান্দা দিয়ে বাঁদিকে এগোতেই দেখি ঘরের জানলার শিক গুলো ভাঙা। জানালার পাশের বাইরের দেওয়ালটিতে বেশ কতগুলো লাল লাল হাতের আর পায়ের ছাপ। তবে প্রাপ্তবয়স্ক হাতের থেকে আকারে অনেক ছোট। অন্তত দিনের আলোয় ওগুলোকে ভুতের হাতের ছাপ বলে কিছুতেই মন মানলো না ( তবে রাতের অন্ধকারে টর্চ বা মোমের আলোতে এই ছাপ হৃৎপিণ্ডের ওপর কি ভয়ানক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তা অনুমান করলাম)। জানালার ভাঙা গরাদ ডিঙ্গিয়ে ততক্ষনে আমরা ভেতরে।

Inside the dark rooms of Dulhari Bhavan

The red marks of hand and foot at the walls of Dulhari Bhavan
মাকড়সার জাল ছড়ানো চারিদিকে। দিনের বেলাতেই এতো অন্ধকার যে ISO প্রায় 1000 অব্ধি তুলতে হলো। বিদিশার হনুমান চল্লিশার ডেসিবেল আরো বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা আপাতত দুলারীর অশরীরীদের বিদায় জানিয়ে রাজকুমারজির শরীরী যানে সওয়ার হলাম। ২ কিমি পিচ রাস্তার পর গ্রামের পথ, আর তাতে উছলে পরা গ্রাম্য জীবন।

Simultala Village scene

A child at a village at Simultala eagerly looking at us
কোথাও বা রাস্তার এক পাশে ধান ঝাড়তে ব্যস্ত পুরুষ, কোথাও বা পথের মাঝে বসে থাকা রোদ পোহানো মহিলা আবার কোথাও অটো দেখে ধেয়ে আসা শিশুর দল…এসবের মধ্যে দিয়ে নিপুন শৈল্পিক ছোঁয়ায় কাটিয়ে তাঁর রথ নিয়ে রাজকুমারজি এসে পড়লেন এক উঁচুনিচু মেঠো রাস্তায়। দুপাশে হলদেটে বুন্দিশ ফুলের ঝোপ এতটাই ঘন যে তার ডালপালা আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে। অবশেষে একটি বাঁক ঘুরতেই, ” এটা কি লাট্টুর ভাই টাট্টু?”-লীনার প্রশ্ন। সামনে একটি পাহাড় দেখা যাচ্ছে বটে তবে নাম লীনার নিজস্ব ভৌগোলিক শব্দকোষ থেকে দেওয়া। আরেকটু এগিয়ে অটো দাঁড় করালো রাজকুমারজি। উঁচু ঢিবি মতন।

Rajkumar ji and his auto on way to Haldi Fall
সামনেই দেখা যাচ্ছে স্বল্পউচ্চ লীনার “টাট্টু পাহাড়” শাল, সেগুন, শিমুল আর পলাশের জঙ্গলে ঢাকা, আর তারই ফাঁক দিয়ে বানানো সরু একচিলতে রাস্তা এঁকেবেঁকে কোথায় জানি হারিয়ে গেছে। বাকিটা পথ পদব্রজে যেতে হবে জানান দিলো রাজকুমারজি। “আপ জাওগে হামারে সাথ?”-লীনার প্রশ্ন। “নেহি। ফির গাড়ি কৌন দেখেগা?”-রাজকুমারজি। দু তিনটে বছর দশেকের বয়সের বাচ্ছা কাছেই খেলছিল। তাদেরকেই রাজকুমারজি বললেন, “আরে এ বাচ্চা! সাহাব লোগো কো বরিয়া সে ঘুমাকে লে আ। খুশ হংগে তো চকলেট কে লিয়ে পাইসা মিলেগা।” বাচ্ছাগুলো শুনেই রাজি হয়ে গেল। ঘন ঝোপঝাড় সরাতে সরাতে সরু দু ফুটের রাস্তা দিয়ে আমাদের নিয়ে এগোতে থাকলো আমাদের হঠাৎ পাওয়া খুদে গাইড সাহিল, আব্দুল আর আফ্রিদি।

Children guiding our way through the forest to Haldi Fall
কয়েকটি জায়গা এতটাই ঘন যে রোদের আলো পৌঁছচ্ছে না। যাত্রাপথে আরও খান দশেক কচি কাঁচা আমাদের সাথে জুড়ে গেল চকোলেট পাবার আশায়…ঠিক যেন সেই পাইড পাইপার এর গল্পের মতন। বেশ খানিকটা হেঁটে পৌঁছলাম একটা ফাঁকা জায়গায়। হঠাৎ যেন এখান থেকে জঙ্গলটা কেউ খাবলা মেরে তুলে নিয়েছে। সামনেই একটা আড়াআড়ি লম্বা গর্ত, যেটা টপকে ওপারে আর কিছুটা গেলেই হলদী ফলস।

A village woman collecting woods from the forest of Haldi Fall
স্নেহাংশু সকালে বেরোনোর সময়ই আবদার রেখেছিলো আমার কাছে যে ওর কিছু ভালো ছবি তুলে দিতে হবে। এই লম্বা ট্রেঞ্চ টা দেখে একটা ছবি মাথায় এলো। ক্যামেরা নিয়ে সঠিক পসিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে স্নেহাংশু কে বললাম দৌড়ে এসে ট্রেঞ্চ টা লাফিয়ে টপকাতে। যথার্থ কিছু ছবি হলো। উপরি পাওনা হলো বাচ্ছাগুলোও আমাদের দেখাদেখি তাদের স্বমহিমায় লম্ফঝম্ফ শুরু করলো আমার লেন্সের সামনে!

Children jumping the trench on way to Haldi Fall
অবশেষে হাজির হলাম হলদী ঝর্নার সামনে। কিন্তু একি!! এতো দেখি নলের সরু জলধারার মতো একচিলতে ধারা বয়ে এসে পড়ছে। এটাই নাকি হলদী ফলস! তবে আশপাশটা দেখে মনে পরে গেল ” The journey itself IS the reward. NOT the destination.” সত্যিই তাই। হলদী ঝর্নার এই সবুজে মোড়া পথটাই যেন এডভেঞ্চারের সমস্ত তৃষ্ণা মিটিয়ে দেয়। তার সাথে উপরি পাওনা এই এক ঝাঁক নিষ্পাপ শৈশব।
১১:
রওনা দিলাম সাকেটিয়া আশ্রমের পথে। যশোদা ভবনের পাশ দিয়েই এগোলাম আমরা সেই রাস্তায়, গতকাল রাতের অন্ধকারে যে রাস্তায় নৈশ ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম। কিছুটা এগিয়ে আবার সেই গ্রামের উঁচুনিচু কাঁচা রাস্তা। একটা নালার সামনে এসে আমাদের নামিয়ে দিয়ে নালার ওপর দিয়েই অটো নিয়ে ওপারে পারিদিলেন রাজকুমার।

Crossing the ditch towards Saketia Ashram
আমি আর স্নেহাংশু হেঁটেই পার হলাম। কিছুদূর গিয়ে রাজকুমারজি অটো রেখে আমাদের নিয়ে হাঁটতে থাকলেন শাল সেগুনের জঙ্গল দিয়ে। দূরে দূরে ছড়িয়ে থাকা কিছু বাড়িঘর, গ্রামবাসীদের মাথায় করে ডালপালা নিয়ে যাওয়া আর ছবির মতো সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে উপস্থিত হলাম একটি পুরোনো দোতলা বাড়ির সামনে।

This ditch to be crossed on way to Saketia Ashram

Village children also collecting woods from the forest near Saketia Ashram
বাড়িটির সবকটি দরজা বন্ধ…অনেকটা ছোটখাট স্কুলবাড়ির মতো দেখতে। এটাই নাকি সাকেটিয়া আশ্রম। জনমানবের লেশ মাত্র নেই বাড়িটিতে।কথিত আছে এই আশ্রম এবং তার পার্শবর্তী অঞ্চল গুলো একসময় মাওবাদী অধ্যূষিত এলাকা ছিল। রাজকুমারজির ফিসফিসানি আর বারংবার “ঔর কুছ তো হে নেহি ইঁহা পে” শুনে বুঝলাম এই জায়গাটির ব্যাপারে স্থানীয় লোকেরা আজও ভীত। ঘড়িতে তখন প্রায় ২.০৫ । ট্রেনের লাইভ রানিং স্টেটাস বলছে আমাদের ট্রেন তখনও মোকামা থেকে ছাড়েনি। কাজেই হাতে এখনো সময় অঢেল। পরিকল্পনা মাফিক আমরা পা বাড়ালাম লীলাবরণ ঝর্নার পথে।
১২:
মালভূমি অতিক্রম করে আমরা কোটরিয়া স্টেট হাইওয়ে ধরলাম। বেশ সুন্দর রাস্তাটি। দুপাশে কোথাও বা রুক্ষ জমি কোথাও আবার চাষের ক্ষেত।

Kotria state highway
হাইওয়ের ধারেই একটি ছোট মুদিখানা দোকানের সামনে এসে দাঁড় করলেন রাজকুমারজি। রাস্তার অন্য পারে পাশেই রেল লাইন। রাজকুমারজিকে অনুসরণ করে রেল লাইন পার হয়ে একটি গ্রামে ঢুকলাম আমরা।

Village on the way to Lilavaran Fall from Kotria Simultala Highway
এই গ্রামেরই একটি ঘরে একজনের সাথে দেহাতি ভাষায় কি কথা বললো রাজকুমারজি জানিনা, তবে সেই গৃহকর্তা দেখলাম বাচ্ছা একটি মেয়েকে আমাদের সাথে যেতে বললো – “এ নার্গিস, সাব লোগোকো থোড়া নদী পার তাক লেকে যা।” বুঝলাম নার্গিস আমাদের লিলাবরণের গাইড। গ্রামের ভেতরের ওলিগলি ছাড়িয়ে আবার সেই মালভূমির উঁচুনিচু পথ পেরিয়ে প্রায় মিনিট দশেক পর আমরা পৌঁছলাম লিলাবরণ ফলস। কালো পাথরের খাঁজে খাঁজে ধাক্কা খেয়ে নিজের খেয়ালে বয়ে চলেছে শান্ত লীলাবরণ।

Lilavaran Fall at Simultala
বর্ষায় অবশ্য ইনি কতটা শান্ত থাকেন তা বলা মুস্কিল। পাথরের ঢাল বেয়ে একটু নিচে নামতেই দেখি চওড়া চওড়া পাথরগুলোর ওপরটা বেশ সমতল। তাতে দিব্যি বসে কাপড় কাচছেন এক মহিলা, পরে জানলাম ইনি নার্গিসের ভাবীজি। পাথরের ফাঁকফোকরে লীলাবরণের জলে আলুমুনিউমের বাটি চুবিয়ে তখন কুচো মাছ ধরছে কচিকাঁচার দল।

Children gathering at Lilavaran Fall

Small fishes collected by children at Lilavaran Fall
নার্গিস ওদের সাথে মজে থাকলো কিছুক্ষণ। রাঢ় বিহারের মাজখানে এমন সবুজের আচ্ছাদনে সুসজ্জিত অদ্ভুতভাবে মসৃণ বড় বড় পাথরগুলোর ফাঁক দিয়ে বয়ে চলা লীলাবরণ যেন শিমুলতলার অনেক অনেক বছরের জীবন প্রবাহের এক ফল্গুধারা। পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসে কিছুটা মেঠো পথে এগোতেই আমরা লীলাবরণকে অনুসরণ করে চলে এলাম তারই এক অন্য রূপের সামনাসামনি।

Lilavaran river flowing gently in the plains
এখানে তিনি যেন মাতৃ রূপে আঁচল ভরে রুক্ষতার মাঝে নিয়ে এসেছেন উর্বরতা। এক জায়গায় দেখলাম নদীর পার ঘেঁষে আড়াআড়ি জাল ফেলে লীলাবরণের জলে মাছও ধরছে কিছু গ্রামবাসী। বেলা গড়িয়ে এখন ৩টে।

Fishing at Lilavaran waters

Children on the crop fields at Lilavaran
১৩:
সকালের সেই কচুরীর পর পেটে কিছুই পরেনি। এদিকে লাইভ ট্রেন রানিং স্টেটাস তখনও বলে চলেছে মোকামা থেকেই আমাদের ট্রেনটি তখনও গড়ায়নি যেটা নাকি দুপুর ১২ টায় ছাড়ার কথা ছিল। অতএব পাকস্থলির সাথে সাথে আমাদের কপালও কুঁচকাতে শুরু করেছে ততক্ষণে। ঠিক হলো এখন আগে স্টেশন চত্বরে গিয়ে যে যার বাড়ির জন্য কিছু ছানার মুড়কি কিনে বাবলুদা কে রাতের খাবারের কথা বলে রুমে গিয়ে গোছগাছ করে রেডি হয়ে বসে থাকি। স্টেশনে গিয়ে বাবলুদা কে ডিনারের জন্য রুটি আর ডিমের কারি করে রাখতে বললাম…আমরা ট্রেনে ওঠার আগে প্যাক করে নেবো। রাজকুমারজিকে বলে রাখলাম ফোন করলেই যেন যশোদা ভবন থেকে আমাদের তুলে নিয়ে এসে স্টেশনে জমা করে দেয়। এখন বিকেল ৫টা। মোকামা থেকে শিমুলতলা ৪ ঘন্টার রেল পথ,অর্থাৎ এখনি যদি ট্রেন ছাড়ে তবে রাত ৯টায় আমাদের ট্রেন শিমুলতলা ঢুকবে। পরিকল্পনা মাফিক ছানার মুড়কি কিনে রুমে গিয়ে সকলে তৈরী হয়ে বসে থাকলাম। ট্রেন স্টেটাস তখনও সোর্স স্টেশন থেকে “not left” ….এদিকে ঘড়িতে ৬.১৫!! সময় যত এগোচ্ছে, লীনার মুখ দেখি ততই ফ্যাকাসে হচ্ছে। মন ভোলানোর জন্য স্নেহাংশু অন্তক্ষরি শুরু করেছে। অবশেষে, প্রায় ৭টা নাগাদ আমরা আপডেট পেলাম যে কিছুক্ষণ আগে ট্রেন মোকামা থেকে প্রস্থান করেছে…অতএব শিমুলতলা ঢুকতে রাত ১১টা বাজবে। বাবলু কে বলে রাতের খাবারটা ঘরেই আনিয়ে নিলাম। বজরঙ্গীকে গত রাতের ঘটনা জিজ্ঞেস করায় বললো ,” উউ লোগ তো মেরা দোস্ত থা। কাল উনলোগো কা দারু কা প্রোগ্রাম থা। মেরা তবিয়ত ঠিক নেহি থা ইস লিয়ে ওয়াপাস আ গেয়ে। ইসি লিয়ে রাত কো ফির উ লোগ আ গায়ে মুঝে লে যানে কে লিয়ে।”
১৪:
খাওয়া দাওয়া সেরে ৯.৩০ টা নাগাদ রাজকুমারজি কে ডেকে নিয়ে স্টেশনে চলে এলাম কারণ ওনাকে বেশি রাত অব্ধি কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয়না। স্টেশনের ঠিক পাশেই একটা বট গাছের নিচে গোল করে বাঁধানো জায়গা আছে বসার। সেখানেই আমরা বাকি সময়টা আড্ডা মেরে দিব্যি কাটালাম। অত রাত্রে আমরা চারজন একা বসে থাকলেও লীনার ফ্যাকাসে মুখ বা বিদিশার হনুমান চল্লিশা আওড়ানো বা স্নেহাংশুর গত রাতের ভয় তটস্থ হয়ে থাকা….কোনোটারই আর এখন অস্তিত্ব নেই। ভয় কি তবে আমাদের মনের কোনো এক অজানা গলি যেখানে আগে কোনোদিন আমাদের পা পড়েনি? হয়তো তাই। বা…হয়তো সবসময় তাই নয়? তা সে যাই হোক, শিমুলতলা শিমুলতলাতেই থাকবে আমাদের মনের ভেতর চিরকাল তার সব জানা আর অনেক অজানাকে আকড়ে ধরে।
© Arijit Kar

Hi! I am from Kolkata, India. Travelling and photography is my passion. As I love landscape photography most, travelling goes hand in hand with it. Since my matriculation days I started travelling. I have also penned down a book on my travelling which is available in Amazon in the name of Ghuranchandi – Part 1. Whatever travel experiences I have, I have shared those in my blog in the form of travel stories.